বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে চুরি হওয়ার ঘটনায় ব্যাংকিং খাতে আলোচনার ঝড় উঠেছে। এ ঘটনায় বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে সফটওয়্যার ঝুঁকির বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তথ্য-প্রযুক্তির (আইটি) ব্যবহারে দেশে কার্যরত ব্যাংকগুলো ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রে ভেন্ডর বা তৃতীয় পক্ষের ওপর নির্ভরশীল। শুধু তাই নয়, ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিতে অর্থ বরাদ্দে যথেষ্ট উদ্যোগী নয়। খরচ কমাতে গিয়ে ভেন্ডর নির্ভর হয়ে পড়ায় সাইবার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। এর ফলে একের পর এক চুরির ঘটনা ঘটছে। এজন্য ভেন্ডর নির্ভরশীলতা কমিয়ে সাইবার নিরাপত্তায় যত্নশীল হওয়া উচিত বলে মনে করছেন তারা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাক্তন ডেপুটি গভর্নর ইব্রাহিম খালেদ বলেন, বাংলাদেশ তথ্য-প্রযুক্তি তথা আইটি খাতের দ্রুত প্রসার হয়েছে। যা দ্রুত প্রসারিত হয়, তাতে ফাঁক থেকে যায়। আইটির প্রসারের পাশাপাশি যে দক্ষ লোকবল ও মানবসম্পদ সৃষ্টি করার কথা ছিল, তা করা হয়নি। এ খাতে বিদেশ নির্ভরতা কমানো জরুরি। আমরা যন্ত্রপাতি কিনতে যত খরচ করি, জনসম্পদ ও বিশেষজ্ঞ তৈরিতে সেই খরচ করা হয় না। তদন্ত ও ব্যাংকের লেনদেনের নিরাপত্তায় দেশের ভেতরের বিশেষজ্ঞ রাখা উচিত। বিদেশিদের নিয়োগের ব্যাপারে আরো সতর্ক হওয়া দরকার।
তিনি বলেন, যখন হলমার্কের মাধ্যমে ৪ হাজার কোটি টাকা লোপাট হলো, তখন বলা হলো যে- এটা কিছুই না। এরপর বেসিক ব্যাংকে যখন ঋণকেলেঙ্কারি ঘটল, তখনো এর যে মূল হোতা, সরকার তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিল না। সে সময় ব্যবস্থা নিলে হয়তো দেশি-বিদেশি তস্কররা ভয় পেত এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে হাত দেওয়ার সাহস পেত না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাক্তন গভর্নর ও অর্থ চুরির ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, আগে তদন্ত শেষ করি, তারপর দেখা যাবে কী করতে হবে। এই সময়ের আগে কিছু বলা যাচ্ছে না।
এর আগে রাজধানীতে ব্যাংকিং খাতে ‘ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশন অন সাইবার সিকিউরিটি’ শীর্ষক আলোচনায় বিশেষজ্ঞরা তৃতীয় পক্ষের সফটওয়ার ব্যবহারে কী পরিমাণ ঝুঁকি রয়েছে, তা নিয়ে কথা বলেন।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের সহকারী অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বলেন, দেশে কার্যরত ব্যাংকগুলো ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রে ভেন্ডর বা তৃতীয় পক্ষের ওপর নির্ভরশীল। আবার ব্যাংকিং খাতে যত চুরি হয়েছে, তার ৭৮ শতাংশের সাথেই কর্মীরা সরাসরি জড়িত। এর জন্য যথাযথ দেখভাল না করাই দায়ী। ব্যাংকিং খাতে বিদ্যমান প্রতিযোগিতাও সুস্থ নয়। এতে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় যথাযথ প্রস্তুতিও নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
