চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ’ স্বাভাবিক পণ্য সরবরাহ ও এলডিসি উত্তরণ এই তিনটি বিষয়কে আগামী বাজেটে বড় চ্যালেঞ্জ মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও শীর্ষ ব্যবসায়ীরা।
তারা বলেন, পণ্য উৎপাদন ব্যহত, সরবরাহ বাধাগ্রস্থ এবং আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি জনিত অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো আগামী বাজেটে চিহ্নিত করতে হবে। বৈশ্বিক চাপ মোকাবেলায় অভ্যন্তরীণ সক্ষমতা বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও সামাজিক সুরক্ষা বাড়ানোরসহ নানা সুবিধা আগামী বাজেটে থাকতে হবে।
দ্য বিজনেস পোস্ট রাউন্ডটেবিল ইকোনোমিক চ্যালেঞ্জ এন্ড দ্য আপকামিং বাজেট ফর ফিনান্স্যিয়াল ইয়ার-২০২৩ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা আসন্ন বাজেট নিয়ে তাদের সেসব মূল্যবান মতামত তুলে ধরেন।
আজ শনিবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে বিজনেস পোস্ট কার্যালয়ে এর আয়োজন করে ইংরেজি দৈনিক দ্য বিজনেস পোস্ট।পত্রিকাটির নির্বাহী সম্পাদক নাজমুল আহসানের সঞ্চালনায় বক্তারা একে এতে তাদের জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য তুলে ধরেন।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বাজেটের মূল চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। বর্তমান মূল্যস্ফীতি এর উৎস বৈশ্বিক পরিস্থিতি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানির দাম বৃদ্ধি। যখন বৈশ্বিক কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়ে তখন আভ্যন্তরীন পলিসি দিয়ে ঠেকানো যাবে না। এ ক্ষেত্রে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাদের কতটা সুরক্ষা দিতে পারে বাজেটে তার প্রতিফলন থাকা উচিত। এ জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বাড়ানো যায়। কিন্তু যাদের প্রয়োজন তারা সঠিকভাবে তা পায় না। এই তহবিলের টাকা তসরুফ হয়। এটা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। সুতারং এ খাতে আগামী বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো উচিত।
একই সঙ্গে পেনশনকে সামাজিক নিরাপত্তা খাত থেকে বাদ দেওয়া উচিত। প্রত্যেক বছর বাজেটের যে আকার থাকে সংশোধিত বাজেটে তা কমানো হয় এবং বাস্তবে আরও কম হয়। বাজেটের সংখ্যা কতটুকু অর্থবহ এমন প্রশ্ন তুলেন এ অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, এই প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। এ ক্ষেত্রে বাজেটের আকার কমানো নয়। ব্যয় সক্ষমতা বাড়ানো দরকার। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন সরকারি ব্যয় বাংলাদেশের।
মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, রাজস্ব না বাড়লে ব্যয়ের মাত্রা কমবে। নেপাল ও ভারতে ট্যাক্স জিডিপি রেশিও ২২ শতাংশ। আর পাকিস্তানেও ১৫ শতাংশ। বাংলাদেশে বর্তমানে ১০ শতাংশ অনুপাতে বাড়াতে হবে। যারা কর দেন তাদের উপর চাপ দেওয়া হয়। অথচ টিন ধারীর সংখ্যার অর্ধেক ট্যাক্স রিটার্ন দেন না। তাদের কাছ থেকে কেন কর পাওয়া যায় না তা দেখার বিষয় আছে।
তিনি বলেন, এখন শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বে হার বেশি। এ ব্যাপারে বাজেটে পদক্ষেপ থাকা উচিত। কারণ গত এক দশক ধরে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ স্থবির। এ ক্ষেত্রে ফান্ডিং ও ক্যাপিট্যাল মার্কেট সমস্যা সামাধান করা দরকার।
