ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মো. তারিক আমিন ভূঁইয়া যে লক্ষ্য নিয়ে এসেছিলেন, তা বাস্তবায়ন করতে পারছেন না জানিয়ে গত মঙ্গলবার পদত্যাগ করেন। গত বছরের ২৫ জুলাই ডিএসই’র এমডি হিসেবে ৩ বছরের জন্য দায়িত্ব নেন তিনি। এরই মধ্যে পুঁজিবাজারকে গতিশীল ও আধুনিক করার জন্য নানামুখী কাজেও হাত দিয়েছিলেন তারিক আমিন। আর এই সময়ে তার মতো দক্ষ কর্মকর্তা চলে গেলে ডিএসই’র ডিজিটালাইজেশনসহ চলমান উন্নয়ন ধারাবাহিকতা বাধাগ্রস্ত হবে বলে মনে করছেন আর্থিক খাতের বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, আবার ডিএসই পূর্বের নাজুক অবস্থায় ফিরে যাবে এবং অযোগ্যরা আবার ডিএসই দখল করবে।
সূত্র মতে, আর্থিক খাতের দৈন্যদশার মধ্যেও কিছুটা আলো ছড়াচ্ছে পুঁজিবাজার। এর পেছনে কাজ করছে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারিক আমিন ভূঁইয়া’র নানামুখী পদক্ষেপ। এই ধারাবাহিকতায় পুঁজিবাজারকে গতিশীল ও আধুনিক করার জন্য অনেক কাজেই হাত দিয়েছিলেন তারিক আমিন। এর মধ্যে অন্যতম ছিলো ডিএসইতে ডাটা সেন্টার গড়ে তোলা। এছাড়া সিসিএ ওয়ালেট যা ব্যাংকের মাধ্যমে একটি যৌথ কাজ। এটি গ্রাহকদের টাকার নিরাপত্তার সঙ্গে জরিত।
এর মাধ্যমে গ্রাহক প্রতিদিন তার বিও হিসেবের টাকার বিষয়ে খুব সহজেই জানতে পারবে। একই সঙ্গে ব্লক চেইন টেকনোলজি, এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ড (ইটিএফ), অল্টারনেটিভ ট্রেডিং ফান্ড (এটিবি), রিয়েল এস্টেট ইনভেস্টমেন্ট ট্রাস্ট (আরইআইটি), এনভারমেন্ট সোস্যাল গভার্নেন্স (ইএসজি), ইম্পেক্ট ফান্ড, ডন গ্লোবালের সাথে মিলে নতুন ইটিএফ, শরীয়াহ বোর্ড, বিদেশি বিনিয়োগ আনতে ডিজিটাল স্টক এক্সচেঞ্জ এনআইটিএ চালু করা, বিকাশ, নগদ ও উপায়ের মতো পুঁজিবাজারে সার্ভিস চালু করা, স্ট্যাটআপ কোম্পানির জন্য নতুন বোর্ড, আইসিটি কোম্পানির তালিকাভুক্তির উদ্যোগ, লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জ গ্রুপ এবং জাতিসংঘের ক্যাপিটাল ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের (ইউএনসিডিএফ) সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করা।
সূত্র জানায়, সরকার পুঁজিবাজারকে ডিজিটালাইজেশন ও বিশ্বব্যাংকের ৭ কোটি ডলার প্রকল্পের আওতায় তারিক আমিন ভূঁইয়াকে বিদেশ থেকে বিশেষ অনুরোধ করে ডিএসইতে নিয়োগ দেয়। তার স্থানে অন্য কোন বিদেশিকে নিয়োগ দিলে বড় অঙ্কের বেতন দিতে হতো। সরকারের আস্থার প্রতিদান হিসেবে ডিএসইতে এরই মধ্যে তিনি বেশ কিছু উচ্চ মানের প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন। অথচ নিয়োগের ১৩ মাস যেতে না যেতেই পদত্যাগ করলেন তারিক আমিন ভূঁইয়া। পদত্যাগের পর জানা গেল তার আগের আরও দুই এমডির পরিণতিও একই হয়েছে। কেন এমডিরা বারবার কেন পদত্যাগ করছেন এমন প্রশ্নের সরাসরি জবাব দেয়ার কেউ নেই।
তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, সবকিছুর মূলে কাজ করছে পরিবারের মাধ্যমে স্বতন্ত্র পরিচালকদের শেয়ার ব্যবসায় ঢুকে পড়া। যা এরই মধ্যে বিএসইসি’র সার্ভিলেন্সে ধরা পড়েছে। পরিবারের এসব ব্যবসাও চালাতেন ও তথ্য দিতেন ডিএসই’র কিছু কর্মকর্তা। এই সূত্র ধরে ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারিক আমিন ডিএসইতে কিছু রদবদল করেন। এতে অনেক স্বাধীন পরিচালক বিপাকে পড়ে যান। এর মধ্যে রয়েছে ডিএসইর আইটি বিভাগের অদক্ষতা। এই বিভাগের অদক্ষতার কারণে দীর্ঘদিনেও ডিএসই ব্যাকআপ সার্ভার তৈরি করতে পারেনি। এখনও এটি না হওয়ায় বড় ধরণের ঝুঁকিতে রয়েছে বিনিয়োগকারীরা।
ডিএসই সূত্র মতে, তারিক আমিন যোগদানের পর সততার সঙ্গে কাজ করেছেন। এই সময়ে তিনি কাউকে চাকরি দেননি। কাউকে চাকরিচ্যুতও করেননি। এমনকি তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অনিয়মের তথ্যও পাওয়া যায়নি। বরং আগের নেয়া প্রকল্পগুলোর খরচ কিভাবে কমানো যায় সে পদক্ষেপও নিয়েছিলেন তিনি। পাশাপাশি যোগ্য ৯৫ কর্মকর্তার পদোন্নতি দিয়েছেন। কর্মকর্তাদের পদোন্নতির সিদ্ধান্ত এমডি’র ক্ষমতার মধ্যেই পড়ে। ডিএসই’র বোর্ড এই সিদ্ধান্ত ভালোভাবে নেয়নি। এই পদোন্নতি বোর্ড আটকে দেয়। তারা এমডিকে যে ভাষায় কথা বলেছে, সেটি পছন্দ হয়নি তাঁর। এর জেরে গত মঙ্গলবার হঠাৎ করেই দায়িত্ব ছেড়ে দেন তারিক আমিন, যার মেয়াদ ছিল আরও ২৩ মাস।
এমডি’র এই পদত্যাগের পর ডিএসই’র বোর্ডের সঙ্গে তার মনোমালিন্যের বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল, এ নিয়ে পরপর তিনজন এমডি তিন বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই পদত্যাগ করেছেন। পরিষদের আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে গত বছর পদত্যাগ করেন আগের এমডি’র দায়িত্ব পালন করা কাজী ছানাউল হক।
তারিক আমিন ভূঁইয়া’র বিভিন্ন পদক্ষেপ ডিএসই’র স্বাধীন পরিচালকদের অনেকের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়। যে কারণে কয়েকজন কর্মকর্তা ও বোর্ডের কয়েকজন পরিচালক বিভিন্নভাবে অসহযোগীতা ও অসম্মান করেন। যাদের পরিবারের সদস্যরা পুঁজিবাজারে ব্যবসা করছেন। ডিএসই’র রেগুলেশন অ্যাফেয়ার্স কমিটিতে (আরএসি) পরিবারের ব্যবসার সব তথ্য প্রদান করতে হয়। যা তারা দেননি। এরই মধ্যে বিষয়টি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি’র কাছে ধরা পড়েছে। এমডি বিষয়টি যেনে যাওয়ায় স্বাধীন পরিচালকরা অস্বস্তিতে পড়েন।
এদিকে এমডি’র পদত্যাগের মধ্য দিয়ে একটি বিষয়ে জোরেশোরে আলোচনা চলছে। তা হলো ডিএসই’র এমডি’র পদে কেউই পূর্ণ মেয়াদ শেষ করতে পারেন না কেন? অনেকের মতে, ডিএসইতে পরিষদ ও ব্যবস্থাপনার মধ্যে একটা দূরত্ব দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। ডিমিউচুয়ালাইজেশনের পরও ব্যবস্থাপনার চেয়ে বেশি ক্ষমতা চর্চার প্রবণতা রয়েছে বোর্ডের মধ্যে। কর্মকর্তাদের অসহযোগিতা এবং স্ব-অধিকারে দায়িত্ব পালন করতে না পারারও অভিযোগ রয়েছে এমডিদের। অবশ্য বোর্ড সদস্যরা তারিক আমিন ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন, তিনি বোর্ডের সিদ্ধান্ত এবং আইন উপেক্ষা করে কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিয়েছেন, বিভিন্ন বিভাগ ও পদ সৃষ্টি করেছেন। অবশ্য তারিক আমিন ব্যাখ্যায় জানিয়েছেন, ডিমিউচুয়ালাইজেশন আইনের বলেই তিনি সব কাজ করেছেন।
