রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, জাতীয় জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ অতিক্রম করছি আমরা। ২০২২ সাল আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং একটি বছর ছিল। সমগ্র বিশ্বই পার করছে এ কঠিন সময়।
বৃহস্পতিবার (৫ জানুয়ারি) জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে দেওয়া বক্তব্যে এ কথা বলেন তিনি। সংবিধান অনুযায়ী বছরের প্রথম অধিবেশনে রাষ্ট্রপতি ভাষণ দেন। এর আগে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদ অধিবেশন শুরু হয়।
সময় সাশ্রয়ের জন্য সংক্ষিপ্ত ভাষণে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ বলেন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবিসংবাদিত নেতৃত্বে একটি রক্তক্ষয়ী জনযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করেছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। স্বাধীন সার্বভৌম এ দেশে জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস এবং তাদের সকল প্রত্যাশার কেন্দ্রবিন্দু মহান জাতীয় সংসদ। আপনারা জনপ্রতিনিধি, তাই জনস্বার্থকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হবে। দেশের অগ্রযাত্রাকে বেগবান করতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর জাতির পিতার আদর্শকে ধারণ করে বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে জাতি এগিয়ে যাক ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত, আত্মমর্যাদাশীল বঙ্গবন্ধুর সমৃদ্ধ ‘সোনার বাংলা’ গড়ার পথে। আপনাদের সবাইকে আবারও আন্তরিক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা।
জাতীয় জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ অতিবাহিত করার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২০২২ সাল আমাদের জন্য ছিল চ্যালেঞ্জের একটি বছর। সমগ্র বিশ্বই পার করছে এক কঠিন সময়। করোনা অতিমারি আমরা সফলভাবে মোকাবিলা করে অর্থনীতির গতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম হলেও রাশিয়া এবং ইউক্রেনের যুদ্ধ আমাদের এই অগ্রযাত্রাকে শ্লথ করেছে। তারপরও ২০২১-২২ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাজেট ১৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৬ লক্ষ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
রাষ্ট্রপতি বলেন, ২০২১-২২ অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক দুই-পাঁচ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা সামগ্রিক বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ইতিবাচক। মাথাপিছু জাতীয় আয় পূর্ববর্তী অর্থবছর থেকে ২৩৩ মার্কিন ডলার বৃদ্ধি পেয়ে ২ হাজার আটশ চব্বিশ মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় ২০২১-২২ অর্থবছরে রফতানি আয় বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৬০ দশমিক নয় সাত বিলিয়ন ডলার এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ ৩ দশমিক চার-চার বিলিয়ন ডলারে।
তিনি বলেন, করোনার অভিঘাত মোকাবিলায় বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজের কার্যকর বাস্তবায়নের ফলে আমাদের অর্থনীতিতে গতিশীলতা ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে। সরকার ঘোষিত ১ লক্ষ ৮৭ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকার কৃষি, গার্মেন্টসসহ ২৮টি প্রণোদনা প্যাকেজের সরাসরি উপকারভোগী প্রায় ৭ কোটি ৩২ লক্ষ ব্যক্তি ও প্রায় ২ লক্ষ প্রতিষ্ঠান। সরকার কর্তৃক কৃষি উৎপাদনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে বিগত অর্থবছরে মোট ১৫ হাজার ১৭২ দশমিক সাত-নয় কোটি টাকা ভরতুকি এবং ৩৯ হাজার কোটি টাকা সরল সুদে কৃষিঋণ বিতরণ করা হয়েছে। বিশেষ প্রণোদনার আওতায় কৃষকদের মধ্যে ৫০০ কোটি টাকার বীজ, সার এবং কীটনাশক বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে।
