আউশ ধান চেনেন? মোটা লাল চালের ভাত?
ভাতের মাড় চেনেন? ফ্যান?
বড় খালা তখন বেঁচে। আমার বয়স কত? সাত কি আট।
সারাদিন বড় খালাদের বাড়িতে থাকতাম, বড় খালার শ্বাশুরী টিপ্পনী কেটে বলতেন, 'লজিং মাস্টার।' বড় খালা উঠানের পাশে খোলা রান্নাঘরে রান্না করছেন। চুলোর হাড়িতে টগবগ করে ফুটছে ভাত। লাল চালের মোটা ভাত। ঘন আঠার মতো ভাতের মাড়। আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। অপলক। বড় খালা হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, 'কি রে? খাবি?'
আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে ডানে-বায়ে মাথা নাড়লাম, না। কিন্তু পলকের জন্যও সেই ভাতের হাড়িতে টগবগ করে ফোঁটা ভাতের মাড় থেকে চোখ ফেরাতে পারলাম না। বড় খালা আবার বললেন, 'খা, একটু খা, আউশ ধানের চাউলের ফ্যান, স্বাদ জিহ্বায় লাইগা থাকে'।
আমি আবারও কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম। তারপর সন্তর্পণে এদিক সেদিক তাকালাম, 'কেউ নেইতো!'
না নেই। কেউ দেখবে না। বাড়িতে বসে ভাত রান্না শেষে সেকালে আমরা হরহামেশা একমুঠি গরম ভাতের সাথে ঘন আঠার মতন আউশ ধানের ভাতের মাড় মিশিয়ে লবণ মরিচ দিয়ে গপাগপ গিলতে থাকতাম। আমরা মানে আমরা সবাই। গ্রামের বেশীরভাগ মানুষই। তাতে একবেলার ভাত যেমন বেঁচে যেত, অমৃতের স্বাদও পাওয়া যেত! আহ!
কিন্তু বড় খালার বাড়িতেতো আমি মেহমান। কারো বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে 'ফ্যান' খাওয়াটা নিশ্চিতভাবেই ঠিক না। আম্মা শুনলে ভীষণ রাগ করবেন, কিন্তু কি করবো? জিভের ডগায় জল চলে এলো যে! সেই জল যেকোন সময় টুক করে ঝড়ে পড়বে। বড় খালা সেটা দেখে ফেললে মহা কেলেঙ্কারি! তারচেয়ে বরং 'হ্যা' বলে দেয়াই ভাল। ইশ! কি ঘন মাড়! আর বড় খালাইতো সাধছেন!
আমার কি দোষ?
আমি আবারও এদিক সেদিক দেখে নিয়ে বড় খালার দিকে তাকালাম, বড় খালা হাসছেন। আমি উপর নিচ মাথা নাড়লাম, 'খামু'।
বড় খালা হঠাৎ অট্টহাসিতে ভেঙ্গে পরলেন, 'ওই ছ্যারা, বেড়াইতে গিয়া কেউ ফ্যান খাইতে চায় হ্যা? এই হইলো আদব কায়দা, না? দাড়া, তোর মা'রে কইতাছি'।
আমি প্রবল ভয় এবং দ্বিধা নিয়ে করুণ মুখে বড় খালার দিকে তাকিয়ে রইলাম, 'আফনেইতো সাধলেন'।
- 'আমি সাধলেই মেহমান মানুষ ফ্যান খাইতে চাইবি? মাইনষে দ্যাখলে কি কইব?'
আমি কথা বললাম না। চুপ করে বসে থাকলাম। বড় খালা প্রবল মমতা মাখা মুখভর্তি হাসি নিয়ে ঘরে গেলেন, মাটির সানকি নিয়ে ফিরে এসে তাতে ভাত আর মাড় মেখে দিলেন। সাথে ধনেপাতা ভর্তা। আমি গপগপ করে পেট ভরে খেলাম।
তারপরের ঘটনা আমার মনে নেই। তবে সেই আউশ ধানের ভাত আর ভাতের মাড়ের স্বাদ আমার মুখে এখনও লেগে আছে। এই যে এখনও। যেন অমৃত! পৃথিবীতে এর চেয়ে সুস্বাদু কিছু নেই।
আমি বাজী ধরে বলতে পারি!
