‘ক্যাম্পাস এখন আমাদের দখলে, সুতরাং আমার সাথে প্রেম করতে হবে, ঘুরতে হবে, সঙ্গ দিতে হবে। আমার সব কথায় রাজি হতে হবে! হলে থাকতে চাইলে আর লেখাপড়া করতে চাইলে ঠিক হয়ে যাও। নইলে খবর আছে।’
সুপ্রিয় পাঠক, উপরের বাক্যগুলো পড়ে চমকে উঠলেন! চমকে উঠার কিছুই নেই। এটাই এখন সমাজের বাস্তব চিত্র। গেল কয়েক বছর থেকে হরহামেশাই এসব বাক্য ব্যবহার করছেন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মিরা। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কেন, স্কুল-কলেজ পর্যায়েও এসব হচ্ছে। এইতো গেল ৫ অক্টোবর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এরকম একটি লঙ্কাকাণ্ড ঘটেছে। এ ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির দাবিতে ক্যাম্পাসে আন্দোলন করছে শিক্ষার্থীরা, প্রতিবাদ-নিন্দা ক্যাম্পাস ছাড়িয়ে সারাদেশে ছড়িয়েছে। কিন্তু তাতে কি বিশ্ববিদ্যালয় ও পুলিশ প্রশাসন তো তাদের।
যা জানা গেল তাতে, ওইদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রিয় গ্রন্থাগারের পেছনের রাস্তা দিয়ে হলে ফিরছিলেন দুইছাত্রী। এ সময় তাঁদের পথরোধ করে প্রেমের প্রস্তাব দেন ছাত্রলীগকর্মী সুজন ও লিটন। কিন্তু তা প্রত্যাখ্যান করায় তারা ক্ষুব্ধ হয়ে ওই দুই ছাত্রীর শরীরে হাত দেন, গায়ে ধাক্কা লাগান, অশালীন উক্তি ও অঙ্গভঙ্গি করেন। উপরোল্লিখিত বাক্যগুলোও উচ্চারণ করেন। এসময় ওই দুই ছাত্রীর আর্ত চিৎকারে অন্যরা এগিয়ে আসলে তারা কথা কাটাকাটিতে লিপ্ত হয়। খবর পেয়ে পুলিশ ও প্রক্টর আসে, তাতে কি? পরে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ দেওয়ার পরেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও পুলিশ ওই দুই ছাত্রলীগ নেতাকে আটক করেনি। তারা বীরদর্পে ক্যাম্পাসে দল করছেন। এর আগে গেল মাসের প্রথম দিকে নবাব আব্দুল লতিফ হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুর রহমানের প্রেম প্রত্যাখ্যান করায় তার এক সহপাঠীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বদ্ধভূমি (গণকবর) এলাকায় নিয়ে মারধর করেন।
ফলে এসব ঘটনা নতুন নয়, এ রকম হাজারো ঘটনা ঘটছে অহরহ। ইতোপূর্বে আমরা দেখেছি, পহেলা বৈশাখ তথা বর্ষবরণের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরে কীভাবে দলবেঁধে মা-বোনদের শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটিয়েছে সোনার ছেলেরা। একদল যুবক প্রকাশ্যে কারো কারো শাড়ি টেনে ধরেছে, কাউকে উলঙ্গ করার চেষ্টা করেছে, স্বামী-সন্তানের সামনে কারো কারো স্পর্শকাতর স্থানে হাত দিয়েছে, কাউকে জড়িয়ে ধরে কিস করেছে। আবার কারো কারো শাড়ি-উড়না নিয়ে গেছে। এসময় অদূরেই দাড়িয়েঁছিল পুলিশ প্রশাসনের লোকজন। অন্যদিকে ঘটনাটি নীরবে অবলোকন করেছে শত শত লোক।
একই দিন জগন্নাথ বিশ্বিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা ছাত্রীকে যৌন নিপীড়ন ও মারধরের ঘটনা ঘটায়। গেল আগস্ট মাসের শেষার্ধে রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর ওপর ছাত্রলীগ নেতাকর্তৃক যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলার অভিযোগে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার অ্যান্ড সাইন্স বিভাগের এক ছাত্রীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা শাওন আহমেদ শুভ প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে নানাভাবে যৌন হয়রানি করে আসছিল। এমনকি প্রস্তাবে রাজি না হলে তার মুখে এসিড ছুড়ে মারার হুমকিও দেয়া হয়।