সম্প্রতি ডিএসই’র ৯৫ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হলে জরুরি বৈঠক করে গত সোমবার তা আটকে দেয় পরিচালনা পরিষদ। কিন্তু পরিষদের সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করে পরের দিন পদোন্নতির ঘোষণা দেন তারিক আমিন। আর ওই দিন রাতেই ডিএসই’র চেয়ারম্যান ইউনুসুর রহমান বরাবর ই-মেইলে পাঠান পদত্যাগপত্র। ইউনুসুর রহমান বলেন, পদত্যাগপত্রে তারেক আমিন উল্লেখ করেছেন, ১৩ মাস দায়িত্ব পালনকালে তিনি অনেক কাজ করেছেন। নানা সমস্যার কারণে পরিকল্পনা অনুযায়ী অনেক কাজ করতে পারেননি। তাই মনে হয়েছে, তার এ পদে না থাকা ভালো, তাই তিনি পদত্যাগ করেছেন।
পরে গত বৃহস্পতিবার ডিএসইর পরিষদ সভায় পদত্যাগপত্র গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। এখন সংস্থাটিকে নতুন এমডি বাছাই করতে হবে। আপাতত ভারপ্রাপ্ত এমডির দায়িত্ব পালন করছেন প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা সাইফুর রহমান মজুমদার।
ডিএসই’র সাবেক পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, সব সময় পরিচালনা পরিষদকে দায়ী করা হতো, তারা ডিমিউচুয়ালাইজড না হওয়ার কারণে তাদের মধ্যে স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব বা একগুঁয়েমি ছিল। অভিযোগ ছিল অন্যায়ভাবে প্রভাব বিস্তার, ব্যক্তিগতভাবে প্রভাব বিস্তার করার। তখন বোর্ডে স্বতন্ত্র পরিচালক ছিলেন না। যেহেতু স্টক এক্সচেঞ্জের নিজস্ব পরিচালনা পরিষদ, মালিকানা তাদের। এ জন্য তাদের দায়ী করা হতো, তারা সঠিক দায়িত্ব পালন করেন না। কাজেই এমডি তার মেয়াদকাল পূর্ণ করতে পারত না। এ জন্য সরকার মনে করেছেন স্টক এক্সচেঞ্জকে ডিমিউচুয়ালাইজড করা দরকার, কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো ডিমিউচুয়ালাইজড হওয়ার পরও এমডিদের নিয়োগ প্রক্রিয়া ও অবস্থান, মেয়াদকাল পূর্ণ করার ব্যাপারটাও প্রশ্নবোধক থেকেই গেছে। তারিক আমিন সম্পর্কে তিনি বলেন, ব্যক্তিগতভাবে তিনি সৎ, জ্ঞানী, প্রযুক্তি বিষয়ে ভালো জ্ঞান রাখেন। সেদিক থেকেই তাকে নেয়া হয়। ভবিষ্যতে যোগ্যরা আসবেন কি-না এ নিয়েও প্রশ্ন রাখেন তিনি।
অন্য এক পরিচালক জানান, ১০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নিয়ে এমডি’র সঙ্গে পরিষদের দ্বন্দ্ব ছিল। এমডি মনে করতেন, অর্ধেকরও কম ৪০ কোটি টাকায় এটা সম্ভব, কিন্তু পরিষদ বেশি খরচে আগ্রহী ছিল। এ নিয়েই ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা পরিষদের একটি অংশের সঙ্গে প্রথম থেকেই এমডি’র দূরত্ব তৈরি হয়।
ডিএসই’র সাবেক এমডি মাজেদুর রহমান বলেন, অনেক বছর ধরে প্রমোশনগুলো আটকে আছে, তাই এমডি’র সিদ্ধান্ত যথার্থই ছিল। বোর্ডের সিদ্ধান্ত ঠিক নয়। এটা বোর্ডের এখতিয়ার না।
ডিএসই কর্মকর্তাদের পদন্নোতি দেয়ার এখতিয়ার এমডির হাতে রয়েছে বলে জানান, পদত্যাগ করা এমডি তারিক আমিন ভূঁইয়া। তিনি বলেন, এমডির যে অথরিটি, বোর্ড মনে করছে সেটা নাই। অথচ ডিমিউচুয়ালাইজেশনের আইনে স্পষ্টভাবে বলা আছে, অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ হেড ফুললি রেসপন্সিবল, হ্যাড ফুল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অথরিটি ফর ফিন্যানশিয়াল, এইচআর অ্যান্ড জেনারেল ম্যানেজমেন্ট। কন্ট্রোল অ্যান্ড ডাইরেক্টিং স্টাফ, প্রমোশন এসবই এমডির এখতিয়ারের মধ্যে। সূত্র ইনকিলাব।