আইডিআরএ চেয়ারম্যান: সুবিধাভোগী হয়েও বিমার শেয়ারে বিনিয়োগ
নিজস্ব প্রতিবেদক আপডেট: ২০২২-০৪-১৩ ০৯:৩৮:৩৭
বিমা কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ)। বিমা কোম্পানিগুলোর ভালো মন্দ সব খবর জানাতে হয় সংস্থাটিকে। সিকিউরিটিজ আইনেও নিষিদ্ধ করা হয়েছে সুবিধাভোগী ব্যবসা। কিন্তু আইডিআরএ চেয়ারম্যান তার ব্যতিক্রম। সংস্থাটির চেয়ারম্যান হওয়ার পরও বিমা কোম্পানির শেয়ার নিয়ে চালিয়ে গেছেন ব্যবসা।
বিএসইসির সুবিধাভোগী ব্যবসা (ইনসাইডার ট্রেডিং) নিষিদ্ধকরণ বিধিমালা ১৯৯৫ অনুসারে, সুবিধাভোগী ব্যক্তি, যাদের কাছে কোম্পানির মূল্যসংবেদনশীল তথ্য জানার সুযোগ থাকে, তাদের সে কোম্পানিতে বিনিয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পাশাপাশি আইডিআরএ আইনেও সংস্থাটির চেয়ারম্যান, সদস্য ও কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে স্বার্থসংশ্লিষ্টতার বিষয়ে আগেই অবহিত করার বিধান রয়েছে।
তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়, লাভস অ্যান্ড লাইভস অর্গানিকস লিমিটেড (এলএলওএল) ও গুলশান ভ্যালি এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের (জিভিএআইএল) গ্র্যাচুইটি ও প্রভিডেন্ট ফান্ডের মাধ্যমে আইডিআরএ চেয়ারম্যান বিমা কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছেন। এর মধ্যে এলএলওএল এমপ্লয়িজ গ্র্যাচুইটি ফান্ড ও এলএলওএল এমপ্লয়িজ কন্ট্রিবিউটরি প্রভিডেন্ট ফান্ডের মাধ্যমে পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স ও ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারে বিনিয়োগ করেছেন। পাশাপাশি এ দুই ফান্ডের মাধ্যমে সেনা কল্যাণ ইন্স্যুরেন্সের আইপিও শেয়ার বরাদ্দ নেয়া হয়েছে। অন্যদিকে জিভিএআইএল এমপ্লয়িজ গ্র্যাচুইটি ফান্ড ও জিভিএআইএল এমপ্লয়িজ কন্ট্রিবিউটরি প্রভিডেন্ট ফান্ডের মাধ্যমে গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স ও ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারে বিনিয়োগ করা হয়েছে। পাশাপাশি এ দুই ফান্ড থেকে সেনাকল্যাণ ইন্স্যুরেন্সের আইপিও শেয়ার বরাদ্দ নেয়া হয়েছে।
২০২০ সালের জুলাই থেকে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স ও ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারে এ চার ফান্ডের মাধ্যমে বিনিয়োগ করা হয়েছে। আর গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারে গত বছরের নভেম্বরে জিভিএআইএল এমপ্লয়িজ গ্র্যাচুইটি ফান্ডের মাধ্যমে বিনিয়োগ করা হয়েছে। গত বছরের জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬ মাসে ড. এম মোশাররফ হোসেন এ ফান্ডগুলোর মাধ্যমে ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স ও গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারে ৫৩ লাখ টাকারও বেশি বিনিয়োগ করেছেন। আর গত বছরের অক্টোবরে সেনা কল্যাণ ইন্সুরেন্সের বরাদ্দ পাওয়া আইপিও শেয়ারের দাম ছিল ৫১ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে বীমা খাতের শেয়ারে এলএলওএল এমপ্লয়িজ গ্র্যাচুইটি ফান্ড, এলএলওএল এমপ্লয়িজ কন্ট্রিবিউটরি প্রভিডেন্ট ফান্ড, জিভিএআইএল এমপ্লয়িজ গ্র্যাচুইটি ফান্ড ও জিভিএআইএল এমপ্লয়িজ কন্ট্রিবিউটরি প্রভিডেন্ট ফান্ডের বিনিয়োগের পরিমাণ কোটি টাকারও বেশি।
