টেকসই নগরায়নে সুশাসন ও পরিকল্পনার যথাযথ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন বিশিষ্টজনরা।
শনিবার (২ সেপ্টেম্বর) ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণ এবং বাংলাদেশের টেকসই নগরায়ন’ শীর্ষক এক সেমিনারে বক্তারা এ অভিমত ব্যক্ত করেন। তারা বলেন, প্রান্তিক পর্যায়ে অবকাঠামো উন্নয়ন, পর্যাপ্ত গণপরিবহন ব্যবস্থা এবং টেকসই অবকাঠামো উন্নয়ন ঢাকা শহরের বিকেন্দ্রীকরণ এবং বাংলাদেশের টেকসই নগারয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবেন।
ডিসিসিআই অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি ব্যারিস্টার মো. সামীর সাত্তার বলেন, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে নগরায়ন এমনভাবে গড়ে উঠেছে, যেখানে আমাদের জিডিপির ৬৫ শতাংশ আসছে শহরাঞ্চল থেকে। ঢাকা কেন্দ্রিক নগরায়নের জন্য আমরা যানজট, পানি দূষণ, বায়ু দূষণ প্রভৃতি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছি। সেই সঙ্গে আমাদের কর্মঘণ্টা নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি বাড়ছে জ্বালানি খরচ ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি। এ অবস্থায় ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণের কোনও বিকল্প নেই। পাশাপাশি নগরবাসীর জীবনমান উন্নয়নের জন্য সুচিন্তিত কর্মপরিকল্পনা নীতি গ্রহণ করা সময়ের দাবি।
দেশের প্রতিটি শহরে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় আইনগত, প্রশাসনিক, অবকাঠামো ও আর্থিক সক্ষমতা বাড়ানো, পরিকল্পিত স্যাটেলাইট শহরের বিকাশ, ঢাকার বাইরে বসবাসকারীদের জন্য ট্যাক্স হলিডে, সুলভ মূল্যে ইউটিলিটি পরিসেবা দেওয়ার পাশাপাশি আর্থিক প্রণোদনার আহ্বান জানান ব্যারিস্টার সামির সাত্তার। এছাড়া টেকসই নগরায়ন ও শহরের বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করতে সুশাসন, পরিকল্পনার যথাযথ বাস্তবায়ন ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার কোনও বিকল্প নেই বলে মত প্রকাশ করেন তিনি।
ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেন, আমাদের সবকিছু ঢাকা কেন্দ্রিক। এটা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সরকার ঢাকার বাইরেও অবকাঠমো খাতে উন্নয়ন করেছে। এর সুফল দেশবাসী শিগগিরই পাবেন।
রাজধানীর উপশহরগুলোকে আরও উপযোগী করার জন্য সরকার নিরসলভাবে কাজ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, মেট্রোরেলের অবকাঠামোর সম্প্রসারণ আরও ১০-১৫ বছর চলমান থাকবে। এতে যানজট কমবে এবং নগরবাসী উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা উপভোগ করবেন।
বর্তমান সরকার অবকাঠামো খাতের উন্নয়ন ও শিল্পায়নে জোর দেওয়ার কারণে আমাদের অর্থনীতিতে গতি এসেছে মন্তব্য করে ভূমিমন্ত্রী বলেন, ব্যবসা পরিচালন ব্যয় কমানো এবং সরকারি কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও সুশাসন নিশ্চিত করতে সরকার কাজ করছে। সিটি জরিপে কিছু ভুল দেখা গেছে, তবে ডিজিটাল সার্ভে গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা আগামী কয়েক বছরের মধ্যে সম্পন্ন হলে দেশবাসী আধুনিক সেবা গ্রহণ করতে পারবেন।
সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেন, তিন ফসলি জমিতে কোনও শিল্প-কারাখানা নয়, কারণ আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে দুফসলি জমিতেও শিল্প কারখানা স্থাপন না করার জন্য উদ্যোক্তাদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। কৃষিভিত্তিক শিল্প-কারখানায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ওপর জোরা দেন মন্ত্রী।
