বিদেশি বিনিয়োগ, বিদ্যুৎ খাত ও আমাদের বাজেট সংস্কৃতি
:: আপডেট: ২০২২-০৬-২৬ ২১:৫৭:২৩
করোনার কারণে মুখ থুবড়ে থাকা বিশ্ব অর্থনীতি সঙ্গে ইউরোপের রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ ছোট‑বড় সব দেশের অর্থনীতিকে গভীর সংকটে ফেলেছে। খাদ্য ও জ্বালানিসহ নিত্যপণ্যের মূল্য বিশ্বজুড়েই ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে। এ অবস্থায় জাতীয় উন্নয়ন প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই), বিদ্যুৎ‑জ্বালানি খাতে স্থিতিশীলতা, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড), বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠাসহ প্রয়োজনীয় সব অবকাঠামো গড়ে তুলতে সবাই উঠেপড়ে লেগেছে। স্বভাবতই বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করেও সফল হতে পারছে না। স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি, কর্মক্ষম বিপুল জনগোষ্ঠী, সস্তা শ্রম এবং সর্বোপরি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক যুগেরও অধিকাল ধরে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক হিসেবে ক্ষমতায় আসীন থাকার পরও এসব ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত অগ্রগতি না হওয়ার পেছনে কী কারণ কাজ করছে, সে নিয়ে অর্থনীতিবিদেরা অনেক দিন ধরেই বলে আসছেন। আর যেহেতু যেকোনো দেশের বার্ষিক বাজেটই তার উন্নয়নের দিকনির্দেশক দলিল, সেহেতু বাংলাদেশের জাতীয় বাজেট ঘোষণার প্রাক্কালে এসব বিষয় আবারও সামনে চলে এসেছে।
আমাদের বাজেটের কাঠামোগত দুর্বলতার বিষয়টি সরকারসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ভালো করেই অবগত, যা পুরোপুরি বৃহৎবর্গীয় এবং রাজনৈতিক দর্শনের ওপর নির্ভরশীল। সমস্যাটির সমাধান এখনো বহু দূরে। এ নিয়ে নতুন করে আলোচনা আমার এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। বরং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং এর সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত বেশকিছু খাত‑ক্ষেত্রের মৌলিক সমস্যা ও তার সমাধানে আমাদের বাজেট নীতিনির্ধারকদের ক্রমাগত ব্যর্থতা সাধারণ মানুষের কাছে যে অত্যন্ত পীড়াদায়ক হয়ে উঠেছে, সেটা তুলে ধরাই আমার লক্ষ্য। কারণ, সাধারণ মানুষ যখন দেখেন যে এশিয়ারই ১১ কোটি জনসংখ্যার দেশ ফিলিপাইনের ১৫ লাখ দক্ষ প্রবাসী আছে, যারা বছরে ৩৭ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠান, আর ¯্রফে কলুর বলদের মতো পরিশ্রম করা ২০ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশের ১ কোটি ২৫ লাখ অদক্ষ প্রবাসী বছরে দেশে পাঠান মাত্র ২০ বিলিয়ন ডলার, যা আবার কমে গেলে না খেয়ে মরার আতঙ্ক পেয়ে বসে। এ অবস্থায় বাজেট কাঠামোগত সমস্যার বাইরেও বাজেট প্রণয়ন সংস্কৃতিতে মৌলিক কিছু সমস্যা আশুমেয়াদে সমাধান করা না গেলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে কোনোভাবেই প্রগতিমুখী ও টেকসই করা সম্ভব হবে না।
আমরা মোটামুটি সবাই অবগত যে, মহামারির ক্ষতি কাটিয়ে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বিশ্বের সব দেশের সরকারই তাদের বার্ষিক বাজেটে নানামুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো—অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে প্রচুর বিদেশি বিনিয়োগের জোগান নিশ্চিত করা। আর এ লক্ষ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, ব্যবসা সহজীকরণ, কর ছাড়, দক্ষ শ্রমশক্তি সরবরাহসহ প্রয়োজনীয় সব সহায়তাই তারা দিচ্ছে। এর ফলে তাদের অর্থনীতিতে বিদেশি বিনিয়োগের পরমিাণ দিন দিন বাড়াছে। কিন্তু নানামুখী পদক্ষেপ সত্ত্বেও বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ মোটেও সন্তোষজনক নয়।