এর আগে ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থী শিক্ষক ও সহকারী প্রক্টর আসাদুজ্জামানকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। একই ধরনের অভিযোগে ইবির উপপ্রধান প্রকৌশলী আলীমুজ্জামান টুটুলকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ছাত্রীকে শিক্ষক কর্তৃক যৌন হয়রানি আর সাময়িক বরখাস্তের ঘটনা তো অহরহ ঘটছেই। সম্প্রতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানি করায় একই বিভাগের এক সহযোগী অধ্যাপকের পদাবনতি হয়েছে। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ষষ্ঠ সেমিস্টারের এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানির বিচার না করায় চেয়ারম্যানের দপ্তরে তালা দিয়ে বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থীরা।
সম্প্রতি যৌন সন্ত্রাসের প্রতিবাদে মানববন্ধন শেষে ফেরার পথে হয়রানির শিকার হয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। ওই শিক্ষিকার গালে চড় মারেন আরজ মিয়া নামে এক সোনার ছেলে। প্রাচ্যের অক্সফোর্ডের কথা বাদই দিলাম। এ অবস্থা শুধু বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরেই নয়, এ রোগ ছড়িয়েছে স্কুল-কলেজেও।
এইত গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে স্কুল গেটে বখাটের হাতে প্রাণ দিতে হলো ১০ম শ্রেণীর ছাত্রী কবিতা রানী দাসকে। তাকে প্রকাশ্যে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। বখাটে বিক্রম মণিদাস সাভার গণবিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ও ওই সংগঠনের কর্মী বলে জানা গেছে। গেল সেপ্টেম্বের মাস ইডেন মহিলা কলেজের দুই ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠে ঢাকা বিশ্ববদ্যিালয়ের দুই সোনার ছেলের বিরুদ্ধে। কিন্তু এসবের প্রতিকারে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেই।
পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, এই সরকারকেও যেন সেই রকমই ঘোড়ারোগ পেয়ে বসেছে। সবাই যখন চিৎকার করছে মা-বোন, স্ত্রী-সন্তানের ইজ্জত বাঁচানোর জন্য, তখন সরকারের আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী বলছে 'এটা তিন-চারটা ছেলের দুষ্টুমি'। কলেজ উপাধক্ষ্য বলছেন 'মধু থাকলে মৌমাছি আসবেই'। আরো কত নতুন নতুন চমকপ্রদ কথা!
আমার এখনো স্মরণে আছে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ছাত্রলীগ নেতা মানিকের কথা। যিনি ধর্ষণের সেঞ্চুরি উদযাপন করে সংবাদ শিরোনাম হয়েছিলেন। জানি না, তিনি এখন কেমন আছেন এবং কোথায় আছেন। এছাড়া স্মরণে পড়ে ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হবার পরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী যৌনহয়রানির শিকার হয়ে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন এভাবেই- ‘বিশ্ববিদ্যালয় এখন তাদের দখলে, সুতরাং আমাকে প্রেমে রাজি হতে হবে!?
