রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক এএফএম রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে কুপিয়ে হত্যা করেছে র্দুবৃত্তরা। শনিবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে রাজশাহী মহানগরীর শালবাগানের বটতলা এলাকায় ওই শিক্ষকের বাসা থেকে ৫০ গজ দূরে তাকে হত্যা করা হয়।
এদিকে, অধ্যাপক এএফএম রেজাউল করিম সিদ্দিকী হত্যাকা-ের প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি হত্যাকা-ের প্রতিবাদে দুপুর ১২টায় সিনেট ভবনের সামনে সমাবেশ করে। সমাবেশ থেকে আগামীকাল রবিবার ক্লাস বর্জন ও সকাল ১০টায় প্রতিবাদ র্যালীর ঘোষণা দেওয়া হয়। পরবর্তী কর্মসূচি আজ সন্ধ্যায় শিক্ষক সমিতির জরুরি সভায় নির্ধারণ করা হবে বলে জানানো হয়। এছাড়াও শিক্ষক হত্যাকা-ের প্রতিবাদে বিভিন্ন সংগঠন নিন্দা জানিয়েছে।
বোয়ালিয়া থানার ওসি শাহদাত হোসেন বলেন, ঘটনাস্থল থেকে ৫০ গজ দূরে অধ্যাপক রেজাউলের বাড়ি। তাকে হত্যার কারণ তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। কোনো জঙ্গি সংগঠন এ হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তিনি আরও জানান, হত্যাকা-ের পরই প্রতিবেশীরা মোটরসাইকেলের শব্দ শুনেছেন। ওই মোটরসাইকেলে ২ থেকে ৩ জন যুবক ছিলো বলে ধারণা করছেন তারা। খুনিরা অধ্যাপক সিদ্দিকীকে হত্যার পর মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যায়।
নিহত রেজাউল করিমের ভাই ও নাটোরের সিংড়া থানার শিক্ষা কর্মকর্তা সাজিদুল করিম সিদ্দিকী বলেন, সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭টা ৪০ মিনিটের বাস ধরতে রেজাউল করিম বাসা থেকে বের হন। কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর আগেই বাসা থেকে একটু দূরে আরেকটি বাসার মেইন গেটের সামনে তার গলা কাটা লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। ভাই রেজাউল করিমসহ তারা ২৬১ শালবাগান (সপুরা) এলাকায় পৈতৃক বাড়িতে একসঙ্গে বাস করতেন বলেও জানান সাজিদুল করিম। তার ভাইকে কেউ কখনও কোনো ধরনের হুমকি দিয়েছিল কি না, তিনি জানেন না।
অধ্যাপক রেজাউল করিমের স্ত্রী হোসনে আরা বলেন, ‘তিনি বাসা থেকে বের হয়ে গেল। এরপর রাস্তার মধ্যে খুন হলো। তাকে কে বা কারা খুন করলো? তার তো কোনো শক্র ছিল না। কারো সঙ্গে তার কোনো ঝামেলাও ছিল না।’
অধ্যাপক রেজাউল করিম ‘কোমলগান্ধ্যা’ নামে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত একটি সাহিত্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক পত্রিকা সম্পাদন করতেন। তিনি ভালো সেতার বাদক ছিলেন। এছাড়াও তিনি ‘সুন্দরম’ ও অরণি সাংস্কৃতিক সংসদের সংগঠনের উপদেষ্টা ছিলেন।
‘সুন্দরম’ সংগঠনের সভাপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্থাপন শাখার সেকশন অফিসার হাসান রাজা বলেন,‘ তিনি একজন সংস্কৃতিমনা মানুষ ছিলেন। তিনি যে ধরনের লেখালেখি করতেন তা খুবই সাধারণ। আমরা যতটুকু জানি তার গ্রামের বাড়িতে জমিজমা নিয়ে সেখানকার কিছু লোকের সঙ্গে ঝামেলা ছিল। এ ঘটনার জেরে এ হত্যাকা- হতে পারে। তিনি আরও বলেন, রেজাউল স্যার তার গ্রামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। এ নিয়ে সেখানকার কিছু মৌলবাদী লোকের সঙ্গে তার ঝামেলা হয়েছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও সহকর্মী ড. মো. শহীদুল্লাহ্ বলেন, ‘প্রফেসর রেজাউল সিদ্দিকীর মতো একজন নিরীহ মানুষ এভাবে হত্যার শিকার হতে পারে তা ভাবা যায় না। একের পর এক শিক্ষক হত্যার পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় যেন বদ্ধভূমিতে পরিণত হয়েছে। আমরা আর কোনো শিক্ষকের লাশ দেখতে চাই না। এসময় তিনি দ্রুত এ হত্যাকা-ের বিচারের জন্য সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
তিনি আরও বলেন, যতদিন এ হত্যাকা-ের বিচার না হবে ততদিন আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাবো। আমরা শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে আজ রোববার সকাল সাড়ে ১০টায় র্যালি ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করবো। সেই সঙ্গে আজ রোববার ক্লাশ বর্জন করা হবে বলেও ঘোষণা দেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ও ইংরেজি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী তমাশ্রী দাশ বলেন, ‘ সংস্কৃতির প্রতি স্যারের ঝোঁক ছিল। তিনি নিজে মুক্ত চিন্তা করতেন এবং তার চিন্তার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের যুক্ত করার চেষ্টা করতেন। একজন মুক্ত চিন্তার মানুষ এমন নৃশংসভাবে হত্যার শিকার হবে এ ঘটনা আমাদের জন্য অত্যন্ত দুঃখের।’
