আমাদের স্কুলে একজন বুলু ম্যাডাম ছিলেন। তিনি ছিলেন সহকারী প্রধান শিক্ষিকা। কোনো শিক্ষার্থীর সঙ্গে তাকে কোনোদিন হাসিমুখে কথা বলতে দেখিনি। তিনি আমাদের ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র ক্লাস নিতেন। ক্লাসে এসেই জিজ্ঞেস করতেন, 'কার কার পড়া হয়েছে'? তারপর বলতেন, 'যাদের পড়া হয়নি, তারা বেঞ্চের ওপর উঠে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকো'। ক্লাসে পড়া পারতো অল্প কয়েকজন। বাকিরা সুরসুর করে বেঞ্চের উপর উঠে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতো। যদিও আমাকে কখনো কানে ধরতে হয়নি, তবু কেন যেন ওদের কান ধরা দেখে আমার খুব লজ্জা লাগতো। ওদের চোখের দিকে তাকাতে পারতাম না। সোজা বইয়ে ঘাড় গুঁজে থাকতাম।
বুলু ম্যাডাম কোনোদিন কোনো শিক্ষার্থীর কাছে জানতে চাননি, 'কেন পড়া হয়নি, কোন বিষয়টা বুঝতে তোমাদের অসুবিধা?' তিনি আসতেন, পড়া ধরতেন, শাস্তি দিতেন, চলে যেতেন। একদিন ক্লাসে গিয়ে জানলাম, আমি যেটা পড়ে গেছি সেটা নয়, ম্যাডাম পড়া ধরবেন অন্য জায়গা থেকে, সেদিন কান ধরার লজ্জা থেকে বাঁচার জন্য স্কুলে ব্যাগ রেখেই পালিয়েছিলাম! স্কুলজীবনে আমি নিয়মিত স্কুল পালিয়েছি, কারণ, সেখানে আমার জন্য আনন্দজনক কিছুই থাকতো না!
আজকে যখন এপ্লাস প্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা 'আমি এ প্লাস পেয়েছি'র ইংরেজি বলছে 'আই অ্যাম এ প্লাস', তখন সেই লজ্জা ওদের না যতটুকু তার থেকে হাজারগুণ বেশি ওদের শিক্ষক ও পরিবারের। আজকালকার মা-বাবারা অস্থির হয়ে থাকেন তার সন্তানকে এ প্লাস পাইয়ে দেয়ার জন্য! কতটুকু শিখছে, কী শিখছে, আদৌ শিখছে কি না, কিছুই তারা দেখেন না! রেজাল্ট কার্ডে এ প্লাস এলেই তারা নিশ্চিন্ত! পাশের বাসার ভাবী তার বাচ্চাকে অমুকের কাছে পড়ায়, আমার বাচ্চাকেও পড়াতে হবে। অমুকের বাচ্চা অমুক স্কুলে চান্স পেয়েছে, আমার বাচ্চাকেও পেতে হবে! আল্লাহ্ ভাবী, আপনারা ছেলে এপ্লাস পায় নাই, কী লজ্জা কী লজ্জা!- এমন অসুস্থ প্রতিযোগিতা শিক্ষার্থীদেরকে এ প্লাস পাইয়ে দিচ্ছে ঠিকই, পাশাপাশি সবার কাছে হাসির পাত্রও করে তুলছে।
এ প্লাসের দৌড়ে শামিল হতে গিয়ে ছেলেমেয়েরা এখন পাঠ্যবই ছাড়া আরা কোনো বই চেনে না। ছেলেমেয়ের হাতে দামী ফোন হয়তো অনেকেই তুলে দিচ্ছেন, একটি ভালো বই শেষ কবে তুলে দিয়েছেন? ব্যবসায়িক মনোভাবের শিক্ষক, অচেতন মা-বাবা, পড়া গিলে ফেলা এবং উগড়ে দেয়া, পরীক্ষার আগের রাতে হাতে হাতে প্রশ্ন পৌঁছে যাবার পরেও কষ্ট করে পড়াশুনা করার মতো বোকা এখন খুব কম শিক্ষার্থীই আছে। আর তাই তো ভুরি ভুরি এ প্লাসধারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় পাসই করতে পারছে না! যখন শিক্ষামন্ত্রী নিজেই অসহায়ের মতো প্রশ্ন করেন, 'প্রশ্নফাঁস কীভাবে বন্ধ করবো?', তখনও কেন আমরা টের পাই না, শিক্ষার মেরুদন্ড অনেকই আগেই ভেঙে গেছে!
এই আনন্দহীন শিক্ষাব্যবস্থা, অসুস্থ প্রতিযোগিতা যতদিন বন্ধ না হবে, ততদিন নেপালের রাজধানী নেপচুন হবে, পিথাগোরাস উপন্যাস লিখবেন, ২৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস হবে, নিউটন আপেল নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করবেন, অপারেশনের সময় লাইট জ্বালানোকে 'অপারেশন সার্চ লাইট' বলা হবে এবং 'আমি এ প্লাস পেয়েছি'র ইংরেজি 'আই অ্যাম এ প্লাস' হবে। এই শিক্ষার্থীরা নিজেরা নিজেরা গড়ে তো ওঠেনি, ওদেরকে যেভাবে গড়া হয়েছে, সেভাবেই গড়ে উঠেছে। সূত্র: ফেসবুক
সানবিডি/ঢিকি/এসএস