মহাভারত লেখার নেপথ্যেও রয়েছে এক গণেশ কাহিনি৷ কথিত আছে কৌরব ও পাণ্ডবদের মৃত্যু হলে ব্যাস ধ্যানে বসেন। মহাভারতের সমস্ত ঘটনা তাঁর মনের মধ্যে ফুটে ওঠে। তখন এই সুবিশাল গ্রন্থ লেখার জন্য উপযুক্ত লিপিকারের খোঁজে তিনি ব্রহ্মার কাছে যান। তখন ব্রহ্মা তাঁকে গণেশের কাছে যেতে বলেন। গণেশ মহাভারত লিখতে সম্মত হন, তবে শর্ত রাখেন লিখতে লিখতে তাঁর কলম থামতে দেওয়া যাবে না। যদিও ব্যাসও পাল্টা শর্ত রাখেন শ্লোকের অর্থ না বুঝে লেখা চলবে না। ফলে শ্লোকগুলির অর্থ বুঝতে যখন গণেশ ব্যস্ত সেই অবসরে ব্যাসদেব আরও কতকগুলি শ্লোক রচনা করে ফেলেন। তবে শুধু মহাভারতেই তাঁকে নিয়ে কাহিনি আছে এমন নয়৷ নানা যুগেই রয়েছে সিদ্ধিদতাকে নিয়ে নানা অ্যাখ্যা ৷ পৌরাণিক হিন্দুধর্ম অনুসারে সবার আগে পুজো পাওয়ার কথা গণেশের এবং সেই কারণে তিনি অন্যতম প্রধান দেবতা। যদিও গণপতি’র প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় প্রাচীনতম হিন্দু ধর্মগ্রন্থ ঋগ্বেদে। যদিও এই গণপতি ও বর্তমান কালে পূজ্য পৌরাণিক গণপতি এক নয়। তবে একথা অনেকেই স্বীকার করেন বেদোত্তর যুগে ঋগ্বেদের ‘গণপতি-ব্রহ্মণস্পতি’ থেকেই পৌরাণিক ‘গজবদন-গণেশ-বিঘ্নেশ্বর’-এর ধারণাটি বিবর্তিত হয়েছে। ঋগ্বেদে গণপতির অপর নাম ছিল ‘বৃহস্পতি’ বা ‘বাচস্পতি’। এদিকে তাঁর সম্পর্কে প্রচলিত নানা আখ্যান-উপাখ্যান বিভিন্ন পুরাণ ও মহাকাব্যে স্থান পেয়েছে। বিশেষত যে কাহিনিটি পুরাণ ও উপকথায় সবচয়ে চর্চিত সেটি হল গণেশের ‘গজানন’ হয়ে ওঠা। গণেশ চতুর্থীর সময় সেই সব গল্পই আবার ঝালিয়ে নেওয়া যাক৷
শিবপুরাণে
শিবপুরাণে উল্লিখিত উপাখ্যান অনুসারে, পার্বতী একদিন নন্দীকে দ্বার প্রহারায় নিযুক্ত করে স্নান করতে যান। তখন শিব সেখানে উপস্থিত হলে, তিনি নন্দীকে তিরষ্কার করে পার্বতীর স্নানাগারে প্রবেশ করেন। এতে পার্বতী অপমানিত ও ক্ষুব্ধ হন। পরে সখী জয়া ও বিজয়ার সঙ্গে পরামর্শ করে তিনি জল থেকে পাঁক তুলে একটি সুন্দর পুত্রের মূর্তি নির্মান করেন৷ সেই মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে তাকে নিজের পুত্র ও বিশ্বস্ত অনুচর নিয়োগ করেন৷ তাঁকে দ্বাররক্ষকের দায়িত্ব দিয়ে পার্বতী স্নানে গেলে আবার সেখানে শিব উপস্থিত হন। সেই দ্বাররক্ষী শিবকে যেতে বাধা দিলে শুরু হয় যুদ্ধ । প্রথমে শিব ও সকল দেবতা এই যুদ্ধে পরাজিত হন। তখন নারদের পরামর্শে বিষ্ণু তাঁকে মোহাচ্ছন্ন করেন ও শিব শূলের দ্বারা তাঁর মস্তক ছিন্ন করেন। এই খবর পেয়ে পার্বতী ক্রুদ্ধ হয়ে বিশ্বসৃষ্টি বিনষ্ট করতে গেলে নারদ ও দেবগণ তাঁকে শান্ত করেন। তখন পার্বতী তাঁর এই পুত্রের পুনর্জীবন দাবি করেন ও ইচ্ছা প্রকাশ করেন যেন এই পুত্র সকলের পূজ্য হয়। কাটা মুণ্ডটি তখন আর পাওয়া যায় না। শিব নির্দেশে প্রমথগণকে উত্তরমুখে যান এবং প্রথমে একদন্ত হস্তির দেখা মেলায় তারই মস্তক নিয়ে আসেন। ওই হস্তিমুণ্ডের সাহায্যেই তাঁকে জীবিত করেন। আর শিব তাঁকে নিজপুত্র রূপে স্বীকার করেন। দেবগণের আশীর্বাদে এই কুমার সকলের পূজ্য হন ও গণেশ নামে আখ্যাত হন।
