সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে বড় হচ্ছে দেশের কৃষি খাত। আবিষ্কার করা হচ্ছে নতুন জাতের ফসলের জাত। এদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে এ খাতের ঝুকি বাড়ছে প্রতিনিয়ত।
চাষের ক্ষেত্রে বীজ বপন থেকে ফসল তোলা পর্যন্ত কৃষকদের স্বাভাবিক ঝুঁকি বিমা প্রদান করা হয়। দাবানল, বজ্রপাত, ঝড়, শিলাবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা প্লাবন, খরা, শুষ্ক মৌসুম, রোগ পোকার ক্ষতি প্রভৃতি নানারকম ঝুঁকির জন্য ফসলের ক্ষতি হলে কৃষকরা এই বিমার আওতায় আসবেন।
জলবায়ুর খারাপ অবস্থা নির্দিষ্ট সুচকে পৌঁছালেই একজন কৃষক বিমা কোম্পানির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ দাবির অধিকারী হন। যেমন একটি পলিসির শর্তানুযায়ী, তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের নিচে টানা ৭২ ঘন্টা থাকলে এবং আর্দ্রতা ৮৫ শতাংশের বেশি হলে তারা ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারেন।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, গত বছর আবহাওয়ার অস্বাভাবিক আচরণে কৃষি খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। এবারও কৃষি, উন্নয়নকাজসহ সব পরিকল্পনায় আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের বিষয়টি মাথায় রেখে এগোতে হবে। এই ক্ষেত্রে কৃষিবিমার মাধ্যমে কৃষকদের সুরক্ষা দেওয়া যাবে।
তিনি বলেন, বিমার কিস্তি বা প্রিমিয়াম যেন বেশি না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে। কারণ, অনেক দেশে বেশি অঙ্কের প্রিমিয়াম বিদ্যমান, তাই এই ধরনের বিমা সফল হয়নি। আর এ ধরনের বিমার কিস্তি বেশির ভাগই সরকারকে দিতে হবে। যেটি পাশের দেশ ভারতে আছে।
২০১৯ অর্থবছরে দুটি বিমা কোম্পানি মাত্র ১ হাজার ৫২৬টি কৃষি বিমা পলিসি বিক্রি করলেও মাত্র চার বছরের ব্যবধানে তা এখন ২ লাখ ১৪ হাজার ৮৩৬টিতে পৌঁছে গেছে।
এখন পর্যন্ত দেশের ৪২ জেলার ৬০ হাজার কৃষক গ্রিন ডেল্টা ইনস্যুরেন্সের বিমা সেবার আওতায় এসেছেন। তবে মাঠপর্যায়ে বিমা কোম্পানিগুলোর পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় বিমাপণ্য বিতরণ ও পরিচালনায় কৌশলগত ও বন্টন অংশীদার হিসেবে কাজ করছে: ব্র্যাক, সিনজেনটা বাংলাদেশ লিমিটেড, ইকো-সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো), গ্রাম উন্নয়ন কর্ম, জেবিকে এন্টারপ্রাইজ এবং ইজাব এগ্রো লিমিটেড।
গ্রিন ডেল্টা ইনস্যুরেন্সের হেড অফ ইমপ্যাক্ট বিজনেস ও এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট শুভাশীষ বড়ুয়া জানান, তাঁদের প্রতিষ্ঠানে সবচেয়ে বেশি বিমা নিয়েছেন উত্তরাঞ্চলের কৃষকেরা।
