সাপ্তাহিক ‘বেগম’ পত্রিকার সম্পাদক নূরজাহান বেগম ইন্তেকাল করেছেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে সোমবার (২৩ মে) সকাল সাড়ে ৮টায় তিনি মারা যান। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯১ বছর।
নূরজাহান বেগমের ঘনিষ্ঠ দিল মনোয়ারা মনু নূরজাহানের মৃত্যুর সংবাদ নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, গত ৫ মে নূরজাহান বেগমকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে ৭ মে তাকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ‘লাইফ সাপোর্টে’ রাখা হয়। আজ (সোমবার) সকাল সাড়ে ৮টার দিকে তিনি মারা যান।
জানা গেছে, নূরজাহান বেগম ফুসফুসজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন।
নূরজাহান বেগমের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন শোক প্রকাশ করেছেন।
এক নজরে নূরজাহান বেগম
বাংলাদেশে নারী সাংবাদিকতার অগ্রদূত নূরজাহান বেগম চাঁদপুর জেলারচালিতাতলী গ্রামে ১৯২৫ সালের ৪ জুন জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সওগাত পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিনের কন্যা। তিনি ভারত উপমহাদেশের প্রথম নারী সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘বেগম’ পত্রিকার সূচনালগ্ন থেকে এর সম্পাদনার কাজে জড়িত এবং ছয় দশক ধরে বেগম পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। তার ডাক নাম নূরী। নূরজাহান বেগমের মা’র নাম ফাতেমা বেগম। গ্রামে থাকার সময়ে নূরজাহান বেগম খালের পানিতে পড়ে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটান। তাই তার পরিবার গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯২৯ সালে সাড়ে তিন বছর বয়সে মা আর মামা ইয়াকুব আলী শেখের সঙ্গে তিনি কলকাতায় বাবার বাসায় চলে যান, যা ছিলো কলকাতার ১১ নম্বর ওয়েলেসলি স্ট্রিটের দোতলা বাড়ি এবং সওগাত পত্রিকার দপ্তর। সওগাত পত্রিকা অফিসে নিয়মিত সাহিত্য মজলিস বসত, যেখানে যোগ দিতেন কাজী নজরুল ইসলাম, খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দীন,আবুল মনসুর আহমদ,আবুল কালাম শামসুদ্দিন, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, হবীবুল্লাহ বাহার,ইব্রাহীম খাঁ,কাজী মোতাহার হোসেন প্রমুখ৷ এই সাহিত্য মজলিসের নিয়মিত শ্রোতা ছিলেন নূরজাহান। তার প্রথম স্কুল সাখাওয়াত মেমোরিয়াল বিদ্যালয়। সেখানে তিনি শিশু শ্রেণিতে ভর্তি হন।
শিক্ষা জীবন
নূরজাহান বেগমের প্রথম স্কুল ছিল সাখাওয়াত মেমোরিয়াল বিদ্যালয়। তার দ্বিতীয় স্কুল বেলতলা উচ্চ যেখানে তিনি দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন। এখানে তিনি চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর পঞ্চম শ্রেণিতে আবার আগের বিদ্যালয় সাখাওয়াত মেমোরিয়াল বিদ্যালয় ভর্তি হন, যা অবস্থিত ছিল ১৭ নং লর্ড সিনহা রোডের তিনতলা ভবনে। অষ্টম শ্রেণি থেকে ম্যাট্রিক পর্যন্ত তিনি ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশুনা করে ১৯৪২ সালে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। তারপর আইএ ভর্তি হন কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ণ কলেজে। তার আইএ-তে পড়ার বিষয় ছিল দর্শন, ইতিহাস ও ভূগোল। এখানে তার সহপাঠী ছিল সাবেরা আহসান ডলি, রোকেয়া রহমান কবির, সেবতি সরকার, জ্যোত্স্না দাশগুপ্ত, বিজলি নাগ, কামেলা খান মজলিশ, হোসনে আরা রশীদ, হাজেরা মাহমুদ,জাহানারা ইমাম। পড়াশুনার পাশাপাশি তিনি কলেজে ব্যাডমিন্টন খেলতেন। লেডি ব্রেবোর্ণ থেকে ১৯৪৪ সালে আইএ পাশ করে বিএ-তে ভর্তি হন। এই কলেজ থেকে তিনি ১৯৪৬ সালে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন।