২/
সেকালে গ্রাম গঞ্জে চুলোয় হাড়ি বসত দিনে একবার। দুপুরে। একবেলা-ই গরম ভাত। বাকী দুবেলা পানি দেয়া পান্তা ভাত। আমরা দুপুরে গরম ভাত খেতাম। গরম কাল বলে দুপুরের রান্না করা ভাত রাতে পর্যন্ত নরম হয়ে যেত। তাই সেই ভাতে পানি দিয়ে রাখা হত। সেই পানি দেয়া পান্তা খেতাম আমরা রাতের বেলা। বাকী যা কিছু থাকতো তা সকালে।
উঠোনের সামানে ছোট্ট বাগান। সেখানে পেঁয়াজ, মরিচ, রসুন, টমেটো, ঢেঁড়স, ধনে পাতা... আরও কত কি! আমরা সকাল বেলা এক বাসন পান্তা ভাত নিয়ে সেই উঠোনের পাশে বাগানে চলে যেতাম, একটা কচি পেঁয়াজ তুলে, একটা কাঁচা লংকা, তারপর রাজ্যার লবণ মেখে গপগপ গিলে ফেলতাম বাসনভর্তি পান্তা। আহ! আবারও বাজী, দুনিয়ার আর কোন খাবার এর সাথে তুল্য না।
এ অতুলনীয়! এ অমৃত!!
ঢাকা শহরে আসার পর, ফার্স্টফুড নামক খাবারের সাথে আমার পরিচয়। বার্গার, স্যান্ডউইচ, কাটলেট, পিৎজা, চাইনিজ, অমুক ফ্রাই, তমুক ফ্রাই, সাথে আইস্ক্রিম, চকোলেট... আল্লাহ্ মহান! এই কোন একটা খাবার আমার মুখে রোচে না। মুখে ঢোকালেও, চাবা আসেতো গেলা আসে না অবস্থা! যদি আসতো, নিজেকে হয়তো শহুরে বা বিশ্ব নাগরীক বলে সান্ত্বনা দিতে পারতাম! কিন্তু বিধি বাম! পারলাম না! আমি বাঙ্গালীই রয়ে গেলাম! কেমনে বদলাবো! সারা জীবন মাটির বিশুদ্ধ নির্যাস শুষে যেই জিহ্বার বেড়ে ওঠা, অমৃত আস্বাদনে যেই জিহ্বার অভ্যস্ততা!
সেই জিহ্বা এইসব ফাস্টফুড নামক ছাইপাঁশে কিভাবে ভুলবে!!
৩/ ইলিশ ভাজা হয়েছে কারো বাড়িতে।
সেই বাড়ির আধ কিলোমিটার দূর দিয়ে হেঁটে যেতেও হঠাৎ নাকের ভেতর, মাথার ভেতর, বুকের ভেতর ম ম সুবাসে ঝড় তুলে দিল সবগুলো ইন্দ্রিয়। আহা! সেই ইলিশের ভাজা মাছের এক কোণা ভেঙ্গে মুখে দেয়ার পর সাতদিন অবধি সেই স্বাদ জিহ্বায় লেগে থাকবে ফেবিকলের আঠার মতন। সাবান-সোডা দিয়ে ঘসে ঘসে ধুয়েও লাভ নেই ভ্রাতা। ইহা ইলিশ মৎস্য!
বাংলার ইলিশ!
বাঙ্গালীর ইলিশ!!
পরিশিষ্ট কিংবা অশিষ্টঃ
-------------------------
এই মুখের ভিতরে একখানা জিভ আছে, এই জিভখানা হচ্ছে সেই জিভ। সুতরাং কর্পোরেট জামানার খানা-খাদ্য, ২০,০০০ টাকার ইলিশ, ৮০ টাকা কেজীর সরু আতপচালের গরম ভাতে পানি দিয়ে বানানো পান্তা, ইন্ডিয়ান পেঁয়াজ এই মুখে রোচে না দাদা।
রোচে না কেবল বৈশাখ এলেই স্বাদহীন, শেকড়হীন, ঘ্রাণহীন, প্রাণহীন কর্পোরেট উৎসবকেন্দ্রীক ক্রমশই পণ্য হয়ে ওঠা ১ দিনের বাঙ্গালীয়ানাও...
ফেসবুক থেকে সংগৃহিত: সাদাত হোসাইন