"স্বামীরা তো একটু মারবেই, যে ভরণপোষণ করে সে তো একটু মারতেই পারে।" আবহমান কাল থেকে এভাবেই নিজের অর্ধাঙ্গকে মেনে আসছেন নারীদের অনেকে। বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চল, এমনকি শহুরে জীবনেও। এটাই সামাজিকীকরণ কিংবা শিক্ষণ যাই বলি না কেন। বাল্যবিবাহ অথবা পড়াশোনায় এসএসসির গন্ডি না পেরুনো নারীরা বেশি আক্রান্ত এমন ভাবনায়।
তারা জানেন না কোন বিষয়গুলোকে নারী নির্যাতন বলা যাবে? নির্যাতন মানে তাদের কাছে ভয়াবহ ধরনের কিছু- এসিড সন্ত্রাস, পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠানো ইত্যাদি। কিল-ঘুষি, অকারণে মারধর চলতেই পারে। এগুলোকে নির্যাতন বলা বরং নারীরই লজ্জা। চোখে আঙুল দিয়ে সমাজের সবাই লজ্জা দিবেন। আর পারিবারিক বলে বিষয়গুলোকে এড়িয়ে যাওয়া ভদ্রতা ধরে নেন তারা। কিন্তু একসময় এ ছোটখাটো'র মাত্রা বাড়তে থাকে, যার ভয়াবহতা মৃত্যু পর্যন্ত গড়ায়।
২০১১ সালে বাংলাদেশ মানবাধিকার সংস্থার জরিপ অনুসারে ১৭.৬ শতাংশ নারী নির্যাতনের বিচার চান। আর বাকীরা সহ্য করেন মুখ বুজে। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৩ সালের হিসাব অনুসারে নারী নির্যাতনের চিত্র আরো ভয়াবহ। যেখানে বলা হয়েছে, বিশ্বে প্রতি তিনজনের একজন নারী নির্যাতনের শিকার হন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, বাংলাদেশের বিবাহিত নারীদের ৮৭ শতাংশ কোন না কোন সময়ে স্বামীর কাছে নির্যাতিত হয়েছেন। আবার ৩০ শতাংশ নারীই মনে করেন, নির্যাতিত হওয়াটা পারিবারিক ব্যাপার। এটা এখন একটি (অপ)সংস্কৃতি হয়ে গেছে যেখানে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ’’ অনুসারে নারী নির্যাতনের হার কমিয়ে আনার বিষয়ে সরকারও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
শিক্ষিত আর স্বাবলম্বী হতে চাওয়া নারীদের ওপর নির্যাতনের রূপও ভিন্নতর আমাদের সমাজে। প্রতিবাদ করতে গেলে ’মুখরা রমণী, পুরুষালী আচরণ ইত্যাদির নানা খেতাবও জোটে তাদের। পারিবারিক নির্যাতনের প্রতিবাদ করা বা বিচার দাবি করলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তালাক, আলাদা থাকা অথবা নির্যাতনের পরও সমঝোতা করতে হয়।
পরিবারের আপনজনের কাছেই অনেক শিশু নির্যাতনের শিকার হন। বাবা-মা জেনেও গোপন করেন। মেয়েটির বিয়ে দেয়া লাগবে এরুপ অযুহাতে। এছাড়াও এলাকার উঠতি ছেলেদের কাছে নানা বাজে মন্তব্য, টানাটানির বিষয়টা সালিশ নামের একটি ঢাকনায় ঢেকে দেয়া হয়। অনেক মেয়েই ধর্ষিত হওয়ার পরেও ধর্ষককেই বিয়ে করছেন সালিশের অন্যায় আদেশে। সারাজীবন এমন এক বিকৃত মন-মানসিকতার লোকের সঙ্গে কিভাবে পার করবেন এ বিষয়টা ভাবেন না কেউ। তাদের কথা বিয়ের পরই সব সমস্যার সমাধান হবে।
আর নিগৃহিত হওয়ার পর যেসব নারী বা শিশু সহ্য করার ক্ষমতা হারান তারা বেছে নেন আত্মহত্যার পথ।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই নির্যাতন বিরোধি আইন আছে। বাংলাদেশ মানবাধিকার আইন ছাড়াও ১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, এসিড অপরাধ দমন আইন ২০০২, নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ আইন ২০০০ (সংশোধনী ২০০৩)।
এসব আইনের আওতায় ধর্ষণ,এসিড নিক্ষেপ যৌন পীড়ন এবং যৌতুকের জন্য নির্যাতনসহ অন্য সব ধরনের নির্যাতনের আইনগত সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে।আর অপরাধগুলো দমন করতে কঠোর শাস্তির বিধানও আছে। ১৯৮৪ সালে সিইডিএডব্লিউ সনদ এর পর ১৯৮৫ সাল থেকে শুরু হয়েছে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর কার্যক্রম। ছোট বড় মিলিয়ে অসংখ্য বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা নির্যাতনের প্রতিরোধ ও প্রতিকারের উদ্দেশ্যে নিরলসভাবে কাজ করছে। সরকারের নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় রয়েছে।
ইদানিং সরকারি বেসরকারি ও নারীবান্ধব সংস্থাগুলোর উদ্যোগে সভা, সেমিনার, মানববন্ধন আলোচনায় এসব নির্যাতনের প্রতিবাদ ওঠে। এজন্য ২৬ সেপ্টেম্বর "নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস"ও পালিত হয়। কিন্তু যেসব নারী প্রতিবাদ জানান না বা কাউকে বলার সুযোগ পান না সেসবের প্রতিবাদ কে করবে?
সমাজ বিজ্ঞানী ও সমাজ বিশ্লেষকদের মতে, উচ্চবিত্ত নারীরা নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পেতে তালাকের আবেদন করেন আর নিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত শ্রেণীর নারীরা খোরপোশের আবেদন করেন। ফলে তালাকের হার বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের হিসাব মতে, ২০১৩ সালে তালাকের আবেদন ছিল ৮১৯১টি, ২০১২ সালে ছিল ৭৬৫৩টি যা ২০১১ সালে ছিল ৬৭৭৬টি। ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সাড়ে তিন হাজারের বেশি তালাকের রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত নারীরা তালাকের পর খোরপোষের আবেদন করেও তা পান না। বাধ্য হয়েই আদালতের আশ্রয় নেন তারা। কিন্তু সেখানেও ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত অনেকেই।
নারীরা নির্যাতন, নিগ্রহের প্রতিবাদ করলে তাদেরই সমাজ থেকে অনেক কটুকথা শুনতে হয়। অভিভাবক বাবা-মা কিংবা মুরব্বীদের কাছে শুনতে শুনতে, সয়ে যেতে হয়। সংসার থেকেও নানা গঞ্জনা শুনতে হয়। বাইরে বেরুলে, চাকরি করলে সর্বক্ষেত্রে অশালীন আচরণের প্রতিবাদ করলে সমাজ তাকেই ছিছি করে।
তাই প্রশ্ন ওঠে ’ নির্যাতনের শিকার হওয়া কি নারীরই লজ্জা?
লেখকঃ খাদিজা আক্তার যুথী, উন্নয়ন কর্মী