বেগম পত্রিকা
বেগম পত্রিকার প্রকাশনা শুরু হয় ১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই, যখন নূরজাহান বেগম বিএ শ্রেণিতে পড়তেন। তার বাবা নাসিরুদ্দীন প্রতিষ্ঠিত বেগম পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন সুফিয়া কামাল। প্রথম চার মাস সম্পাদক হিসেবে এর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। নূরজাহান বেগমের মতো যারা সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল ও লেডি বেবোর্ন কলেজে পড়তেন তারা সবাই মিলে বেগম-এর জন্য কাজ করতেন। বেগমের শুরু থেকে নূরজাহান বেগম ছিলেন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। তিনি বিয়ে করেন রোকনুজ্জামান খান(দাদা ভাই) কে। ১৯৫০ সালে তারা বাংলাদেশে চলে আসেন। ঢাকায় এসে নারীদের ছবি আঁকতে, লেখার জন্য উৎসাহী দিতেন নূরজাহান বেগম, যাতে তাদের অংশগ্রহণ বাড়ে। যারা লেখা পাঠাত, তাদের ছবিও ছাপাতেন বেগম পত্রিকা। প্রথমদিকে পুরুষরাও এতে লিখতেন। তবে এখন এতে শুধুমাত্র নারীরাই লিখে থাকেন। ১৯৫৪ সালে মার্কিন মহিলা সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও সমাজকর্মী মিসেস আইদা আলসেথ ঢাকায় বেগম পত্রিকা অফিস পরিদর্শন করেন। ১৯৫৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে 'বেগম ক্লাব' প্রতিষ্ঠিত হয় যার প্রেসিডেন্ট হন বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ, সেক্রেটারি হন নূরজাহান বেগম এবং বেগম সুফিয়া কামাল ছিলেন এর অন্যতম উপদেষ্টা।
সম্মাননা
নূরজাহান বেগম অনেক সম্মাননা লাভ করেছেন এ পর্যন্ত। ১৯৯৬ সালে তিনি শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ত্ব হিসেবে নন্দিনী সাহিত্য ও পাঠচক্রের সন্মাননা লাভ করেন। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার থেকে রোকেয়া পদক, ১৯৯৯ সালে গেণ্ডারিয়া মহিলা সমিতি থেকে শুভেচ্ছা ক্রেস্ট, ২০০২ সালে অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার,২০০৩ ও ২০০৫ সালে নারীপক্ষ দুর্বার নেটওয়ার্ক ও কন্যা শিশু দিবস উদযাপন কমিটির পক্ষ থেকে তিনি সংবর্ধনা লাভ করেন। এছাড়াও তিনি সংবর্ধিত হয়েছেন বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ, চট্রগ্রাম লেডিজ ক্লাব, চট্রগ্রাম লেখিকা সংঘ, ঢাকা লেডিজ ক্লাব, ঋষিজ শিল্প গোষ্ঠী, বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্র প্রভৃতি সংগঠনের মাধ্যমে। স্বর্ণপদক পেয়েছেন বাংলাদেশ মহিলা সমিতি,বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, লেখিকা সংঘ, কাজী জেবুনন্নেসা মাহাবুবুল্লাহ ট্রাষ্ট, বাংলাদেশ সাংবাদিক ফোরাম,রোটারি ক্লাব প্রভৃতি সংগঠন থেকে। ২০১০ সালে পত্রিকা শিল্পে তার অবদানের জন্য আন্তর্জাতিক নারী সংগঠন ইনার হুইল ডিস্ট্রিক্ট ৩২৮ সম্মাননা পান তিনি।