আব্দুল হামিদ বলেন, হর্টিকালচার, মৎস্য চাষ, পোল্ট্রি, ডেইরি ও প্রাণিসম্পদ খাতে পর্যাপ্ত ঋণ প্রবাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিশেষ প্রণোদনামূলক পুনঃঅর্থায়ন স্কিমের আওতায় এ পর্যন্ত ১ লক্ষ ৮৭ হাজারের অধিক সুবিধাভোগীর অনুকূলে স্বল্প সুদে প্রায় ২ হাজার ৭৮৬ কোটি টাকার বেশি ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় মাছ ধরা বন্ধকালীন ২০২১-২২ অর্থবছরে ১২ লক্ষ ৪৫ হাজারের অধিক জেলে পরিবারকে প্রায় ৯৬ হাজার ৫৫০ মেট্রিক টনের অধিক খাদ্যশস্য ভিজিএফ হিসাবে প্রদান করা হয়েছে। পাশাপাশি ৮ লক্ষের অধিক মৎস্য চাষি/খামারিকে প্রায় ৯০৩ কোটি টাকা নগদ এবং উৎপাদন উপকরণ সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।
তিনি বলেন, আমাদের অর্থনীতিতে বস্ত্র ও পাট খাতের অবদান গুরুত্বপূর্ণ। পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে ১ দশমিক এক-তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং তৈরি পোশাকখাত থেকে ৪২ দশমিক ছয়-এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়েছে। বাংলাদেশের সোনালী ঐতিহ্য মসলিনের সুতা তৈরির প্রযুক্তি ও ঢাকাই মসলিন পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।
রাষ্ট্রপতি বলেন, সরকার ‘শেখ হাসিনার বাংলাদেশ, ক্ষুধা হবে নিরুদ্দেশ’-স্লোগান নিয়ে ‘খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি’র আওতায় ৫০ লক্ষ ১০ হাজারের অধিক নিম্নআয়ের পরিবারকে ১৫ টাকা কেজি দরে মাসে ৩০ কেজি চাল এবং ২৪ টাকা দরে ৫ কেজি আটা বিতরণ করছে। খোলা বাজারে খাদ্য বিক্রয় (ওএমএস) চালু আছে দেশের সকল উল্লেখযোগ্য হাট-বাজারে। এছাড়া, সরকার টিসিবি’র মাধ্যমে এক কোটি পরিবারকে সাশ্রয়ীমূল্যে সয়াবিন তেল, চিনি ও মসুর ডাল সরবরাহ করছে।
তিনি বলেন, এখন প্রত্যন্ত গ্রামেও একজন দিনমজুরের বেতন দিনে কমপক্ষে ৭০০ টাকা। একইসঙ্গে বেড়েছে জাতীয় উৎপাদন। বৈশ্বিক অর্থনীতির অস্থিতিশীলতা সত্ত্বেও দেশের খাদ্য নিরাপত্তা সুরক্ষিত রয়েছে এবং বর্তমানে দেশে খাদ্যশস্য মজুদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ দশমিক এক-চার লক্ষ মেট্রিক টন, যা সন্তোষজনক। এছাড়াও, এবারে দেশব্যাপী আমন ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে।
অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন জোরদার করার লক্ষ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাসে প্রতিবছর সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির বাজেট বৃদ্ধি করা হচ্ছে যার পরিমাণ ১ লক্ষ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা। বর্তমানে বয়স্ক ভাতাভোগীর সংখ্যা প্রায় ৫৭ লক্ষ, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীত নারী ভাতাভোগীর সংখ্যা প্রায় ২৫ লক্ষ, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা উপবৃত্তির উপকারভোগীর সংখ্যা ১ লক্ষ এবং প্রতিবন্ধী ভাতাভোগীর সংখ্যা প্রায় ২৪ লক্ষ জন।
বিগত অর্থবছরে ভিজিডি চক্রে সারাদেশে ১০ লক্ষ ৪০ হাজার উপকারভোগীকে প্রতি মাসে খাদ্য সহায়তার পাশাপাশি প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচির উপকারভোগী ১২ লক্ষ ৫৪ হাজার জনকে মাসিক ৮০০ টাকা হারে ভাতা প্রদান করা হয়েছে। সরকার
২০২২-২৩ অর্থবছর থেকে ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে দেশের সকল নাগরিকের জন্য পেনশন ব্যবস্থা চালুর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
এএ