দল পুনর্গঠনে হাত দিয়েও তা শেষ হয়নি এখনো। এরই মধ্যে দলভিত্তিক স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত নতুন করে রাজনৈতিক চাপে ফেলেছে বিএনপিকে।
দলটির দায়িত্বশীল নেতারা মনে করছেন, স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুরোপুরি কবজায় নিতে দলীয়ভাবে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তা ছাড়া দলীয় প্রতীক ও মনোনয়নে নির্বাচন করে বিএনপিকে শেখ হাসিনার সরকারের অধীন নির্বাচনে আনার ফাঁদে ফেলার কৌশল থেকেও এ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হচ্ছে বলে বিএনপির সন্দেহ।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, তাঁদের দল স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচনে অংশ নিয়ে আসছে। কিন্তু দলভিত্তিক স্থানীয় সরকারের নির্বাচন একটি নতুন প্রেক্ষিত। এ বিষয়ে দলের উচ্চপর্যায়ে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
তবে দলের উচ্চপর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা বলেন, বিএনপির সামনে এখন দুটি পথ। এক. সরকার যাতে দলীয় পরিচয়ে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে, সেই পরিস্থিতি তৈরি করা। দুই. ফলাফল পূর্বনির্ধারিত, তা জেনেই এটাকে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়া।
দলীয় সূত্রগুলো জানায়, দলভিত্তিক স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সঙ্গে বিএনপি নীতিগতভাবে একমত। কিন্তু সরকারের দমন-পীড়ন এবং ক্ষমতাসীনদের অধীন সম্প্রতি তিন সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় সরকারের একাধিক নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে এ ব্যবস্থার বিরোধিতা করছে দল।
বিএনপির সূত্রে জানা গেছে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দলের আগামী পৌর বা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে না যাওয়ার ভালো-মন্দ দিকগুলোর নানামুখী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। তবে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। লন্ডনে অবস্থানরত দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দেশে ফেরার পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে বলে জানিয়েছেন বিএনপির নেতারা।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটি ও দলের যুগ্ম মহাসচিব পর্যায়ের তিনজন নেতার সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা বলেছেন, বর্তমানে বিএনপির যে অবস্থা, তাতে সরকারকে তাদের দলীয় ছকে নির্বাচনের পথ থেকে সরানোর মতো সামর্থ্য নেই। তাই দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা দ্বিতীয় বিকল্প, অর্থাৎ নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেওয়ার পক্ষে।
এই অংশের নেতারা মনে করছেন, নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন ন্যূনতম নিরপেক্ষতা দেখাতে পারলে সরকারের দমন-পীড়ন ও বৈরী পরিস্থিতির মধ্যেও বিএনপির প্রার্থীরা ভালো করবেন। মাঠপর্যায়ে তাঁদের সেই জনসমর্থন আছে। তা ছাড়া ২০-দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামী দলীয় প্রতীক দাঁড়িপাল্লা নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না। ফলে বিএনপির প্রার্থীদের আরও ভালো করার সুযোগ তৈরি করবে।
এ ছাড়া দলের নেতাদের কারও কারও আশঙ্কা, বিএনপি স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে অংশ না নিলে মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে নতুন করে হতাশা সৃষ্টি করতে পারে। এই হতাশায় দলের অনেক সম্ভাবনাময় প্রার্থী সরকারি চাপে অথবা নিজেদের টিকে থাকার জন্য হলেও ক্ষমতাসীন দলে যোগ দিয়ে দিতে পারেন।
বিএনপির দায়িত্বশীল নেতাদের ধারণা, হুট করে দলীয় পরিচয়ে স্থানীয় নির্বাচনের সরকারি ছক পরিকল্পিত। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলেও তিন সিটি নির্বাচনের মতোই মাঠে নামতে দেওয়া হবে না। ভয়ভীতি দেখিয়ে প্রার্থীদের এজেন্টদের কেন্দ্রে যেতে দেওয়া হবে না। এ পরিস্থিতিতে জেনেশুনে নির্বাচনে অংশ নিয়ে সরকারকে বৈধতা দেওয়া ঠিক হবে কি না, তা-ও ভাবছেন নেতারা।
বিএনপির নেতাদের অনেকে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ প্রধান প্রধান সিটি করপোরেশনগুলোতে বিএনপি-সমর্থিত নির্বাচিত মেয়র ও পৌরসভার মেয়র, উপজেলার চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের সরিয়ে দিয়ে সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কথাও উদাহরণ হিসেবে সামনে আনছেন।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একজন নেতা গত মঙ্গলবার বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কথা ওঠার পর ইতিমধ্যে বিভিন্ন এলাকায় পুলিশ ও সরকারের বিভিন্ন সংস্থার লোকেরা বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীদের মামলার খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেছেন বলে তাঁরা খবর পাচ্ছেন। এ অবস্থায় নির্বাচনে গিয়ে ফল কী হবে, তা নিয়ে চিন্তা আছে দলে।
অবশ্য এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মো. শাহজাহান বলেন, ‘মামলা, গ্রেপ্তার, নির্যাতন-নিপীড়ন—এই ঝড়-তুফানের মধ্য দিয়েই আমাদের এগোতে হবে।’
বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক নেতা বলেছেন, সরকার এতটা তড়িঘড়ি ও হুড়মুড় করে দলীয় প্রতীক ও মনোনয়নে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবে, তা তাঁদের ধারণায় ছিল না। এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে জাতীয় সংসদে নিজেরা নিজেরা হলেও আলোচনা হবে। কিন্তু সরকার নিজেদের একতরফা সংসদকেও গুরুত্ব না দিয়ে অধ্যাদেশ আকারে আইন পাস করে নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে এখন দল পুনর্গঠন, নাকি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রস্তুতি—কোন বিষয়ে মনোযোগী হবে, তা নিয়ে কিছু দুর্ভাবনায় ফেলেছে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের।
দলের নেতাদের কেউ কেউ মনে করছেন, দলভিত্তিক স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সরকারি সিদ্ধান্তে বিএনপির পুনর্গঠন প্রক্রিয়া নতুন আঙ্গিক ও গতি পাবে। সম্মেলনের মাধ্যমে দল পুনর্গঠনের চলমান উদ্যোগের পাশাপাশি সাংগঠনিক কাঠামোয় প্রার্থী বাছাইয়ের প্রক্রিয়া শুরু করা গেলে মাঠের নেতা-কর্মীদের জাগানো সম্ভব হবে।
বিএনপির নেতাদের মূল্যায়ন হচ্ছে, নির্বাচনে সরকারদলীয় প্রার্থীদের জিততে হলে কেন্দ্র দখল করে ভোট জালিয়াতির আশ্রয় নিতে হবে। আর তা করতে গেলে ৫ জানুয়ারির ‘একতরফা’ সংসদ নির্বাচন এবং গত এপ্রিলে চট্টগ্রাম ও ঢাকার তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর নতুন কেলেঙ্কারিতে পড়বে সরকার। এতে জনমনের পুরোনো ক্ষত দগদগে হবে। আর তাতে মাঠপর্যায়ে নতুন করে আন্দোলন দানা বাঁধার ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। সূত্র: প্রথম আলো
সানবিডি/ঢাকা/এসএস