ইকোনোমিক জোনের আশেপাশের জায়গায় শ্রমিকদের বাসস্থান তৈরিতে সরকার কাজ করছে জানিয়ে কাজী ওয়াছি উদ্দিন বলেন, ড্যাপের পুরোপুরি সংশোধন না করে, ব্যবসায়ীদের যেন হয়রানি না করা হয়, সে বিষয়ে মন্ত্রণালয় কাজ করছে। ফ্ল্যাট ও জমি রেজিস্ট্রেশনে করারোপের কারণে জমি ও ফ্ল্যাট বিক্রি বেশ কমে গেছে। তবে বিষয়টি নিয়ে এনবিআর কাজ করছে। আশাকরি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। গ্রাম উন্নয়নে শুধু প্রকল্প গ্রহণ করলেই হবে না, জীবনযাপনে সব প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতের পাশাপাশি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিস্তার ঘটাতে হবে।
তিনি বলেন, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ কৃষি জমি সুরক্ষা নিশ্চিত করার বিকল্প নেই।
ড. ফারহিনা আহমেদ বলেন, নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতের পাশাপাশি আগামী প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর নগর নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের ব্যবহৃত প্লাস্টিক বর্জ্য দেশের জলবায়ু, নদী দূষণ করছে। এর প্রতি আরও মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। অবকাঠমো উন্নয়নে মান নিশ্চিত করতে হবে, যেন এর মাধ্যমে পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত হয়।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সহ-সভাপতি ইকবাল হাবিব। তিনি বলেন, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৩৩ শতাংশ লোক নগরে বাস করেন। ঢাকা মহানগরীতে প্রতি বছর নতুন করে ৫ লাখ লোক যোগ হচ্ছে। অপরিকল্পিত নগরায়নের জন্য প্রতিনিয়ত গৃহহীন জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বর্জ্য বৃদ্ধি, পানি ও বায়ু দূষণ, বৃক্ষ নিধন ও তাপমাত্রা বৃদ্ধি, জলাবদ্ধতা, যানজট ও স্বাস্থ্য সংকটের শিকার হচ্ছি আমরা। রাজধানীতে বিদ্যমান সবুজের পরিমাণ মাত্র আট শতাংশ, যা প্রতিনিয়ত কমছে। সবুজ সুরক্ষায় আমাদের আরও সচেতন হতে হবে।
নির্ধারিত আলোচনায় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের স্থপতি অধিদফতরের সাবেক প্রধান স্থপতি কাজী গোলাম নাসির, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমন এবং নতুনধারা অ্যাসেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. মো. শহীদ-উজ্জ-জামান অংশগ্রহণ করেন।
আলোচনায় অংশ নিয়ে কাজী গোলাম নাসির বলেন, ঢাকায় মানুষের আসার প্রবণতা কমাতে রাজধানীর বাইরে মানুষের জীবনযাত্রা পরিচালনায় শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে হবে। আমরা অতিদ্রুত কৃষি জমি হারিয়ে ফেলছি, যা উদ্বেগের বিষয়। খাদ্য নিরাপত্তায় কৃষিজমি সুরক্ষায় আমাদের আরও মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ঢাকা শহরের জন্য একটা ভিশন প্রয়োজন এবং এ জন্য সুশাসনের পাশাপাশি জনগণের সম্পৃক্ততা একান্ত অপরিহার্য। রাজউকের পুনর্গঠন করা এখন সময়ের দাবি। এছাড়াও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতের পাশাপাশি প্রতিটি শহরের মাস্টারপ্ল্যান থাকা প্রয়োজন বলে মত প্রকাশ করেন তিনি।
মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমন বলেন, ঢাকা শহরের নগরায়নে গৃহীত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠানের উদাসীনতা পরিলক্ষিত হয়। এ ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমাদের আরও মনোযোগী হতে হবে।
মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে এ খাতের প্রতিনিধিরা যানজট নিরসনে বহুতল বিশিষ্ট পার্কিং সুবিধা বৃদ্ধি, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সংখ্যা বাড়ানো, বুড়িগঙ্গা নদীর নাব্য ও ব্যবহার উপযোগিতা বৃদ্ধি, পুরান ঢাকা থেকে কেরানীগঞ্জে শিল্প-কারখানা স্থানান্তরে অবকাঠমো উন্নয়ন ও প্রণোদনা সহায়তা দেওয়ারও সুপারিশ করেন বক্তারা।
এএ