এফডিআই প্রবাহ বাড়ানোর ক্ষেত্রে অনেক সূচকে বাংলাদেশ অন্যদের তুলনায় এখনো অনেক পিছিয়ে। এখানে বার্ষিক গড় এফডিআই মাত্র ৩০০ কোটি ডলারে মধ্যে সীমাবদ্ধ। অথচ যুক্তরাষ্ট্র ও চীন ১৫ হাজার কোটি ডলারের বেশি এফডিআই পায় প্রতিবছর। ২০১৯ সালে দেশে নিট এফডিআই এসেছিল ২৮৭ কোটি ৩৯ লাখ ডলার, যা ২০২০ সালে করোনার কারণে ১০.৮০ শতাংশ কমে ২৫৬ কোটি ৩৫ লাখ ডলারে দাঁড়ায়। ২০১৮ সালে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সাড়ে ৩০০ কোটি ডলারের বেশি বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত ২০২১ সালের নভেম্বর শেষে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের মোট বাজার মূলধন ছিল ৪৬ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা, যার মধ্যে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে থাকা শেয়ারের বাজার মূলধন ছিল ২২৭ কোটি টাকা, যা এই খাতের মোট বাজার মূলধনের দশমিক ৪৮ শতাংশ। একই সময়ে দেশের পুঁজিবাজারে ওষুধ, ব্যাংক এবং খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের কোম্পানিগুলোতে সবচেয়ে বেশি বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছে। এই তিন খাতে মোট বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা।
চতুর্থ অবস্থানে টেলিযোগাযোগ খাত, যেখানে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে থাকা এই খাতের শেয়ারের বাজার মূলধন ১ হাজার ৫৯৯ কোটি টাকা, যা এ খাতের মোট বাজার মূলধনের ২ দশমিক ৩৩ শতাংশ। টেলিযোগাযোগ খাতের মোট বাজার মূলধন ছিল ৬৮ হাজার ৭২৮ কোটি টাকা। এ সময় প্রকৌশল খাতের মোট বাজার মূলধন ছিল ৫৬ হাজার ৯৩ কোটি টাকা, এর মধ্যে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে থাকা এ খাতের শেয়ারের বাজার মূলধন ৭০৫ কোটি টাকা, যা এ খাতের মোট বাজার মূলধনের ১ দশমিক ২৬ শতাংশ। বিদেশি বিনিয়োগের দিক দিয়ে ষষ্ঠ অবস্থানে আর্থিক প্রতিষ্ঠান; গত বছরের নভেম্বর শেষে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে থাকা এ খাতের শেয়ারের বাজার মূলধন ৪৯৫ কোটি টাকা, যা এ খাতের মোট বাজার মূলধনের ২ দশমিক ১৭ শতাংশ। বিদেশি বিনিয়োগের দিক দিয়ে অষ্টম অবস্থানে বস্ত্র খাত, যেখানে গত বছরের নভেম্বর শেষে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে থাকা শেয়ারের বাজার মূলধন ২২০ কোটি টাকা, যা এ খাতের মোট বাজার মূলধনের ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এ খাতে মোট বাজার মূলধন ছিল ১৬ হাজার ১৪৩ কোটি টাকা। বিদেশি বিনিয়োগের দিক দিয়ে নবম ও দশম অবস্থানে রয়েছে বিবিধ ও বিমা খাত। এ দুই খাতে গত বছরের নভেম্বর শেষে বিদেশিদের কাছে থাকা শেয়ারের বাজার মূলধনের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ১৭৭ কোটি ও ৯১ কোটি টাকা। এ ছাড়া সিমেন্ট, তথ্যপ্রযুক্তি, সেবা ও আবাসন, মিউচুয়াল ফান্ড, চামড়া, সিরামিকস এবং ভ্রমণ ও অবকাশ খাতের কোম্পানিগুলোতে কিছু পরিমাণে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল।