এ হত্যাকা-ের বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য চৌধুরী সারওয়ার জাহান বলেন, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষককে একের পর এক হত্যা করা হচ্ছে। ড. ইউনূস, ড. তাহের, ড. শফিউলের পর সর্বশেষ ড. সিদ্দিকীকে হত্যা করা হলো। এর মাধ্যমে একদিকে বিশ্ববিদ্যালয় যেমন মেধাবী শিক্ষকদের হারাচ্ছে, অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষকদের এই নিরাপত্তাহীনতা দূর করা দরকার। এজন্য সরকাররের বিভিন্ন সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কাজ করে এর পেছনে দায়ীদের খুঁজে বের করতে হবে।’
সরেজমিন ঘটনাস্থল : সকাল ৯টার দিকে সরেজমিন হত্যাকা-স্থলে গিয়ে দেখা যায় রাজশাহী মহানগরীর শালবাগানের বটতলা এলাকায় অধ্যাপক রেজাউল সিদ্দিকীর বাড়ি থেকে ৫০ গজ দূরে একটি গলির মধ্যে দুর্বৃত্তরা তাকে গলা কেটে হত্যা করে ফেলে রেখেছে। মরদেহের আশেপাশে রক্ত। আশেপাশের লোকজন জানান, ওই শিক্ষক সকাল সাড়ে সাতটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে হেলমেট পরা দুইজন মোটরসাইকেল আরোহী তার ঘাড়ে চাপাতি দিয়ে কোপ দিয়ে পালিয়ে যায়। পুলিশ, গোয়েন্দা, র্যাব ঘটনাস্থল ঘিরে রাখে। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বোয়ালিয়া মডেল থানা পুলিশ লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের মর্গে পাঠায়।
ইংরেজি বিভাগের বিক্ষোভ : অধ্যাপক রেজাউল সিদ্দিকী হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছে ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। শনিবার বেলা সাড়ে ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ কলা ভবনের সামনে থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে। মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে সিনেট ভবনের সামনে অবস্থান নেয়। সেখানে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আব্দুলাহ আল মামুন বলেন, তিনি রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন না, সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আমরা এ হত্যাকা-ের প্রতিবাদ জানিয়ে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।
শিক্ষক সমিতির প্রতিবাদ সমাবেশ: ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক হত্যার ঘটনায় বেলা সোয়া ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। সমাবেশে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. মো. শাহ্ আজমের সঞ্চালনায় বক্তব্য দেন, শিক্ষক সমিতির সভাপতি ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শহীদুল্লাহ, ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আব্দুলাহ আল মামুন, শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. আনন্দ কুমার সাহা, সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মোহা. রেজাউল করিম, আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. হাসিবুল আলম প্রধান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এএইচএম মোস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ।
প্রগতিশীল ছাত্রজোটের বিক্ষোভ : এদিকে এ হত্যাকা-ের প্রতিবাদে বেলা সাড়ে ১১টায় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করেছে প্রগতিশীল ছাত্রজোট। মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ কলা ভবনের সামনে থেকে শুরু হয়ে ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে।
অধ্যাপক রেজাউল সিদ্দিকী হত্যাকা-ে ঘটনায় বিভিন্ন সংগঠনের নিন্দা : ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক হত্যার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, ছাত্র ইউনিয়ন, কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক জোট, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, রাবি শাখা ছাত্রলীগ।
অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকীর গ্রামের বাড়ি রাজশাহীর বাগমারা উপজেলায়। তার স্ত্রী হোসনে আরা শিলা গৃহবধূ। তার দুই সন্তানের মধ্যে ছেলে রিয়াসাত ইমতিয়াজ সৌরভ রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র এবং মেয়ে রেজোয়ানা হাসিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্রী। বিকেল পাঁচটায় বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়।
সানবিডি/ঢাকা/হৃদয়/এসএস