বাজার চাই, বাজার বাড়াও। বাংলা ছবির জন্য এটাই এখন পাখির চোখ। বাংলাদেশের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে যৌথ প্রযোজনার পথে হাঁটা যদি তার একটা মাইলফলক হয়, অন্য আর একটা মাইলফলক ছোঁয়া হয়ে গেল শুক্রবার।
প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণা অভিনীত নতুন বাংলা ছবি ‘প্রাক্তন’ একযোগে ভারতের ২৪টি শহরে মুক্তি পেল এ দিন। শনিবার ছবিটির ওয়র্ল্ড প্রিমিয়ার আমেরিকা ও কানাডায়। একসঙ্গে লস অ্যাঞ্জেলেস, সানফ্রান্সিসকো, নিউ ইয়র্ক, নিউ জার্সি, ডালাস, সিয়াটেল এবং টরন্টোয় ছবিটি দেখানোর আয়োজন। লক্ষ্যটা খুব স্পষ্ট। শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি দর্শকের উপরে নির্ভর করে আর বাংলা ছবি বাঁচবে না। এ বার বিশ্ব বাজারে নিজের জায়গা করে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
রুটিরুজির খোঁজে আমবাঙালি বেঙ্গালুরু বা বস্টন হরবখত যায়। বাঙালি পরিচালকরা বলিউডে পাড়ি জমাচ্ছেন, এমন উদাহরণও কম নয়। এ বার কিন্তু বাংলায় বসে বাংলা ছবি তৈরি করেই বিশ্বে পাড়ি দেওয়া, বাংলা ছবির বাজারটাই বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার সংকল্প নিচ্ছেন কেউ কেউ। পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-নন্দিতা রায় তাঁদেরই অন্যতম।
স্রেফ বাংলায় পড়ে থাকলে যে ভবিষ্যৎ ঝরঝরে তা আগেই বুঝেছে টালিগঞ্জ। বাণিজ্যিক পরিধি বাড়াতে এখন বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথ প্রযোজনা শুরু হয়েছে। গৌতম ঘোষের ‘শঙ্খচিল’ দু’দেশে মুক্তি পেয়েছে এ বার পয়লা বৈশাখেই। কলকাতার বাইরে বেঙ্গালুরু, দিল্লি, মুম্বইয়ে প্রবাসী বাঙালিদের কাছে পৌঁছনোর চেষ্টাও আরম্ভ হয়েছে বেশ কিছু দিন যাবৎ। আমেরিকা, ইউরোপে বাণিজ্যিক ভাবে বাংলা ছবির প্রদর্শনও ক্বচিৎ-কদাচিৎ দেখা গিয়েছে। এ বার ‘প্রাক্তন’-এর হাত ধরে সেই চেষ্টাটাই অনেক বড় পরিসরে হচ্ছে। ইরস-এর মতো পরিবেশনা সংস্থার মস্তিষ্ক রয়েছে এর পিছনে।
লস অ্যাঞ্জেলেসের ‘ব্রিয়া সিনেমাজ’-এ ছবিটি দেখার আগে বাবলি চক্রবর্তী উৎসাহে ফুটছেন, ‘‘এর আগে মনের মানুষ, কাদম্বরী-র মতো কয়েকটি ছবি এ দেশে বসে দেখেছি বটে। কিন্তু কলকাতায় রিলিজের সঙ্গে-সঙ্গে বাংলা ছবি দেখার সুযোগ...নাহ্, মনে পড়ছে না!’’ ‘চাঁদের পাহাড়’ও আমেরিকায় দেখানো হয়েছিল। কিন্তু টালিগঞ্জের প্রযোজক-পরিচালকেরা স্বীকার করেন, বাংলা ছবি বিদেশে রিলিজের পরিকল্পনায় খামতি থেকেই যাচ্ছিল। যে-ভাবে প্রচার দরকার, তা করা হয়নি। ফলে, ওই সব ছবি প্রবাসী বাঙালিদের কাছে
সে-ভাবে পৌঁছতে পারেনি।
বহু ক্ষেত্রে ভিন রাজ্যে বাংলা ছবির প্রদর্শনও নমো-নমো করে সারাই ছিল দস্তুর। কদাচিৎ সপ্তাহান্তে হয়তো মাল্টিপ্লেক্সে শো মিলল। নয়তো, দুপুর বা বিকেলের শোয়ে কখন বাংলা ছবিটি এল আর গেল, সে-খবর খুব বেশি লোকের কানে পৌঁছয়নি। গত বছর টালিগঞ্জের মেগাহিট, অতনু রায়চৌধুরী প্রযোজিত ‘বেলাশেষে’র টিম তাদের নতুন ছবি ‘প্রাক্তন’-এর বেলায় সে-সব খামতি মাথায় রেখেই আটঘাট বেঁধে এগিয়েছে।
