হেগো মতো ভালা মানুষেরে জামিন দিল না ক্যান?

আপডেট: ২০১৫-০৯-২১ ১৬:২৮:০৫


Manushপরিষ্কার তথ্যপ্রমাণ ও সারা দেশে প্রতিবাদ সত্ত্বেও মামলা জটিলতা কাটছে না। অস্পষ্ট ও সন্দেহজনক কারণে বারবার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে  ‘অদম্য বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন’ এর চার কর্মকর্তার জামিন। রোববারও একই ঘটনা ঘটলো। এদিন সংস্থাটির চার কর্মকর্তাকে জামিন না দেয়ায় রাজধানী আগারগাঁও থেকে আসা পথশিশুদের বেশ কয়েকজন অভিভাবক সিএমএম আদালতের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বলছিলেন, ‘হেগো মতো ভালা মানুষেরে জামিন দিল না ক্যান?’

রোববার ঢাকার সিএমএম আদালতে সকালে ও বিকেলে দু’দফা শুনানি শেষে অদম্য ফাউন্ডেশনের চার কর্মকর্তাকে জামিন দিতে অস্বীকার করেন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট অমিত কুমার দে।

জামিন না দেয়ায় রাজধানী ও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পথশিশুদের অভিভাবক, স্বেচ্ছাসেবী ও জেলহাজতে থাকা ৪ কর্মকর্তাদের আত্মীয় স্বজনরা হতাশা ও কান্নায় ভেঙে পড়েন।

আইনের মারপ্যাঁচ না বুঝা হতদরিদ্র পথ শিশুদের অভিভাবকদের সাথে কথা বলতে গেলে তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমগো কথা হুইন্যা কি অইবো। আমগো কথার কি কোনো দাম আছে?’

একটু সান্ত্বনার কথা শুনিয়ে তাদের কাছে বাংলামেইলের পক্ষ হতে জানতে চাই তারা কোন এলাকা থেকে এসেছেন এবং কেনইবা এসেছেন? তাদের কথায় জানা যায়, লাবনী বেগম, শিরিন বেগম, মমতাজ বেগম ও তরিকুল ইসলাম এসেছেন রাজধানীর আগারগাঁও থেকে।

এদের মধ্যে লাবনী বেগমের মেয়ে রানী, শিরিন বেগমের মেয়ে তাসফিয়া সুলতানা, মমতাজ বেগমের দুই ছেলে রাকিব ও রায়হান এবং তরিকুলের মেয়ে তানিয়া আক্তারকে গত তিন বছর যাবৎ পাঠদান করে আসছে জামিন না পাওযা কর্মকর্তাদের প্রতিষ্ঠান অদম্য বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন। তারা সবাই বলেন, তাদের সন্তানদেরকে তাদের চেয়েও বেশি আদর ভালবাসা দিয়ে আসছে এই প্রতিষ্ঠান। আজ তাদের বিপদ। তাই এসেছেন বিপদে পাশে দাঁড়াতে।

লাবনী বেগম বলছিলেন, ‘তাদের সন্তানদেরকে ভালো স্কুলে পড়ানোর টাকা নেই। বিনা টাকায় এই স্যাররা তো পড়াইতো। হ্যারা কার কি ক্ষতি করলো তা বুঝবার পারতাছি না।’

পাশে দাঁড়িয়ে ভাইয়ের জন্য অঝোরে কাঁদছিলেন ফারজানা আক্তার লাইজু। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও এ মামলার ১নং আসামি আরিফুর রহমান ফারজানা ও লাবনীর একমাত্র ভাই। ভাইয়ের জামিন না হওয়ার বিষয়টিকে তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন ফারজানাদের সত্তরোর্ধ নানা। নাম জানতে চাইলে শুভ্র শশ্রুমণ্ডিত দুবর্ল দেহাবয়বের মানুষটি বাংলামেইলের প্রতিবেদকের ডান হাতটি দু’হাতে ধরে কপালের সাথে লাগিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন। ‍কিন্তু মুখে কিছুই বলতে পারছিলেন না।

এদিন সকালে থেকেই ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবীরা আশাবাদী ছিলেন যে, তাদের কর্মকর্তাদের জামিন হবে। কিন্তু সকালে শুনানি শেষে বিকেলে আবারও শুনানির জন্য রেখে দেন বিচারক। কিন্তু বিকেলের শুনানির সময় বিচারক জানান, দুপুরে রামপুরা এলাকার কোনো একটি মাদরাসার অধ্যক্ষ এসে গোপনে ১৬৪ ধারায় বক্তব্য দিয়ে গেছেন। আর সেকারণে এ অবস্থায় জামিন দেয়া গেল না। কিন্তু কোন মাদরাসার প্রিন্সিপাল এসে বক্তব্য দিয়ে গেলেন এ ব্যাপারে আদালতের জিআর সেকশন থেকে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করায় কোনো তথ্য জানা যায়নি।