ব্যবসার সহজীকরণ সূচকে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। তবে আগের চেয়ে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তপক্ষের ওয়ান স্টপ সার্ভিস উন্নতি হয়েছে। বর্তমানে ব্যক্তি পর্যায়ে বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতি থাকলেও প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা রয়েছে। আগামী বাজেটে এ বিষয়ে নির্দেশনা থাকতে পারে।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, একটা সংস্কারের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছিল দেশ। কোভিড উত্তর ভালোভাবে যাচ্ছিল এবং ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগে উৎসাহিত হচ্ছিল। ওই সময়ের পর থেকে সাপ্লাই চেইন বাধাগ্রস্থ হয়েছে। একই সঙ্গে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। যুদ্ধের কারণে সামগ্রিক জ্বালানি মূল্য বৃদ্ধি ও সরবরাহ সংকটের চাপ এখন অর্থনীতিতে বিরাজমান।
সিপিডির রিচার্স ডিরেক্টর বলেন, ব্যালেন্স অব পেমেন্টে চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। রপ্তানি বেড়েছে, তবে এখন রপ্তানি চেয়ে আমদানি ব্যয় প্রবৃদ্ধি বেশি। এ ক্ষেত্রে রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক ঋণ দিয়ে সমতা করতে পারি। তবে সেটা চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আগামী কিছু দিন ফরেনএক্সচেঞ্জ মার্কেটে অস্থিশীল পরিস্থিতি থাকবে। ডলারের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যৌক্তিক ব্যবস্থা নিতে হবে। কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম বেশি। এক্ষেত্রে সঠিক পদক্ষেপ না নিলে হুন্ডিতে রেমিট্যান্স বেড়ে যাবে। এ জন্য খোলা বাজার থেকে ডলার কেনাবেচার বিষয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে।
তিনি বলেন, পণ্য সরবরাহ ঘাটতি মোকাবেলায় পদক্ষেপ থাকতে হবে। মূল্যস্ফীতি জনিত সংকট ধীরে ধীরে বাড়ছে। মূল্যস্ফীতি এখন যে জায়গায় দাড়িয়েছে এই সময়ের প্রেক্ষাপটে খাদ্যমূল্য স্ফীতি কমেছে আর খাদ্যবর্হিভূত বেড়েছে। এটা কি করে হয় এমন প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। মূল্যস্ফীতি ধরে রাখার প্রবণতা আছে এটা ঠিক নয়।
মোয়াজ্জেম বলেন, ঋণের সুদ একটি নির্দিষ্ট হারে রাখার কারণে ঋণ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এসএমই খাতে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দিয়ে ব্যাংকগুলোর পোষায় না। এ কারণে ব্যাংকগুলো এসএমই ঋণে নিরুৎসাহিত হবে। আগামীতে এসএমই খাতের স্বার্থে সুদ হারের এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন পড়বে।
তিনি আরও বলেন, আগামী বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাড়াতে হবে। বিশেষ করে শিল্পের শ্রমিকের জন্য খাদ্য সরবরাহ বৃদ্ধি এবং দরিদ্র ও খুবই সীমিত আয়ের মানুষের সহায়তা দেওয়া যেতে পারে।
কর্মসংস্থান বাড়ানোর বিষয়ে তিনি বলেন, বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থানের সৃষ্টিতে সুবিধা বাড়ানো। একই সঙ্গে যেসব সরকারি প্রকল্পে কর্মসংস্থান বাড়ানোর সুযোগ আছে সেসব ক্ষেত্রে প্রাধিকার দেওয়া। এমন সমাপ্ত প্রকল্পগুলোতে নতুন করে বরাদ্দ দেওয়া উচিত। এছাড়া অঞ্চল ভিত্তিক প্রকল্প গ্রহণ করা প্রয়োজন। নির্বাচনের আগে ছোট ছোট প্রকল্পে সংসদ সদস্যদের চাপ থাকবে। এটি না করে কর্মসংস্থান ভিত্তিক প্রকল্পে নজর দিতে হবে।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, আগামী বাজেটে করোনা, যুদ্ধ ও এলডিসি উত্তরণ এই তিনটি চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ নিয়েই বাজেটের পরিকল্পপনা করতে হবে। এ জন্য তিন বছরের রোলিং সিস্টেম বাজেট করতে হবে।
৯ মাসে এডিপি ৪৫ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়। বাকিটা বাস্তবায়ন হয় তিন মাসে।