এবার আসা যাক বিদ্যুৎ‑জ্বালানি প্রসঙ্গে। তথ্য বিশ্লেষণে বোঝাই যাচ্ছে, এফডিআই আকর্ষণে বিদ্যুৎ খাত কয়েক বছর ধরেই প্রথম দিকে রয়েছে। এর কারণ, সরকার বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ আকর্ষণে নানা রকম সুযোগ‑সুবিধা প্রদান করেচে। ফলে দেশে গত এক দশকে সবচেয়ে বেশি সম্প্রসারিত হয়েছে এই খাত। এ সময়ে একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের মধ্য দিয়ে বাড়ানো হয়েছে সক্ষমতা। বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২১ হাজার ২৩৯ মেগাওয়াট। কিন্তু বিশাল এই সক্ষমতার মাত্র ৪০ শতাংশ ব্যবহার করা যাচ্ছে।
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে দেশে বিদ্যুৎ খাতের স্থাপিত সক্ষমতা ছিল ২১ হাজার ২৩৯ মেগাওয়াট এবং প্রকৃত উৎপাদন সক্ষমতা ২০ হাজার ৭৪৮ মেগাওয়াট। কিন্তু এই বিপুল পরিমাণ উৎপাদন সক্ষমতার বিপরীতে গত ১৮ জানুয়ারি দিনের পিক আওয়ারে উৎপাদন হয়েছে ৭ হাজার ৭৫৮ মেগাওয়াট এবং সন্ধ্যার পিক আওয়ারে উৎপাদন হয়েছে ৯ হাজার ২৯৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। ফলে কয়েক বছর ধরেই বিদ্যুৎ খাতে উৎপাদন সক্ষমতার ব্যবহার ধারাবাহিকভাবে কমছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের স্থাপিত বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার মাত্র ৪০ শতাংশ ব্যবহার করা গেছে। যদিও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সক্ষমতার ৪৩ শতাংশ, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪৫ শতাংশ এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রায় ৪৮ শতাংশ ব্যবহার হয়েছিল।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, অথনৈতিক কর্মকা-কে বিস্তৃত করা না গেলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে সক্ষমতার ব্যবহার ৪০ শতাংশেরও নিচে নেমে যাবে। সেই সঙ্গে অতিরিক্ত সক্ষমতার বিরূপ প্রভাব পড়ছে বিপিডিবির আর্থিক অবস্থা এবং বিদ্যুতের দামের ওপর। এর পাশাপাশি একদিকে উন্নত যন্ত্রপাতিসমৃদ্ধ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের ৬০ শতাংশই বেকার পড়ে আছে। আর অন্যদিকে বিদু্যুৎ সক্ষমতা বাড়ানোর অন্যতম লক্ষ্য এফডিআই আকর্ষণ, সেটাও অর্জিত হচ্ছে না। একদিকে পড়ে থাকতে থাকতে লোহাতেও মরচে ধরার মতো কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে কমছে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ব্যবহার, অন্যদিকে সরকার প্রতিবছর বিদ্যুৎ খাতের এই বেকার কেন্দ্রগুলোসহ এ‑সংশ্লিষ্ট আরও নানা ক্ষেত্রে ভর্তুকি হিসেবে বিপুল পরিমাণ অর্থ গচ্চা দিচ্ছে। আসন্ন ২০২২‑২৩ অর্থবছরে দেশের ইতিহাসে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সর্বোচ্চ ভর্তুকি চাওয়া হয়েছে, সব মিলিয়ে যার পরিমাণ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বিদ্যুতের উৎপাদনপর্যায়ে ২৫ হাজার কোটি টাকা আর এলএনজি আমদানির অতিরিক্ত ব্যয় মেটাতে ৪০ হাজার কোটি টাকা।
২০২১‑২২ অর্থবছরে অর্থমন্ত্রী এ খাতের জন্য ২৭ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকার প্রস্তাব করেছিলেন। সাধারণত, বাজেটে যে পরিমাণ ভর্তুকির জন্য বরাদ্দ থাকে এর বাইরেও সহজ শর্তে ঋণ হিসেবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানিকে অর্থ দিয়ে থাকে সরকার। এই টাকা ঋণ হলেও ফেরত দেওয়ার কোনো নজির নেই। ফলে এই টাকাকেও ভর্তুকি হিসেবে বিবেচনা করাই সংগত। ২০২১‑২২ অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যুতে সরাসরি ১০ হাজার কোটি টাকা এবং জ্বালানিতে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয়েছিল। অথচ চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এই যুগে স্বাস্থ্যশিক্ষা ও প্রযুক্তির মতো অতি জরুরি খাতের গবেষণায় জন্য বরাদ্দ ছিল মাত্র ১০০ কোটি টাকা।