উল্লেখ্য, গত ১৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর রামপুরার বনশ্রী এলাকার একটি বাসা থেকে ছিন্নমূল শিশুদের নিয়ে কাজ করে এমন একটি নতুন বেসরকারি সংস্থা অদম্য ফাউন্ডেশনের শেল্টারহোম থেকে ১০টি ছিন্নমূল শিশুকে উদ্ধারের ঘটনায় চার কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করে রামপুরা থানার পুলিশ। এরপর তাদেরকে ২ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়।

ওইদিন (১৬ সেপ্টেম্বর) জামিন আবেদনের শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন অমিত কুমার দে জামিন বিষয়ে আদেশের জন্য ২০ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করেন।

জেলহাজতে থাকা ওই চার কর্মকর্তা হলেন- আরিফুর রহমান (২৪), হাসিবুল হাসান সবুজ (১৯), জাকিয়া সুলতানা (২২) ও ফিরোজ আলম খান শুভ (২১)। এদের মধ্যে আরিফুর রহমান প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান এবং জাকিয়া সুলতানা সাধারন সম্পাদক বলে জানা গেছে।

প্রতিটি তারিখে সারাদেশ থেকে প্রতিষ্ঠানটির বহু স্বেচ্ছাসেবী আদালতে এসে হাজির হন।

রিমান্ড আবেদনের শুনানিকালে ম্যাজিস্ট্রেট এক নম্বর আসামি আরিফুর রহমানের সাথে কথা বলেন। ম্যাজিস্ট্রেট জানতে চান, কীভাবে তারা শিশুদের সংগ্রহ করতেন? জবাবে আসামি আরিফুর বলেন, ‘ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে যেমন- সদরঘাট, কমলাপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা কমপক্ষে ২ থেকে সর্বোচ্চ ৩ মাস বিভিন্ন ছিন্নমূল বাচ্চাদেরকে পর্যবেক্ষণ করে। যদি দেখা যায় একই বাচ্চা দিনের পর দিন একই স্থানে থাকছে এবং অন্য কোথাও যাচ্ছে না, তখন আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা তাদেরকে আমাদের শেলটারে আসার জন্য বলতো। যারা আগ্রহী হতো তাদেরকে নিয়ে আসা হতো।’

এরপর বিচারক ওইসব আসামিদের আর কোনো বক্তব্য শুনতে চাননি। আদালতের বাইরে এসে ওই চার আসামির আত্মীয়-স্বজন এবং উদ্ধারকৃত ১০ শিশুর মধ্যে ছয় শিশুর অভিভাবকদের সাথে কথা বললে বেরিয়ে আসে নিঃস্বার্থভাবে সমাজসেবা করতে গিয়ে ফেঁসে যাওয়া ওই চার তরুণের ভাগ্য বিড়ম্বনার কথা।

প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও মামলার এক নম্বর আসামি আরিফুর রহমানের বড় বোন জানান, গত প্রায় তিন বছর ধরে তার একমাত্র ভাই ছিন্নমূল বাচ্চাদের উন্নত জীবনদানের জন্য অক্লান্তভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সে তাদের পরিবারকে কোনো সময় দিত না। আমরাও তার কাছে সময় চাইনি। আমরা চেয়েছি তার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হউক। কিন্তু আজ এটা কি হচ্ছে?’ বলেই তিনি হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন।

তার সাথে থাকা স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে কাজ করা আরো প্রায় ৭/৮ জন তরুণীও কাঁদতে শুরু করেন। এছাড়া পাশে থাকা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া অন্ততঃ ২০-২৫ যুবকও তাদের ওই চার কর্মকর্তার নিঃস্বার্থ সমাজসেবার কথা এবং এর সাথে নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা জানান। টিভিতে এই সম্পর্কিত সংবাদ দেখে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকেও ছুটে এসেছেন অনেক যুবক।

ভৈরব থেকে আসা সুব্রত সাহা নামে এক কলেজ পড়ুয়া যুবক জানান, তারা ফেসবুকের প্রায় শতাধিক বন্ধু নিজেদের সিগারেট খাওয়ার টাকা জমিয়ে প্রতি মাসে দেড়শ টাকা করে এখানে দেন। অন্যরকম গ্রুপের চেয়ারম্যানও তাদেরকে মাঝে মাঝে অর্থ সাহায্য দিতেন বলে জানান স্বেচ্ছাসেবীদের কয়েকজন। বর্তমানে ওই গ্রুপের চেয়ারম্যান হজ করার জন্য সৌদি আরবে আছেন।