তার নাম শিপন। তার ভাষ্যমতে, ঢাবিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়ে। তার সম্পর্কে আমার এতটুকুই জানা। নিজেকে ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে আমার কাছে জাহির করে। গত বছর অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে বড্ড জ্বালাতে শুরু করে আমাকে সে। গভীর রাতে আমার নাম্বারে কল দিয়ে বিরক্ত করত। তার সাথে কথা বলতে হবে, বেরুতে হবে। নইলে আমার ক্ষতি করে দেবে। সে নাকি অনেক বড় ক্ষমতাধর। আমি বরাবরই তাকে এড়িয়ে যেতাম। ভাবতাম কোথাকার কোন ছেলে হয়তো অযথাই ভয় দেখায়। সেও হুমকি ছাড়া কখনো সামনে এসে দাঁড়াবার সুযোগ পায়নি। আজেবাজে এসএমএস করত। আমি কখনো অ্যানসার করতাম না।’
‘গত ২৯ ডিসেম্বর মধ্যরাতে (আমি তখন বাড়িতে) সে আমাকে ফোন করে জানায়, তার দল ক্ষমতায় এসেছে। সুতরাং, হলে থাকতে হলে তার পুরনো সেই প্রস্তাবে যেন আমি রাজি হয়ে যাই। আমি কিছু না বলে কল কেটে দিয়েছিলাম।’
আজ যখন হলে ফিরছি তখন টিএসসির মোড়ে হঠাৎ একজন আমার সামনে এসে দাঁড়াল। উগ্র উগ্র আর বখাটে ভাব। সাথে আরো কয়েকজন। বলল, আমি সেই শিপন। ক্যাম্পাস এখন আমাদের দখলে। হলে থাকতে চাইলে ঠিক হয়ে যাও। ছেলেটাকে এর আগে কখনো দেখিনি। যেভাবে হুমকি দিয়ে চলে গেল তাতে মনে হলো গণতন্ত্রের পুনর্জাগরণের মধ্য দিয়ে এই ক্যাম্পাস এরই মধ্যে কাউকে লিজ দেয়া হয়ে গেছে। জানি না সে আমার কতটা ক্ষতি করতে পারবে, তবে দেশের জন্যে কোনো মঙ্গল যে বয়ে আনবে না তা হলফ করে বলতে পারি।’
এছাড়া শারমিন শামস নামে এক শিক্ষার্থী লিখেছেন, ‘১৪ই এপ্রিল থেকে অল্প সময়ের মধ্যে ধর্ষণ করে করে সাড়া ফেলে দিলেন আমাদের পুরুষরা। পারফরমেন্স ভালোই! ধর্ষণ তো প্রতিনিয়তই হয়। পাটক্ষেতে, জঙ্গলে, পাকাবাড়িতে, অফিসে, হোটেলে, রান্নাঘরে, বাথরুমে, পাহাড়ে, বাগানে, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। কোথায় নয়? বাদ ছিল এই মাইক্রোবাস। প্রতিবেশি দেশকে দুবেলা গালি দিয়ে আজ আমাদের বীর পুরুষরাই লুঙ্গি তুলে নেমে পড়লেন। এবার ধর্ষণ হবে বাসে, সিএনজি অটোরিক্সায়, টেম্পুতে, ট্রেনে, ফেরিতে।’
এর সত্যতা মিলে বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থার প্রতিবেদন থেকেও। জাতীয় কন্যা শিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সম্পাদক নাছিমা আক্তার সম্প্রতি বলছেন, উচ্চবিত্ত পরিবারই হোক বা নিম্নবিত্ত কোথাও কন্যা শিশুরা যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের মতো ঘটনা থেকে বাদ পড়ছে না এবং তা ঘটছে পরিবারের অভ্যন্তরে, যাত্রাপথে সকল ক্ষেত্রে। এমনকি বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিশুকেও এধরনের নির্যাতনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।
সবশেষে আমাদের রাষ্ট্র্রের কর্ণধারদের প্রতি আহ্বান রাখবো- আসুন আমরা সবাই সময় থাকতে ঘুম থেকে জাগ্রত হই, এসব বিষয়ে সচেতন হই, একগুয়েমি-দলবাজির উর্ধ্বে উঠে সত্যিকার অর্থে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করি। অপরাধী অপরাধীই- হোক সে ক্ষমতাসীন দলের কোনো সদস্য, হোক সে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার কোনো সদস্য কিংবা সাধারণ কোন অপরাধী। সেই সাথে দেশবাসীর প্রতি আহবান- আসুন, সময় থাকতে আমরা সবাই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হই এবং আমাদের দেশ-জাতি ও সমাজকে অধঃপতনের হাত থেকে রক্ষা করি। আমাদের মা-বোন ও সন্তানদের জন্য একটি নিরাপদ ভুমি গড়ে তুলি।
লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক।
ই-মেইল: sarderanis@gmail.com