স্কন্দপুরাণে
তবে স্কন্দপুরাণে গণেশের জন্ম বিষয়ে একাধিক উপাখ্যান বর্ণিত হয়েছে। এই পুরাণের গণেশ খণ্ডে রয়েছে সিন্দূর নামে এক দৈত্য পার্বতীর গর্ভে প্রবেশ করে গণেশের মস্তক ছিন্ন করে। কিন্তু এতে শিশুটির মৃত্যু ঘটে না, বরং সে মুণ্ডহীন অবস্থাতেই ভূমিষ্ট হয়। পরে, নারদ সবে জেনে এর একটি বিহিত করতে বললে, সে নিজের তেজে গজাসুরের মস্তক ছিন্ন করে নিজের দেহে যুক্ত করে। আবার স্কন্দপুরাণের ব্রহ্মখণ্ডে আছে, পার্বতী নিজের গাত্রমল থেকে একটি সুন্দর ও পূর্ণাঙ্গ পুতুল নির্মান করে তাতে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেন। এরপর পার্বতী তাঁকে নিজের স্নানাগারের দ্বাররক্ষকের দায়িত্ব অর্পণ করেন। শিব স্নানাগারে প্রবেশ করতে গেলে বালক-কুমার তাঁকে বাধা দেন। শিবের সঙ্গে তাঁর যুদ্ধ হয় ও শিব ত্রিশূলে তাঁর মস্তক ছিন্ন করেন। এরপর গজাসুরকে সামনে পেয়ে শিব তার মস্তক ছিন্ন করেন তার মস্তক কুমারের স্কন্ধে যুক্ত করেন। তাছাড়া স্কন্দপুরাণের অর্বুদ খণ্ডে বলা হয়েছে, পার্বতী গাত্রমল দিয়ে একটি মুণ্ডহীন পুতুল তৈরি করেন। তারপর স্কন্দকে বলেন, পুতুলটির মাথা তৈরির জন্য একতাল কাদা আনতে; এই পুতুল হবে তাঁর ভাই। স্কন্দ কাদা না পেয়ে একটি হাতির মাথা কেটে আনেন। পার্বতী আপত্তি করলেও দৈবযোগে এই মুণ্ডটিই পুতুলের স্কন্ধে যুক্ত হয়। এরপর শক্তিরূপিনী পার্বতী পুতুলটির জীবনদান করেন। গজমুণ্ডযুক্ত পুতুলের দেহে এক বিশেষ নায়কের ভাব ফুটে ওঠে। এই কারণে শিবের বরে ইনি ‘মহাবিনায়ক’ নামে পরিচিত হন। শিব বলেন, এই কুমার গণাধিপতি হবে ও সকল কাজের আগে এঁর পূজা না করলে কার্যসিদ্ধি হবে না। স্কন্দ এঁকে অস্ত্র কুঠার দান করেন, পার্বতী দেন মোদকপূর্ণ সুগন্ধযুক্ত ভোজনপাত্র। মোদকের গন্ধে ইঁদুর এঁর বাহন হয়।
বৃহদ্ধর্মপুরাণ
এদিকে বৃহদ্ধর্মপুরাণ অনুসারে পার্বতী পুত্রলাভে ইচ্ছুক হলে শিব তাতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। অগত্যা পার্বতীর পীড়াপীড়িতে শিব পার্বতীর বস্ত্র টেনে সেটিকেই পুত্রজ্ঞানে চুম্বন করতে বলেন। পার্বতী সেই বস্ত্রকে পুত্রের আকার দিয়ে কোলে নিতেই সে প্রাণ পায়। তখন শিব জানান, এই পুত্র স্বল্পায়ু এবং উত্তরদিকে মাথা করে শায়িত এই শিশুর মস্তকও তৎক্ষণাৎ ছিন্ন হয়ে যায়। পার্বতী শোকাকুল হন। তখন দৈববাণী হয়- উত্তরদিকে মাথা করে শুয়ে আছে এমন কারোর মাথা এনে জুড়ে দিলে এই পুত্রকে বাঁচানো যাবে। পার্বতী তখন নন্দীকে মস্তক খুঁজে আনতে পাঠান৷ নন্দী ইন্দ্রের বাহন ঐরাবতের মাথা কেটে আনেন। সেখানে দেবতারা বাধা দিয়েও ব্যর্থ হন। আর ওই মাথাটি জুড়ে শিব পুত্রকে বাঁচান। এদিকে শিবের বরে, ইন্দ্র ঐরাবতকে সমুদ্রে ফেলে দিলে সে আবার মস্তক প্রাপ্ত হয়।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ
এদিকে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে, শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী কৃষ্ণকে দেখে মুগ্ধ হয়ে পার্বতী অনুরূপ একটি পুত্রকামনা করেন। কৃষ্ণও তাঁকে ইচ্ছাপূরণের বর দেন। এরপর একদিন যখন শিব-পার্বতী স্বগৃহে ক্রীড়ারত ছিলেন, সেই সময় কৃষ্ণ বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের বেশে ভিক্ষা চাইতে আসেন। পার্বতী তাঁকে ভিক্ষা দিতে গেলে শিবের বীর্য পতিত হয় ও কৃষ্ণ শিশুর বেশে পালঙ্কে আবির্ভূত হন। বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ অন্তর্হিত হন। পার্বতী তখন পালঙ্কে ‘শতচন্দ্রসমপ্রভম্’ এক শিশুকে শয্যায় দেখতে পেয়ে আনন্দিত হন। এরপর দেবতা ও ঋষিরা এই কুমারকে দেখতে ভবনে আসেন। আসেন শনি দেবও। শনি নিজের কুদৃষ্টির কথা পার্বতীকে জানান। পার্বতী তবু তাঁকে পীড়াপীড়ি করলে তিনি কুমারকে দেখতে গেলে শনির বাঁ-চোখের কোণ দিয়ে নবজাতককে দেখামাত্র তার মস্তক ছিন্ন হয়ে বৈকুণ্ঠে কৃষ্ণের দেহে গিয়ে মিশে যায়। যা দেখে পার্বতী শোকে জ্ঞান হারান। তখন বিষ্ণু গরুড়ে আরোহণ করে পুষ্পভদ্রা নদীর তীরে এসে উত্তরদিকে মাথা করে শুয়ে থাকা এক হাতিকে দেখেন । তার মস্তক ছিন্ন করলে হস্তিনী ও তার শাবকেরা কাঁদতে কাঁদতে বিষ্ণুর স্তব করতে থাকেন। তখন বিষ্ণু ঐ মুণ্ডটি থেকে দুটি মুণ্ড তৈরি করে একটি হাতির স্কন্ধে ও অপরটি গণেশের স্কন্ধে স্থাপন করে উভয়কেই জীবিত করেন। শিবের অনুগ্রহে গণেশ সকল দেবতার অগ্রে পূজিত হবার অধিকার প্রাপ্ত হন। পার্বতী ও শিবের বরে গণেশ গণাধিপতি, বিঘ্নেশ্বর ও সর্বসিদ্ধিদাতা হন। এরপর কার্তিকেয়কে সেনাপতির পদে নিয়োগ করতে গিয়ে ইন্দ্রের হাত স্তম্ভিত হয়ে যায়। তিনি শিবকে এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, গণেশকে আগে পূজা না করার জন্যই এমন হয়েছে। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে উল্লিখিত আরেকটি মতে, মালী ও সুমালী নামে দুই শিবভক্ত সূর্যকে ত্রিশূল দ্বারা আঘাত করেন। এতে সূর্য অচৈতন্য হয়ে পড়লে বিশ্ব অন্ধকার হয়ে যায়। সূর্যের পিতা কশ্যপ শিবকে অভিশাপ দেন যে শিবের পুত্রে মাথাও খসে যাবে। এই জন্য গণেশ মুণ্ডহীন হন ও ইন্দ্রে ঐরাবতের মাথা এনে তাঁর মস্তকে জুড়ে দেওয়া হয়।
পদ্মপুরাণ মতে, হরপার্বতী ঐরাবতের বেশে বনে বিহার করছিলেন, তাঁদের সেই মিলনের ফলে গজমুণ্ড গণেশের জন্ম হয়।