তিনি বলেন, উত্তরাঞ্চলে বেশি বন্যা হয়। বিমা করা থাকলে যদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়, তাহলে কৃষকেরা ক্ষতিপূরণ পান, যা দিয়ে আবার কৃষিকাজ করতে পারেন।
তিনি আরো বলেন, ২০১৭ সালে আগাম ও স্বাভাবিক বন্যায় হাওরের ৫২ লাখ ৫০ হাজার টন ফসলের ক্ষতি হয়। এর আর্থিক মূল্য ছিল ৩ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা। আগাম ও স্বাভাবিক বন্যা, অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে ফসলের ক্ষতির জন্য হাওরের কৃষককে ত্রাণ, নগদ সহায়তা, প্রণোদনাসহ নানা ধরনের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় ২০১৮ সালে সিনজেনটা ফাউন্ডেশন 'সুরক্ষা' নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করে। এর আওতায় আছে অন্তত ১৯টি বিমাপণ্য; যা অনেক কৃষককে তাদের আমন ও বোরো ধান, আলু, ভুট্টা ও শিম শস্যের প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাণিজ্যিকভাবে সুরক্ষা দিয়েছে।
সিনজেনটা ফাউন্ডেশন এবং বিমা কোম্পানিগুলোর সূত্রমতে, সাধারণ বীমা কর্পোরেশন ও গ্রিন ডেল্টা ইন্সুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড ২০১৯ অর্থবছরে মাত্র ১ হাজার ৫২৬টি কৃষি বিমা পলিসি বিক্রি করে। কিন্তু মাত্র চার বছরের ব্যবধানে তা এখন ২ লাখ ১৪ হাজার ৮৩৬টিতে পৌঁছে গেছে।
বিমাকারী কৃষকরা প্রতি সপ্তাহে ফোনে আবহাওয়ার পূর্বাভাস, আগাম সতর্কতা এবং কৃষি-পরামর্শ পরিষেবা পান। আর বিমা দাবি নিষ্পত্তির ক্ষেত্রেও তাদের কোনো দাবি উত্থাপন করতে হয় না। বরং পুরো প্রক্রিয়ায় স্বয়ক্রিয়ভাবে সম্পন্ন হয়।
ব্র্যাকের এগ্রিকালচারাল ইন্সুরেন্স, মাইক্রোফিন্যান্স এর টিম লিডার আলী তারেক পারভেজ বলেন, "আমরা মূলত মাইক্রোফিন্যান্স নিয়ে কাজ করি। এ কারণে যারা আমাদের থেকে কৃষিঋণ নেয়, তাদের কাছে আমরা ইনস্যুরেন্স পণ্যগুলো অফার করি।"
জানা গেছে, এখন পর্যন্ত কৃষকরা সবচেয়ে বেশি বিমা করেছেন আলুর জন্য। চার বছরে -আলুতে বিমা করা হয়েছে ৯২ হাজার ৬১৬টি, আমন ধানে বিমা হয়েছে ৭৭ হাজার ৫৯৩টি, বোরো ধানে ৪২ হাজার ১৭৪টি, ভুট্টায় ২ হাজার ৩৪৭টি এবং শিমে বিমা হয়েছে ১০৭টি।
বিভিন্ন ইন্স্যুরেন্সের কর্মকর্তারা বলছেন কৃষকরা প্রিমিয়াম দিতে অনিচ্ছুক এবং তাদের এর গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করা উচিত।
তারা বলেন, যখন কোনো দুর্যোগ আঘাত হানে, কৃষকরা ফসল হারানোর ঝুঁকি অনুভব করে এবং প্রিমিয়াম দিতে আগ্রহী হয়। যাইহোক, যখন জিনিসগুলি ঠিক থাকে এবং ফসলের উৎপাদন ভাল হয়, তখন তারা প্রিমিয়াম দিতে আগ্রহী হয় না।
সাধারন বীমা কর্পোরেশনের উপ-মহাব্যবস্থাপক ওয়াসিফুল হক মনে করেন, বীমা খাতের প্রবৃদ্ধির জন্য সরকারি সহায়তা প্রয়োজন। সরকার যদি বীমা প্রিমিয়ামে ভর্তুকি দেয় তবে কৃষক এবং বীমা কোম্পানি উভয়ই উপকৃত হবে বলে তিনি মনে করেন।
এএ