ধূমপান বা তামাক পাতা যারা ব্যবহার করেন তারা জানেন এর ব্যবহারের ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে, তবুও তারা ধূমপান ছাড়তে পারেন না। যারা স্বেচ্ছায় ছেড়ে দেন তাদের ইচ্ছাশক্তি প্রবল তেমনি যারা পারেন না তাদের দরকার কাউন্সিলিং।
ধূমপান ও তামাক ব্যবহারের ক্ষতি অনেক, এক কথায় বলতে গেলে মাথার চুল থেকে পায়ের নখ ও আমাদের দেহের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তামাকের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেমন মাথার চুল পড়া, চোখের দৃষ্টিশক্তি নষ্ট, মুখের ক্যান্সার, গলার ক্যান্সার, ফুসফুসের ক্যান্সার, হৃদরোগ, পাকস্থলীর ক্যান্সার, স্তন ক্যান্সার, যৌনশক্তি নাশ, গর্ভপাত, মৃতশিশু জন্ম, পায়ের পচনশীল রোগ,গ্যাংগ্রিন যার চিকিৎসা পা কেটে ফেলা ইত্যাদি। ধূমপান যে শুধু ধূমপায়ীকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাচ্ছে তা নয়, একজন পাশে থাকা অধূমপায়ীকেও সমানভাবে এসব রোগে আক্রান্ত করছে।
বাংলাদেশে প্রতি বছর, তামাক ব্যবহারজনিত অসুখে ১ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। (যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট অব হেল্থ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভাল্যুয়েশনের (আইএইচএমই) ২০১৩ সালের তথ্য অনুযায়ী) বাংলাদেশে মোট হৃদরোগে আক্রান্ত মৃত্যুর ৩০ শতাংশ, ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর ৩৮ শতাংশ, ফুসফুসে যক্ষার কারণে মৃত্যুর ৩৫ শতাংশ, এবং অন্যান্য শ্বাসতন্ত্রজনিত রোগে মৃত্যুর ২৪ শতাংশের জন্য দায়ী ধূমপান। (ডব্লিউএইচও, ২০১৩)। দেশে ক্যান্সার রোগে ভুগছে ১৩ থেকে ১৪ লাখ মানুষ । প্রতি বছর নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে ২.৫ লাখ মানুষ এবং মারা যাচ্ছে ২ লাখ মানুষ। মুখ গহ্বর, স্বরযন্ত্র, জিহ্বা ও ফুসফুসের ক্যান্সারের প্রায় ৫০ ভাগের জন্যই দায়ী তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য সেবন।
তবে যারা ধূমপান বা তামাক পাতা জর্দা ব্যবহার করেন তারা এর ক্ষতিকর দিক জেনে ছেড়ে দেয়ার কথা সবসময়ই ভাবেন তবে কোন সময়টা তাদের জন্য উপযুক্ত সময়, সেটা বুঝতে পারেন না। এদিক দিয়ে বিবেচনা করলে বলা যায় পবিত্র এই রমজান মাসে ধূমপান বা তামাক পাতা জর্দা ছেড়ে দেয়ার জন্য উপযুক্ত সময়। একটা মানুষ যখন সারা দিন কোনো কিছু না খেয়ে থাকতে পারে, বিশেষত দিনের এই দীর্ঘ প্রায় ১৬ ঘণ্টা সময় না খেয়ে থাকতে পারেন এবং সেই সময়ে সিগারেট. জর্দা পান জাতীয় খাবার না খেয়ে থাকতে পারেন তখন তারা কেন জীবনের বাকি সময়ের জন্য ধূমপান বা তামাক ছাড়তে পারবেন না? কারণ, এটাতো সম্পূর্ণ ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে! তাছাড়া রমজান মাসটা হচ্ছে সংযমের মাস। এ সময়ে মানুষ অনেক সংযমী হয় এবং একটা নিয়ম-শৃংখলার সঙ্গে ধর্মীয় নিয়মনীতির মধ্যে কাটায়। সুতরাং এই পবিত্র মাসেই যদি সিগারেট বা জর্দা না খেয়ে তারা থাকতে পারেন তবে বছরের বাকিটা সময় থাকতে পারবেন না কেন? অতএব এ সময়ে যদি রোজা রাখার আগেই বা রোজা রাখার সময় থেকেই একজন ধূমপায়ী প্রতিজ্ঞা করেন যে আমি এই পবিত্র রমজান মাসে যেহেতু রোজা রাখব, নামাজ পড়ব সেহেতু আমি এই সময় থেকেই আমার এই বদ-অভ্যাসটিকেও পরিত্যাগ করব এবং এ দৃঢ় সিদ্ধান্ত থেকেই একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি এ ধরনের বদ-অভ্যাস থেকে মুক্ত হতে পারেন।