প্রিমিয়ার ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মাশরুর রহমান বলেন, সারা পৃথিবীতে বছরে ৩৭ লাখ সাইবার হামলা চালানো হয়। তাই নিজেদের স্বার্থেই বোর্ডের সাথে আইটি বিভাগের সমন্বয় জরুরি।
ইসলামী ব্যাংকে আইটি বিভাগের কর্মকর্তা চৌধুরী সারওয়ার বলেন, সাইবার নিরাপত্তাকে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার অন্তর্ভূক্ত করে ক্যাপাসিটি বিল্ডিং করা দরকার। কর্মীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। ডাটা লিকেজ বন্ধ করতে হবে।
মেঘনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নুরুল আমিন বলেন, ব্যাংকের ক্ষেত্রে প্রত্যেক কর্মকর্তার জন্য একটি করে কম্পিউটার নির্ধারিত রয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া তার পার্সওয়ার্ড অন্য কারো জানা সম্ভব নয়। ব্যাংক কর্মকর্তারা এ বিষয়ে সচেতন হলে এ ধরনের অপরাধ খুব সহজে কারো পক্ষে ঘটানো সম্ভব নয়।
ফিন্যান্সিয়াল এক্সেলের চেয়ারম্যান মামুন রশীদ বলেন, পাসওয়ার্ড হচ্ছে টুথব্রাশের মতো। একে কারো সাথে শেয়ার করা যায় না। শুধু ব্যাংকের বর্তমান কর্মীরা নয়, প্রাক্তন কর্মী এবং ভেন্ডররাও নিরাপত্তা ভেঙে অর্থ চুরিতে সহায়তা করে। আমাদেরকে আইটি সক্রিয় পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আমরা এত দ্রুত এগোচ্ছি যে, প্রস্তুতি আছে কিনা তা ঠাহর করতে পারছি না। এজন্য পূর্বপ্রস্তুতি নিশ্চিত করা দরকার। ব্যাংকিং খাতে বিশ্বাস নষ্ট হয়েছে, নতুন বিশ্বাস তৈরি করতে হবে। আইটি অডিট, ইনফ্রাস্টাকচার অডিটের ব্যবস্থা থাকা দরকার।
পিডব্লিউসির নির্বাহী পরিচালক অরিজিত চক্রবর্তী বলেন, সাইবার অপরাধ যেমন বাড়ছে, তেমনি এর প্রতিরোধ ব্যবস্থাও রয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো তার ডাটা যেভাবে সংরক্ষণ করবে তা নিজস্ব আওতায় থাকলে এ ধরণের ঘটনা ঘটে না। অনেক প্রতিষ্ঠানই তথ্য-প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নিজস্ব আইটি বিভাগের ওপর নির্ভর না হয়ে ভেন্ডর নির্ভরশীল হওয়ায় এ ধরণের ঘটনা ঘটে।
অগ্রণী ব্যাংকের প্রাক্তন ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু নাসের মোহাম্মদ বখতিয়ার আইটি সংক্রান্ত কাজের জন্য জাতীয় কমিটি গঠনের কথা বলেন। পাশাপাশি ডাটা সিকিউরিটি নিশ্চিতের জন্য একটি মেনটেন্যান্স গ্রুপ দরকার।
জানা গেছে, আর্থিক খাতে গত পাঁচ বছরে বিশ্বব্যাপী ৫০ কোটি ক্রেডিট কার্ড অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাপী সাইবার নিরাপত্তা ব্যয় ১৪ শতাংশ বেড়েছে।
প্রসঙ্গত, ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কের ব্যাংক হিসাবে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব থেকে ১০১ মিলিয়ন ডলার চুরি করা হয়েছে। এর একটি অংশ (২০ মিলিয়ন) গেছে শ্রীলঙ্কায়, আরেকটি অংশ (৮১ মিলিয়ন) গেছে ফিলিপাইনে। সম্প্রতি ফিলিপাইনের একটি ইংরেজি দৈনিকে এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। তাতে বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ফিলিপাইনে পাচার হওয়ার কথা উল্লেখ ছিল।
সানবিডি/ঢাকা/রাআ