বেজা-বেপজার বিভ্রান্তি নিয়ে অভিজ্ঞতা

সানবিডি২৪ প্রকাশ: ২০২৩-০৩-২০ ২০:৩৩:৩৫


প্রায় ১ বছর হলো আমি বেজা নামক প্রতিষ্ঠানের একটি প্রকল্পে কাজ করি । প্রকল্পের নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগর উন্নয়ন প্রকল্প যেটি মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল নামেও সমধিক পরিচিত। প্রকল্প পরিচালনায় বিস্তর অভিজ্ঞতা লাভের পাশাপাশি দেশের উন্নয়নের সাথে সরাসরি কাজ করার অবারিত সুযোগ এই প্রতিষ্ঠানে রয়েছে বলে মনে করি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগর উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যতিক্রম কিছু অভিজ্ঞতা নিয়ে অন্য একদিন আলোকপাত করবো।

আজকে যে বিষয়ের জন্য এই লেখা, সেটি হচ্ছে বেজা ও বেপজা শব্দের মধ্যে সাধারণের বিভ্রান্তি নিয়ে। বেজায় যোগদানের পর থেকেই প্রতিষ্ঠানের পরিচিতি নিয়ে এক ধরণের আইডেন্টিটি ক্রাইসিসের সম্মুখীন হয়েছি এবং এখনও হচ্ছি। স্বাভাবিকভাবেই শুভাকাঙ্খীদের অনেকেই প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে জানতে চায়, আমার বর্তমান পোস্টিং কোথায়? প্রতিত্তোরে যখনই বেজার কথা বলেছি, অসংখ্যবার ওপাশ থেকে শুনেছি – ও ~ বেপজা। শুধু তাই নয়, বেজার অনেক স্টেকহোল্ডাররা ভুল করে বেপজা অফিসেও চলে যেতে দেখেছি। বেজার মতো একটি উদীয়মান প্রতিষ্ঠান যেটি সমগ্র বাংলাদেশে শক্তভাবে ডাল-পালা ছড়াচ্ছে তাকে চেনাতে প্রায়ঃশ ঘাম ঝরাতে হয়। অবশ্য এক অর্থে বিষয়টি স্বাভাবিক। কারণ বেজার বর্তমান বয়স মাত্র ৯ বছর। অন্যদিকে, বেপজার বয়স ইতোমধ্যে ৪০ বছর অতিক্রম করেছে। আর তাছাড়া দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখায় বেপজা নামটি দেশ ও দেশের বাইরে দারুনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।

যাই হোক, একই রকম শুনতে প্রতিষ্ঠান দুটির বিষয়ে কিছুটা স্পষ্টীকরণের উদ্দেশ্যে সাধারণ কিছু তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করছি-

১। নামের পূর্ণরূপ ও অর্থ-

বেজাঃ বাংলাদেশ ইকোনোমিক জোনস অথরিটি যার বাংলা বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ
বেপজা: বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনস অথরিটি(বেপজা) এর বাংলা বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ- সম্পূর্ণরূপে আলাদা দুটি প্রতিষ্ঠান।

২। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য-

বেজাঃ শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান, উত্‍পাদন এবং রপ্তানী বৃদ্ধি ও বহুমুখীকরণে উৎসাহ প্রদানের লক্ষ্যে পশ্চাত্পদ ও অনগ্রসর এলাকাসহ সম্ভাবনাময় সকল এলাকায় অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করাই হলো বেজার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।

বেপজাঃ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ইপিজেড স্থাপনপূর্বক দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আনয়ন, বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রপ্তানি বৃদ্ধির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং প্রযুক্তি আহরণের মাধ্যমে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা পালন করাই হলো বেপজার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।

২। উভয়ের মাঝে সাধারণ মিলসমূহ-

ক) উভয়ই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা
খ) আইনি কাঠামো প্রায় এক। গভর্নিং বোর্ডের চেয়ারম্যান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং নির্বাহী বোর্ডের চেয়ারম্যান নির্বাহী চেয়ারম্যান যিনি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়ে থাকেন।
গ) উদ্দেশ্যঃ শিল্পায়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন

