কাঁচামাল আমদানি পর্যায়ে আকস্মিক সম্পূরক শুল্ক আরোপ ও অতিরিক্ত অগ্রিম করারোপ, জ্বালানি সংকট, অসমন্বয়যোগ্য অগ্রিম কর, পরিবহন ভাড়া ও ডলারের মূল্য বৃদ্ধিসহ নানামুখী সমস্যায় সিমেন্ট শিল্প বর্তমানে কঠিন সময় পার করছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এ অবস্থায় সরকারের যথাযথ পদক্ষেপের মাধ্যমেই সিমেন্টে শিল্পের এসব সমস্যার সমাধান সম্ভব বলে মনে করছেন তারা। অন্যথায় এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে সিমেন্টের মূল্যের ওপর, যা দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে বাধার সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে করেন সিমেন্ট শিল্প মালিকেরা।
মঙ্গলবার (১৩ ডিসেম্বর) রাজধানীর হোটেল আমারিতে বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএমএ) আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সিমেন্ট উৎপাদনের জন্য প্রধান কাঁচামালগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। সিমেন্ট শিল্পের কাঁচামাল লাইমস্টোনের ওপর আকস্মিক ৩০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক ও ৩ শতাংশ অগ্রিম আয়করের সঙ্গে আরও ২ শতাংশ অতিরিক্ত অগ্রিম আয়কর আরোপ করা হয়েছে। পাশাপাশি লাইমস্টোন আমদানিতে আগে থেকেই ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর ও ৩ শতাংশ অগ্রিম কর বিদ্যমান রয়েছে। লাইমস্টোনের ওপর আকস্মিক সম্পূরক শুল্ক ধার্যের কারণে এ খাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
অনুষ্ঠানে লিখিত বক্তব্য তুলে ধরেন বিসিএমএ সভাপতি ও ক্রাউন সিমেন্টের ভাইস-চেয়ারম্যান মো. আলমগীর কবির। তিনি বলেন, আড়াই দশক পূর্বে সিমেন্টের প্রায় সম্পূর্ণ চাহিদা আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হতো। কিন্তু গত আড়াই দশকে উদ্যোক্তাদের সাহসী পদক্ষেপ ও সরকারের নীতি সহায়তার কারণে সিমেন্ট শিল্প একটি বিকাশমান শিল্প ও তুলনামূলক সুসংগঠিত খাত হিসেবে বিবেচিত হতো। দেশের চাহিদা মিটিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিদেশেও সিমেন্ট রপ্তানি করে আসছে।
তিনি বলেন, বর্তমানে দেশে প্রায় ৩৫টি দেশি ও বিদেশি প্রতিষ্ঠান সিমেন্ট উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। এর বার্ষিক কার্যকরী উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৭৯ মিলিয়ন টন। যার বিপরীতে চাহিদা রয়েছে প্রায় ৩৯ মিলিয়ন টন। চাহিদার তুলনায় প্রায় দ্বিগুণের বেশি উৎপাদন ক্ষমতা থাকার কারণে বাজারে তীব্র প্রতিযোগিতা রয়েছে। প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে নামমাত্র মূল্যে সিমেন্ট বিক্রি করতে হয়। এতে আর্থিকভাবে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।এই অতিরিক্ত শুল্কায়নের ফলে বর্তমানে আমদানি মূল্যের ওপর প্রায় ২৭ শতাংশের পরিবর্তে প্রায় ৬৭ শতাংশ শুল্ক ও কর পরিশোধ করে লাইমস্টোন ছাড় করাতে হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন,এই অতিরিক্ত শুল্কায়নের ফলে বর্তমানে আমদানি মূল্যের ওপর প্রায় ২৭ শতাংশের পরিবর্তে প্রায় ৬৭ শতাংশ শুল্ক ও কর পরিশোধ করে লাইমস্টোন ছাড় করাতে হচ্ছে।সিমেন্ট উৎপাদনের জন্য প্রধান কাঁচামাল হলো ক্লিংকার, স্লাগ, লাইমস্টোন, ফ্লাই অ্যাশ এবং জিপসাম। এই পাঁচ প্রকার কাঁচামালই বিদেশ হতে আমদানি করতে হয়। এখানে আরো উল্লেখ করা যায় যে, বিএসটিআই এবং ইউরোপিয়ান নর্মস অনুযায়ী সিমেন্ট উৎপাদনের জন্য সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত লাইমস্টোন ব্যবহারযোগ্য। লাইমস্টোনের আমদানি মূল্য অন্যান্য কাঁচামালের আমদানি মূল্যের তুলনায় সবচেয়ে কম। সেইভাবে লাইমস্টোন একটি সিমেন্ট উৎপাদনের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ী কাঁচামাল, তাই এই অতিরিক্ত শুল্কায়নের ফলে, সিমেন্ট উৎপাদনকারীরা লাইমস্টোন আমদানি করতে নিরুৎসাহিত হবেন বলে ধারণা হচ্ছে। যার ফলে বর্তমান ডলার সংকটের ওপর অতিরিক্ত চাপ বাড়বে, যা কোনভাবেই কাম্য নয়।
বিসিএমএ প্রেসিডেন্ট বলেন, আমদানি পর্যায় ছাড়াও বিক্রয় পর্যায়েও ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর ধার্য করা আছে। অর্থাৎ একটি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান লোকসান করলেও তাকে চূড়ান্ত কর দায় হিসেবে এই অগ্রিম আয়কর পরিশোধ করতে হবে যা কোনো বিবেচনায়ই গ্রহণযোগ্য নয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে সিমেন্ট শিল্পের জন্য অগ্রিম আয়করের কারণে দুরবস্থার বিষয়টি আমরা সিমেন্ট উৎপাদনকারীরা পূর্বে বহুবার তুলে ধরেছি। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল বিষয়টি যথাযথ গুরুত্ব দিচ্ছে না, ফলে দেশের একটি উদীয়মান শিল্প খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা আশা করছি সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল বিষয়টি বিবেচনায় নেবেন এবং অগ্রিম আয়কর আমদানি ও বিক্রয় উভয় পর্যায়ে সর্বোচ্চ ০ দশমিক ৫০ শতাংশ ধার্য করবেন এবং চূড়ান্ত কর দায় হতে মুক্ত করবেন।
অন্যান্য বক্তারা বলেন, ডলার সংকটের কারণে সিমেন্টের কাঁচামাল আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এর ফলে নতুন করে এলসি খুলতে গিয়েও বর্তমানে বিরাট বাধার সম্মুখীন হচ্ছে সিমেন্ট খাতের শিল্প মালিকরা। লোডশেডিংয়ের কারণে উৎপাদন বিঘ্ন হচ্ছে। একই সঙ্গে গ্যাস সংকটের কারণে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে সিমেন্টের স্থানীয় পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এছাড়া সিমেন্ট রপ্তানির ওপর নগদ প্রণোদনার ব্যবস্থা না থাকাতেও এই শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
তারা আরও বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার যদি এই খাতটিকে অগ্রাধিকার খাত হিসেবে ঘোষণা করে, ব্যাংকসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর সমূহকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেয়, তাহলে সিমেন্ট উৎপাদনকারীদের এই দুরবস্থা কিছুটা হলেও কমবে এবং দেশের সিমেন্ট শিল্প প্রসারিত হবে।
আই এইচ