ধূমপান ছাড়ার কাজটি চার পর্যায় চিহ্নিত করা যায়-
১. প্রথমে আপনি চিন্তা করে নিন কেন আপনি ধূমপান ছাড়বেন। মনে মনে আপনি শক্ত যুক্তি খুঁজে নিতে চেষ্টা করুন।
২. আপনি নিজের মনকে ওই যুক্তিগুলোর আলোকে ধূমপান ছাড়ার জন্য প্রস্তুত করতে থাকুন।
৩. সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আপনি এক বিশেষ দিনে কাজটি সম্পন্ন করুন। সেই দিন অবশ্যই ধূমপান ছেড়ে দিন।
৪. আপনার ধূমপানের সময় অন্য কোনো কাজে বা চিন্তায় নিজেকে ব্যস্ত রাখুন।
একবার চিন্তা করে দেখুন তো ধূমপানের মধ্যে যে রাসায়নিক পদার্থ থাকে (প্রায় সাত হাজার), তা ঘরের আবহাওয়াকে কীভাবে দূষিত করছে এবং তা আপনার পরিবারের কিরূপ ক্ষতি সাধন করছে? তাই ধূমপান ছেড়ে দেয়ার পর কয়েক সপ্তাহের খারাপ মেজাজের চেয়ে আপনার সুস্থ, শান্তিময় দীর্ঘজীবন অনেক প্রিয়, শ্রেয় এবং নিরাপদ, নয় কি?
এ বিষয়ে আপনি প্রথমে পরিবারের সদস্য ও বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে কিছু সাহায্য নিন।
১. তাদের মধ্যে আপনার ধূমপান ত্যাগের দায়িত্ব বা কর্তৃত্ব নিতে দিন।
২. কারও সঙ্গে বাজি ধরুন যে আপনি কিছুদিনের মধ্যেই ধূমপান ছেড়ে দেবেন, যেমন- এই রমজান মাসেই একটি দিন অথবা এই মাসের মধ্যে আপনি অধূমপায়ী হবেন।
৩. এ ব্যাপারে একজন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের পরামর্শও নিতে পারেন। তার একজন রোগী হিসেবে আপনাকে সাহায্য করতে অনুরোধ করুন।
অথবা একজন ধূমপায়ীর সঙ্গে এ ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে চুক্তি করুন। আপনি আপনার পরিবারের যে কোনো একজন ঘনিষ্ঠজনের সঙ্গে খোলাখুলি আলাপ করুন। তাকে বলুন, আপনি ঠিক কী করতে চাচ্ছেন এবং কেন করতে যাচ্ছেন।
এই রমজান মাসের এমন একটি দিন ধার্য করুন যেদিন আপনার কোনো প্রকার মানসিক চাপ বা উত্তেজনা থাকবে না। একদিন আগে আপনার ঘরের সব সিগারেটের প্যাকেট, ছাইদানি এবং লাইটার বা ম্যাচ বাক্স ছুড়ে ফেলে দিন।
আজকাল তরুণ ও মধ্যবয়সের অনেক ধূমপায়ী হৃদরোগ অথবা ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা ধূমপায়ীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বড় একটা ক্ষতির মুখোমুখি হয়ে তারপর ধূমপান ছাড়তে বাধ্য হয়। আমি অনেককে দেখেছি ধূমপান না ছাড়ার কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ওপেনহার্ট সার্জারির পর অথবা মুখের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার কারণে চোয়াল কেটে ফেলে দেয়ার পর ধূমপান/তামাক ছেড়েছেন।
ধূমপায়ীদের জন্য সবচেয়ে বড় সুসংবাদ হচ্ছে, ধূমপান ছাড়ার কয়েক ঘণ্টা পর থেকেই ধূমপানের সব ক্ষতিকর পদার্থ শরীর থেকে বের হয়ে যেতে থাকে এবং পাঁচ বছরের মধ্যে প্রায় সব ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকি থেকে তারা মুক্ত হতে পারেন।
তাই ধূমপান/তামাক গ্রহণের বদ-অভ্যাস থেকে ক্যান্সার বা হৃদরোগের শিকার হওয়ার আগেই সঠিক সিদ্ধান্ত নিন এই পবিত্র রমজান মাসেই।
অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী : একুশে পদকপ্রাপ্ত; সভাপতি, মানস; সম্মানিক উপদেষ্টা, বারডেম, ডেনটিস্ট
prof.arupratanchoudhury@yahoo.com
সানবিডি/ঢাকা/এসএস