উদ্ধারকৃত বাচ্চারা হলো- মোবারক হোসেন (১৪), আবদুল্লাহ আল মামুন (১১), বাবুল (১০), আব্বাস (১০), স্বপন (১১), ইব্রাহিম আলী (১০), রাসেল (১০), ফরহাদ হোসেন (৯), আকাশ (৯), ও রফিক (১৪)।

এরপর উদ্ধারকৃত ওই ১০ শিশুর মধ্যে নয়জনের সাথে কথা বললে সবাই একবাক্যে রিমান্ডকৃত কর্মকর্তাদের প্রশংসা করে। ওইসব বাচ্চাদের মধ্যে স্বপন, বাবলু, আকাশ, রফিক, রাসেলকে জিজ্ঞাসা করা হয়, তোমরা সেখানে কেমন আছো? উত্তরে জানায়, সেখানে বেশ ভালো আছে তারা। তোমরা আবারো সেখানে ফিরে যেতে চাও কি না। শিশুরা বলে, হ্যাঁ আমরা ফিরে যেতে চাই।

তখনই পাশে থাকা এক পুলিশ কনস্টেবল বলে, ‘কীসের ফিরবে? ওইখানে কোনো পড়ালেখার ব্যবস্থা, চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা নেই, কোথায় যাবে এরা?’ সাথে সাথেই ওই পুলিশের মুখের উপর কড়া প্রতিবাদ জানায় ওই শিশুরা। তারা বলে, হেয় তো দেহি কিচ্ছুই জানে না।

এরপর বাংলামেইলের পক্ষ হতে শিশুদেরকে জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘তোমাদের সেখানে টিভি আছে কি না?’ জবাবে ওরা বলে, আমাদের টিভি আছে, আমাদের খেলার জন্য ছোট ছোট বল আছে। এদের মধ্যে কয়েকজনকে কম্পিউটার কম্পোজ শিখানো হচ্ছে বলেও জানায় ওইসব শিশু।

তবে উদ্ধারকৃত শিশুদের মধ্যে কুমিল্লার মোবারক হোসেনকে অন্যসবার কাছ থেকে আলাদা রাখা হয়েছে। নয় শিশুকে রাখা হয়েছে সিএমএম আদালতের নিচে বিচারপ্রার্থীদের ওয়েটিং রুমে। আর মোবারককে রাখা হয়েছে গারদখানার ভেতর কোনো একটা রুমে। অনেক চেষ্টা করে তার সাথে কথা বলা যায়নি। মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, ওই শিশুর চাচা মনির হোসেনের মামলার ভিত্তিতে সেখানে অভিযান চালায় পুলিশ।

এজাহারে বর্ণিত বাদীর বক্তব্য মতে, গত ছয়মাস ধরে মোবারককে সেখানে আটকে রাখা হয়েছিল। এ ব্যাপারে উপস্থিত প্রতিষ্ঠানের স্বেচ্ছাসেবীদেরকে জিজ্ঞাসা করলে তারা বলেন, ওই ছেলেটি কখনোই তার সঠিক কোনো ঠিকানা বলতে পারেনি। সে কখনোই কোথাও যেতেও চায়নি। হঠাৎ করে পুলিশের অভিযান এবং ওই বাচ্চার বক্তব্যে আমরাও বিস্মিত।

উদ্ধারকৃত শিশু রাসেলের বাড়ি ময়মনসিংহে। তার বাবা জামাল উদ্দিন বলেন, ‘আমি স্যারদের মুক্তি চাই। এরা খুব ভালো মানুষ। আরিফ স্যার ও জাকিয়া ম্যাডাম আমার ছেলেরে নিয়া গত নয় মাসে দুইবার আমার বাড়িতে গেছে। আপনারা দেখেন তাদের লাগি কিছু করতে পারেন কি না।’

উদ্ধারকৃত শিশুদের বক্তব্য এবং রিমান্ডকৃতদের আত্মীয়-স্বজন, শুভানুধ্যায়ী এবং স্বেচ্ছাসেবীদের চোখের পানি ও আকুতি দেখে এই কথা বলা যায় যে, নিঃস্বার্থ সমাজ সেবা করতে গিয়ে ওইদিন রিমান্ডে যেতে হলো অদম্য বংলাদেশ ফাউন্ডেশনের অদম্য চার কর্মীকে।