৩। মোটা দাগে মৌলিক অমিল সমূহ-

ক) বেপজার আওতাধীন ইপিজেডসমূহ শতভাগ রপ্তানিমুখী শিল্পে বিনিয়োগের জন্য বিশেষ অঞ্চল অর্থাৎ এখানে শুধু বিদেশে রপ্তানির জন্য পণ্য উৎপাদিত হয়। অন্যদিকে বেজা সকল ধরণের শিল্প (আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ, উৎপাদন, ট্যুরিজম ইত্যাদি ) বিকাশে তথা আধুনিক ও সমন্বিত শিল্প নগর স্থাপনে দায়িত্বপ্রাপ্ত যার এক একটিকে অর্থনৈতিক অঞ্চল বলে। বেজার আওতাধীন অর্থনৈতিক অঞ্চলে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় বাজারের জন্য পণ্য উৎপাদিত হয়।
খ) বেপজার এক একটি অঞ্চলকে বলে ইপিজেড বা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড=এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন)। অন্যদিকে বেজার এক একটি অঞ্চলকে বলে ইজেড বা অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইজেড=ইকোনোমিক জোন)।
গ) ১৯৮৩ সালে বেপজার কার্যক্রম শুরু (আইন ১৯৮০ সালে) হওয়ার পর থেকে মোট ৮টি ইপিজেড স্থাপিত হয়, যেমন- চট্টগ্রাম ইপিজেড, ঢাকা ইপিজেড, আদমজি ইপিজেড ইত্যাদি। অন্যদিকে, ১০০ টি অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইজেড) স্থাপনের উদ্দেশ্যে ২০১৩ সালে (আইন ২০১০ সালে) বেজার কার্যক্রম শুরু হয়। বেজার মূলত চার ধরণের অর্থনৈতিক অঞ্চল রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগর (সরকারি), মেঘনা অর্থনৈতিক অঞ্চল (বেসরকারি), জাপানিজ অর্থনৈতিক অঞ্চল (জিটুজি), মংলা অর্থনৈতিক অঞ্চল (পিপিপি বা সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব)। এছাড়া বিশেষ ধরণের স্পেশাল ট্যুরিজম পার্ক যেমন সাবরাং, সোনাদিয়া ইত্যাদি রয়েছে।
ঘ) গত ৪০ বছরে বেপজার অধীন জায়গা আনুমানিক ৩০০০ একর (মিরসরাই এ নির্মাণাধীন বেপজা ইপিজেড সহ) । অন্যদিকে মাত্র ৯ বছরে বেজার অধীন জায়গা এসেছে ১ লাখ একরের উপরে।
ঙ) বেজার প্রধান অফিস ঢাকার আগারগাঁও এ বিনিয়োগ ভবনে আর বেপজার প্রধান অফিস ঢাকার গ্রীন রোডে বেপজা ভবনে।
চ) বেজার মূল স্লোগান সমৃদ্ধ শিল্প, উন্নত বাংলাদেশ। আর বেপজার সুনির্দিষ্ট কোন স্লোগান নেই, তবে কোথাও কোথাও শ্রমিক-মালিক ব্যবস্থাপনার ঐক্যতান স্লোগানটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

পরিশেষে বলতে চাই, সরকারের নতুন করে আর কোন ইপিজেড না করার সিদ্ধান্ত থেকেই মূলত বেজার সৃষ্টি হয়েছে। কেবল রপ্তানিমুখী শিল্পে বিনিয়োগ, এই ধারণা থেকে সরে গিয়ে বিস্তৃত পরিসরে সকল ধরণের বৃহদাকার শিল্পায়ন পরিকল্পিতভাবে এক ছাতার নিচে আনাই বেজা সৃষ্টির পেছনে সরকারের মূল লক্ষ্য। আর দুঃখের বিষয়, সরাসরি সরকারের সাথে সম্পর্কিত এবং সেই সাথে ব্যবসার সাথে জড়িত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গও এই দুটি প্রতিষ্ঠানকে গুলিয়ে ফেলেন। প্রায় একই ধরণের দুটি প্রতিষ্ঠান কখনও একীভূত হবে কি না সেটি সময় ও সরকারের সিদ্ধান্ত, অন্তত ততদিন পর্যন্ত যেন বেজা ও বেপজা এবং ইকোনোমিক জোনস ও এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনস এর পার্থক্য বোঝার ও প্রয়োগের চেষ্টা করি। ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে সঠিক বিনিয়োগ ও শিল্পায়নের সুষ্ঠু বিকাশের জন্য এর আবশ্যকতা রয়েছে।

মোঃ আজিজুর রহমান
সহকারি প্রকল্প পরিচালক (সিনিয়র সহকারি সচিব)
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগর উন্নয়ন প্রকল্প
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়

আই এইচ