বিমা খাতের শেয়ার ছাড়াও ২০১৯ থেকে এ পর্যন্ত এ ফান্ডগুলোর মাধ্যমে সি পার্ল বিচ রিসোর্ট, এবি ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, ওইমেক্স ইলেকট্রোড, নাহি অ্যালুমিনিয়াম, এসএস স্টিল, রানার অটোমোবাইলস, কপারটেক ইন্ডাস্ট্রিজ, ইন্ট্রাকো রিফুয়েলিং, স্কয়ার টেক্সটাইলস, হামিদ ফ্যাব্রিকস, কুইন সাউথ টেক্সটাইলস, আমান কটন ফাইব্রাস, ভিএফএস থ্রেড, এমএল ডায়িং, কাট্টলী টেক্সটাইল, নিউ লাইন ক্লদিংস, রিংশাইন টেক্সটাইলস, অ্যাডভেন্ট ফার্মাসিউটিক্যালস, সিলভা ফার্মাসিউটিক্যালস, ইন্দো-বাংলা ফার্মাসিউটিক্যালস, সিলকো ফার্মাসিউটিক্যালস, এমকি পেস্টিসাইডস, সোনালী পেপার, ফরচুন সুজ, এসকে ট্রিমস, জেনেক্স ইনফোসিস, এডিএন টেলিকম, ওরিজা এগ্রো, মাস্টারফিড এগ্রোটেক, এসিআই লিমিটেড, ন্যাশনাল পলিমার, সাইফ পাওয়ারটেক, বিডিকম অনলাইন, বিডি থাই ফুড, ইনডেক্স এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ, আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনের বন্ড ও বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ারে বিনিয়োগ করা হয়েছে।
বিএসইসির আইন:
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সুবিধাভোগী ব্যবসা (ইনসাইডার ট্রেডিং) নিষিদ্ধকরণ বিধিমালা ১৯৯৫ অনুসারে, কোনো কোম্পানির পরিচালক, প্রধান শেয়ারহোল্ডার, ম্যানেজিং এজেন্ট, ব্যাংকার, নিরীক্ষক, উপদেষ্টা, কর্মকর্তা বা কর্মচারী সুবিধাভোগী ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত হবেন। পাশাপাশি এসব ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্কের কারণে কিংবা কোম্পানির সঙ্গে সম্পর্কের কারণে কিংবা তার অবস্থানের কারণে মূল্যসংবেদনশীল তথ্য জানতে পারেন বা জানার সুযোগ রয়েছে এমন ব্যক্তিরাও সুবিধাভোগীর আওতায় পড়বেন।
বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেয়ারম্যান হিসেবে অবস্থানের কারণে ড. এম মোশাররফ হোসেনের বিমা কোম্পানির মূল্যসংবেদনশীল তথ্য জানার সুযোগ রয়েছে এবং তিনি একজন সুবিধাভোগী ব্যক্তি। সুবিধাভোগী ব্যবসা নিষিদ্ধকরণ বিধিমালা লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে বিএসইসি কর্তৃক তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার বিধান রয়েছে। সুবিধাভোগী হওয়া সত্ত্বেও আইডিআরএ চেয়ারম্যানের বিমার শেয়ারে বিনিয়োগের বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
বিমা আইনে কী আছে:
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ আইন ২০১০-এর ২৭ ধারা অনুসারে সংস্থাটির চেয়ারম্যান, সদস্য ও কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে স্বার্থগত দ্বন্দ্বজনিত কারণে বিমা কোম্পানিতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এ ধরনের বিনিয়োগ থাকলে কর্তৃপক্ষকে আগেই জানানোর বিধান রয়েছে।
উচ্চ আদালতের নির্দেশে বিমা কোম্পানিতে আইডিআরএ চেয়ারম্যানের বিনিয়োগের বিষয়টি বর্তমানে তদন্ত করছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এরই মধ্যে তদন্ত কমিটির কাছে হাজির হয়ে তার বক্তব্য দিয়েছেন ড. এম মোশাররফ হোসেন।