এবার দৃষ্টি দেওয়া যাক, আমাদের রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) দিকে। ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন অথরিটি অ্যাক্ট করা হয় অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। বিশেষ করে এশিয়ার চীন, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ডের সফলতার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশও এ উদ্যোগ নেয় রপ্তানি বাড়াতে। এই ৪০ বছরে বাংলাদেশ ৮টি ইপিজেড হয়েছে ২ হাজার ২৯০ একর জমিতে। এর মানে গড় হিসাবে প্রতিটি জমির আকার ৩০০ একরেরও কম। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের বর্তমান এই যুগে ৪০ বছরে ৮টি ইপিজেড, তাও আবার অনেক ইপিজেড এখনো খালি পড়ে আছে। স্বভাবতই প্রশ্ন আসে বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতানির্ভর চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এই যুগে বাংলাদেশে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও শিল্পায়নের প্রক্রিয়ার কার্যক্রম কি পরিকল্পিত পথে এগোচ্ছো? অবশ্যই না। ক্ষুদ্র পরিসরে সামান্য কয়েকটি উদাহারণ দিলে বিষয়টির সত্যতা পাওয়া যাবে।
ময়মনসিংহ বিভাগের জামালপুর জেলার সদর উপজেলার ৪৩৬ দশমিক ৯২ একর জায়গায় জামালপুর অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন করা হচ্ছে। এরই মধ্যে ফিজিবিলিটি স্টাডি ও মাস্টারপ্লান সম্পন্ন হয়েছে। পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও প্রশাসনিক ভবন নির্মাণকাজ শেষ। জামালপুর অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৩৫৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এখানে ৩টি শিল্পকারখানা স্থাপনের কাজ চলছে। এখানে বিদ্যমান শিল্পকারখানার সংখ্যা ৮ হাজার ২১৩টি। অপরদিকে শুধু ময়মনসিংহ জেলার আয়তন ৫ হাহার ৩৬৩ দশমিক ৪৮ বর্গ কিলোমিটার, যার মধ্যে ভালুকা উপজেলার আয়তন ২৭৫ বর্গ কিমি.। এখানে এক-পঞ্চমাংশজুড়ে ছিল সরকারি বনভূমি, যার অধিকাংশই এখন সরকারি ব্যবস্থাপনার বাইরে পরিকল্পনাহীনভাবে শত শত শিল্পকারখানার দখলে, যার হিসাব কোনো দপ্তরের কাছেই নেই। স্বভাবতই এসব শিল্পকারখানাগুলোয় বিদ্যুৎ ও জ্বালানির প্রয়োজন হচ্ছে। আর যেহেতু এসব বৈধভাবে হয়নি, সেহেতু এখানকার বিদ্যুৎ সংযোগের মূল্যও শিল্পহারে নয়। ফলে সরকার এখান থেকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে।
ভালুকার মতো অবস্থা চলছে সারা দেশে। একদিকে বেপজার অধীনে থাকা ইপিজেডগুলোতে ৪০ বছরে মোট ৯৪ হাজার ৮৫৭ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ হয়েছে। এসব হয়েছে পোশাক, জুতা ও চামড়া, ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিকস, তাঁবু, কৃষিজাত পণ্য, মাছ ধরার বড়শি, গলফ খেলার স্টিক, খেলনা, পরচুলা ইত্যাদি খাতে। এখানে লক্ষণীয় বিষয় এসব বিনিয়োগের অধিকাংশই বিদু্যুৎ ও জ্বালানিনির্ভর ভারী শিল্পে নয়। উন্নত দেশগুলোর প্রায় বাতিল হয়ে যাওয়া শিল্পসমূহই আমাদের দেশের ইপিজেডগুলোতে আসছে। আর সে কারণে, এ পর্যন্ত ইপিজেডগুলো থেকে মোট পণ্য রপ্তানি হয়েছে মাত্র ২১ লাখ ২২ হাজার ১৫০ কোটি ডলারের। এ ছাড়া কর্মসংস্থান হয়েছে ৪ লাখ ৭২ হাজার ৩১৪ জনের। ভাবলে অবাক হতে হয়, বেপজা ২০১৯-২০ অর্থবছরে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিয়েছে মাত্র ২০ কোটি টাকা। ৪০ বছরে ৮টি ইপিজেড‑এর মাধ্যমে তাদের পক্ষে বার্ষিক ২০ কোটি টাকা রাজস্ব দেওয়ার সক্ষমতা অর্জিত হয়েছে।