লিঙ্গপুরাণ মতে, দেবগণ শিবের নিকট উপস্থিত হন ও ব্রহ্মা অসুরদের হাত থেকে নিরাপত্তা চান। শিব তখন নিজ দেহ থেকে গণেশের জন্ম দেন।
বরাহপুরাণ মতে, দেব ও ঋষিগণ রুদ্রের নিকটে বিঘ্নোপসারণকারী এক নতুন দেবতা চাইলে হাস্যময় শিবের সম্মুখস্থ আকাশে শিবের গণ-যুক্ত একটি কুমারের জন্ম হল। এই শিশুর রূপে দেবগণ, এমনকি স্বয়ং পার্বতী মুগ্ধ হয়ে গেলেন। কিন্তু শিব ক্রুদ্ধ হলেন ও অভিশাপ দিলেন যে এই কুমারের গজমুখ, লম্বোদর ও নাগ উপবীত হবে। এই ক্রুদ্ধ হবার সময় শিবের পদনিঃসৃত ঘাম থেকে অসংখ্য গজমুখ বিনায়ক গণ জন্ম নিলেন। কুমার গণেশ হলেন এঁদের অধিপতি। এখানে কুমার গণেশ ও গণেরা বিঘ্নকর ও গজাস্য বলে উল্লিখিত।
দেবীপুরাণ মতে, শিবের রাজসিক ভাব দেখা দিলে তাঁর দুই হাত ঘামতে থাকে এবং সেই ঘাম থেকে গজাননের জন্ম হয়।
মৎস্যপুরাণ মতে, পার্বতী চূর্ণক বা বেসম দিয়ে নিজের গাত্রমার্জনা করছিলেন। সেই সময় এই চূর্ণক দিয়ে একটি গজানন মূর্তি নির্মান করে তা গঙ্গাজলে ফেলে দেন। পুতুলটি বিরাট হয়ে পৃথিবী পূর্ণ করতে উদ্যত হলে পার্বতী ও গঙ্গা একে পুত্র সম্বোধন করেন ও ব্রহ্মা একে গণাধিপতি করে দেন।
বামনপুরাণ মতে, পার্বতী স্নানের সময় নিজের গাত্রমল দিয়ে চতুর্ভূজ গজানন মূর্তি নির্মান করলে মহাদেব তাকে পুত্ররূপে গ্রহণ করেন। বলেন, যেহেতু আমাকে ছাড়াই পুত্রের জন্ম হয়েছে সেহেতু এ বিনায়ক নামে প্রসিদ্ধ হবে এবং বিঘ্ননাশকারী হবে।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে, পরশুরাম একুশবার পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় করে কৈলাসে শিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলে, দ্বাররক্ষক গণেশ তাঁকে বাধা দেন। ফলে উভয়ের মধ্যে ভয়ানক যুদ্ধ হয়। পরশুরাম কুঠারের আঘাতে গণেশের একটি দাঁত সমূলে উৎপাটিত করেন।
শিবপুরাণ মতে, গণেশ ও কার্তিকেয় বিবাহের জন্য পীড়াপীড়ি করছিলেন। তখন স্থির হয়, উভয়ের মধ্যে যে আগে বিশ্বপরিক্রমা করে আসতে পারবে তার বিবাহ আগে হবে। কার্তিকেয় ময়ূরে আরোহণ করে বিশ্বপরিক্রমায় বের হন; কিন্তু গণেশ শিব ও পার্বতীকে সাতবার প্রদক্ষিণ করে বলেন, শাস্ত্রমতে তিনি শতবার বিশ্বপরিক্রমা করলেন। এরপর বিশ্বরূপের দুই কন্যা সিদ্ধি ও বুদ্ধির সঙ্গে গণেশের বিবাহ হয়। সিদ্ধির পুত্র হয় লক্ষ্য ও বুদ্ধির পুত্র লাভ। কার্তিক নারদের কাছ থেকে বিবাহের সংবাদ পেয়ে ফিরে আসেন ও মনের দুঃখে ক্রৌঞ্চ পর্বতে গিয়ে বাস করতে থাকেন। অন্য একটি মতে, তুলসী নামে এক নারী গণেশকে বিবাহ করতে চাইলে ব্রহ্মচর্যব্রতী গণেশ অসম্মত হন। তিনি তুলসীর চিত্ত বৈকল্যের জন্য তাকে শাপ দেন দানবপত্নী হওয়ার। তুলসীও তাকে শাপ দেন। ফলে পুষ্টি নামে এক নারীকে গণেশ বিবাহ করতে বাধ্য হন।
সানবিডি/ঢাকা/রাআ