বলিউডি ছবির নামজাদা আন্তর্জাতিক পরিবেশক ইরস ফিল্মসের কর্তা নন্দু আহুজা সর্বত্র স্থানীয় বাঙালি ও চলচ্চিত্রামোদীদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে ছবিটি রিলিজের পরিকল্পনা করেছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘ইদানীং বাংলা ছবি কলকাতায় রিলিজের পরেই চোরাই কপি অনলাইনে অনেকে ডাউনলোড করে নেন। এই জন্যই একসঙ্গে দেশে-বিদেশে ছবিটি রিলিজ করা হচ্ছে।’’
আঞ্চলিক ছবিকে বাঁচাতে এ ছা়ড়া যে উপায় নেই, তা একবাক্যে মানছেন গোটা দেশের ট্রেড অ্যানালিস্টরাই। রঘুবেন্দ্র সিংহ, কোমল নাহাটারা টুইট করে তা জানিয়েও দিয়েছেন। তরণ আদর্শ বলছেন, ‘‘বলিউড তো বহু আগেই এই রাস্তা বেছে নিয়েছে। এ যুগে কোনও এক অঞ্চলে ছবি রিলিজ করলে তার পাইরেটেড কপি অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকেই।’’ ইতিমধ্যেই তামিল, তেলুগু, মরাঠি, পঞ্জাবি ইন্ডাস্ট্রি বিশ্বব্যাপী রিলিজের মাধ্যমে ছবির বিপণনে জোর দিচ্ছে।
তবে বাংলা ছবির ক্ষেত্রে এ শুধু বিশ্বায়নের টান বা পাইরেসির বিরুদ্ধে যুদ্ধ নয়। রিমেক ছবির বাড়বাড়ন্তে সাম্প্রতিক অতীতে মধ্যবিত্ত দর্শকদের একটা বড় অংশ বাংলা ছবি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। সেই সঙ্গে নিজেদের রাজ্যে ছবি দেখানোর পরিসরও ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। বাংলায় এখন মেরেকেটে ২০-২৫টি মাল্টিপ্লেক্স। মহারাষ্ট্র বা অন্ধ্রপ্রদেশের বিভিন্ন শহরে সেই সংখ্যাটা ১০০-র
কাছাকাছি। এ রাজ্যে সিনেমা হল-এর সংখ্যা কমতে কমতে ৩৫০-য় এসে ঠেকেছে। অন্ধ্রে হল-এর সংখ্যা, এর দশ গুণ। তা ছাড়া, মরাঠি ছবির মতো বিপুল করছাড় বা হল-এ ‘প্রাইম টাইমে’ ছবি দেখানোর সুবিধাও এ রাজ্যে সুলভ নয়। ফলে তেলুগু বা মরাঠি ছবি যেখানে অনায়াসে ২৫ কোটির শৃঙ্গ ছোঁওয়ার কথা ভাবতে পারে, বাংলা ছবির ব্যবসা দেড়-দু’কোটি কোটি ছুঁলেই তা দুর্লভ ঘটনা।
ছবির গুণমান বাড়ানোর পাশাপাশি তাই নতুন বাজার খোঁজা ছাড়া উপায় কী? যৌথ প্রযোজনা ও-পার বাংলার দরজা খুলছে। ভারতের অন্যান্য রাজ্য থেকে শুরু করে বিলেত-আমেরিকা-সহ বিভিন্ন দেশ ধরলে আরও পাঁচ-ছ’কোটি বাংলাভাষীর কাছে পৌঁছতে পারলে, বাংলা ছবি ফের বড় করে স্বপ্ন
দেখতে পারবে। নামজাদা ডিস্ট্রিবিউটরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এগোলে যে সাফল্য মিলতে পারে, প্রসেনজিৎ থেকে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় মানছেন সকলেই। কৌশিক মনে করাচ্ছেন, প্রচারটা ঠিক ভাবে হওয়া জরুরি।
ভারত ও বাংলাদেশে ছবি-বিপণনের সঙ্গে যুক্ত শুভজিৎ রায়ও শীঘ্রই ইউরোপের ফিল্ম পরিবেশক সংস্থা মমার্ত মোশন পিকচারস-এর সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে বাংলাদেশের একটি ছবি (অনিল বাগচীর একদিন) বিশ্ব জুড়ে দেখাতে উদ্যোগী হয়েছেন। লন্ডন, বার্মিংহাম, ভেনিস, বার্সেলোনা, মাদ্রিদ, তুলুস, প্যারিসে ইংরেজি-ফরাসি-স্প্যানিশ সাবটাইটেলে ছবিটি দেখানো হবে। শুভজিতের কথায়, ‘‘টালিগঞ্জের কিছু ছবিও ইউরোপে রিলিজ করানোর কথা চলছে। এ ভাবে ছবির রোজগারের একটা বাড়তি রাস্তা খুলে যাবে।’’
সানবিডি/ঢাকা/এসএস