২০২০-২১ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরেও তারা ২০ কোটি টাকা করে সরকারকে দিয়েছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় যেখানে ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিট এফডিআই আসার কথা ছিল, সেটা মাত্র ১০-১১ বিলিয়ন ডলার এসেছে। অন্যদিকে ২০২০-২১ অর্থবছরে ২০৬ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ সাড়ে ২০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ প্রদর্শনের নামে রেকর্ড পরিমাণ ২ হাজার ৬৪ কোটি কালোটাকাকে সাদা করে দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এই সুযোগে প্রায় ১২ হাজার করদাতা ২০ হাজার ৬০০ কোটি অবৈধ টাকা বা কালোটাকা বৈধ বা সাদা করেছেন। এসব টাকার কিছু অংশও যদি অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় যেত, তা হলে তা দেশের কাজে লাগত।
অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, আমাদের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকেরা কি এতটাই অজ্ঞ যে তারা আমাদের বাজেট প্রণয়নের এতসব অসংগতি ঝুঝতে পারেন না, কিংবা জানতেন না যে এত পরিমাণ বিদ্যুৎ সক্ষমতার অপচয় হবে, ইপিজেড অলস পড়ে থাকবে, কর্মক্ষম বিশাল জনগোষ্ঠী চাকরির জন্য হাপিত্যেশ করবে। আসলে সর্বোচ্চ মহলের ক্রমবর্ধমান হারে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ইপিজেড প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা বিশ্বপ্রেক্ষাপটে সঠিকই ছিল। কিন্তু আমাদের জাতীয়পর্যায়ে বাজেট প্রণয়নে অসৎ কিছু সংস্কৃতির চর্চা সরকারের অনেক বড় বড় অর্জনকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এর মূলে রয়েছে আমাদের বার্ষিক বাজেটের পশ্চাৎমুখী নীতি‑পরিকল্পনার মজ্জাগত কিছু ক্রটি, যার পৃষ্ঠপোষকতা করছে দুর্বৃত্ত পুঁজিবাদের বিশ্ব মোড়লদের অনুগত দেশীয় কিছু গোষ্ঠী।
এতকিছুর পরেও অর্থনীতিশাস্ত্রের মানুষ হিসেবে আমরা আশাবাদী যে সুদিন অবশ্যই আসবে, যখন চক্ষু চড়কে তোলার মতো অনেক অসংগতি আর আমাদের জাতীয় বাজেটে দেখা যাবে না। কারণ, অবাধ বাণিজ্য, মুক্তবাজার, তথ্য ও প্রযুক্তিনির্ভর চতুর্থ শিল্পবনির্ভর এমন এক যুগে আমরা বাস করছি—যখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ট্যাক্সি কোম্পানি উবারের নিজের কোনো ট্যাক্সি নেই, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মিডিয়া ফেসবুকের নিজস্ব কোনো কনটেন্ট নেই, পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী পাইকার আলিবাবার কোনো গুদাম নেই এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় আবাসন প্রোভাইডার এয়ারবিএনবির নিজের কোনো আবাসিক ভবন নেই। অর্ধ শতক আগে বিদেশি শক্তিকে আত্মসমপর্ণে বাধ্য করে স্বাধীন হয়েও অনেক ক্ষেত্রে ধুঁকতে থাকা বাংলাদেশের সামনে এসবই এখন চরম বাস্তবতা। পরিশেষে বলতেই হয়, তীব্র আকাক্সক্ষা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাও যদি এসব পরজীবী ও অসৎ গোষ্ঠীকে সমূলে বিনাশ না করে যেতে পারেন, তাহলে আমাদের অনাগত প্রজন্মের জন্য ভয়বাহ এক সময়ই অপেক্ষা করছে।
লেখক: মোঃ আইনুল ইসলাম
অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান
অর্থনীতি বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
এএ