মুফতি ইবরাহিম সুলতান
জীবন-মৃত্যুর মধ্যে একটি কঠিন বাস্তবতা হলো দুনিয়া ও দুনিয়ার জীবন উভয়টাই নশ্বর। জন্ম হলেই মৃত্যু আছে। যেখানে লয় সেখানে ক্ষয়। কোনো জিনিসের সূচনা যেন তার সমাপ্তির প্রথম ধাপ।
আমরা চাই বা না চাই একদিন আমাদের এ জগৎ ছেড়ে চলে যেতে হবে। এ ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ায় আমরা কিছুদিনের সেই পথিক যে ক্ষণে ক্ষণে তার আসল ঠিকানা তথা মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের দিকে অগ্রসর হচ্ছি। আর এ জন্য উচিত নশ্বর দুনিয়ায় আল্লাহ প্রদত্ত জীবন ও সময়কে কাজে লাগিয়ে চিরস্থায়ী জীবনের পাথেয় সংগ্রহ করা।
আলী ইবনে আবি তালিব (রা.) বলতেন, বর্তমান অতীত হয়ে যায় (দুনিয়ার জীবনের সময় গত হয়ে যায়) আর ভবিষ্যৎ তথা আখিরাত বর্তমান হওয়ার জন্য চলতে থাকে।
দুনিয়া ও আখিরাত উভয়টিরই সন্তান আছে (তালাশকারী আছে)। সুতরাং তোমরা আখিরাতের সন্তান হও। (আখিরাতকে গুরুত্ব দাও) দুনিয়ার সন্তান হয়ো না। কারণ আজ তো আমল করার সুযোগ পাচ্ছ কোন জবাবদিহি ছাড়া।
আর আগামীতে জবাবদিহি করবে কোনো আমল করার সুযোগ ছাড়া। (তারিখে দিমাশক : ৪২/৪৯৫)
উমর ইবনে আবদুল আজিজ (রহ.) তাঁর খুতবায় বলেন, নিশ্চয়ই দুনিয়া স্থায়ী বাসস্থান নয়। আল্লাহ তাআলা তার ধ্বংস নির্ধারিত করে রেখেছেন এবং তার অধিবাসীদের ভাগ্যে মৃত্যুর সফর লিখে দিয়েছেন। কত প্রাসাদের গায়ে সামান্য হলেও ধ্বংসের ছোঁয়া লেগেছে। আর তাতে বসবাসকারী কত সুখী পরিবারকে বিদায় নিতে হয়েছে।
সুতরাং তোমরা উত্তম আমল করো। আল্লাহ তোমাদের ওপর রহম করুন। এই চিরবিদায় সুন্দর হয় তোমাদের জীবদ্দশার সংগ্রহের ওপর নির্ভর করে। তাই তোমরা পাথেয় গ্রহণ করো। আর সর্বোত্তম পাথেয় হলো তাকওয়া। (হিলয়াতুল আউলিয়া : ৫/২৯২)
নবী কারিম (সা.) নশ্বর এই পৃথিবীর উদাহরণ দিয়ে উম্মতকে সতর্ক করে বলেন, নিশ্চয়ই আমার, তোমাদের এবং দুনিয়ার দৃষ্টান্ত হলো এমন একদল লোকের মতো, যারা ধূসর মরুর বুকে চলল। এক পর্যায়ে যখন তারা বুঝল না যে বেশির ভাগ পথ তারা পাড়ি দিয়েছে অথবা কতটুকু পথ বাকি আছে? তখন তারা পাথেয় নিঃশেষ করে ফেলল এবং বাহনকেও ক্লান্ত করে ফেলল। এরপর মরুভূমির মধ্যে পাথেয় ও বাহন ছাড়া পড়ে রইল এবং ধ্বংস হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে গেল। তারা এভাবে থাকাবস্থায় হঠাৎ এক জোড়া পোশাক পরিহিত এক ব্যক্তি তাদের সামনে প্রকাশ পেল যার মাথা থেকে পানি ঝরছে। তখন তারা বলল, নিশ্চয় সে তীরের নিকটবর্তী লোক, আর দূর থেকে আসেনি। যখন সে তাদের কাছে এসে বলল, তোমরা কী অবস্থায় রয়েছ? তারা বলল, যে অবস্থায় দেখছ। তখন সে বলল, তোমরা ভেবে দেখো তো যদি তোমাদের আমি সুমিষ্ট পানি ও সবুজ বাগিচায় পৌঁছে দিই, তোমরা কী করবে? তারা বলল, কোনো বিষয়েই তোমার অবাধ্য হব না। সে বলল, আল্লাহর নামে তোমাদের শপথ ও প্রতিশ্রুতি দাও। তখন তারা আল্লাহর নামে শপথ ও প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করল, কোনো বিষয়ে তারা তার অবাধ্য হবে না।
তিনি বলেন, তখন সে তাদের জলাশয় ও সবুজ বাগিচায় উপস্থিত করল। এরপর আল্লাহ যতক্ষণ চাইলেন অবস্থান করল। এরপর বলল, হে লোক সকল! এবার প্রস্থান! তারা বলল, কোথায়? সে বলল, এমন (উত্কৃষ্ট) জলাশয় ও বাগানের দিকে, যা তোমাদের জলাশয় ও বাগানের মতো নয়। তখন তাদের বড় একটি অংশ বলে উঠল আল্লাহর শপথ! আমরা এটা এমন সময় পেয়েছি, যখন ধারণা হয়েছিল তা মোটেও পাব না। এর চেয়ে উত্তম জীবন দিয়ে কী করব? এবার আরেকটি দল যারা সংখ্যায় কম ছিল, তারা বলল, তোমরা কি আল্লাহর নামে এই ব্যক্তিকে প্রতিশ্রুতি দাওনি? কোনো বিষয়ে তার অবাধ্য হবে না! সে তার কথার প্রথমাংশে তোমাদের সঙ্গে সত্য বলেছিল। আল্লাহর শপথ! তার কথার শেষ ভাগেও তোমাদের সঙ্গে সত্যই বলছে। তিনি বলেন, তখন সে তার অনুসারীদের নিয়ে চলে গেল। আর অন্যরা পেছনে রয়ে গেল। তখন তাদের ব্যাপারে এক শত্রু অবগত হলো। ফলে তারা বন্দি ও নিহত হলো।
ইমাম ইবনে রজব হাম্বলি (রহ.) এই উদাহরণে উম্মতের সঙ্গে নবী কারিম (সা.)-এর অবস্থা সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। কারণ তিনি এমন এক সময়ে এসেছিলেন যখন আরব ছিল দুনিয়ার ভোগ-বিলাসিতা ও আখিরাতের উদাসীনতায় সবচেয়ে নিকৃষ্ট, পাপে নিমজ্জিত ও বর্বর জাতি। অতঃপর তিনি তাদের নাজাতের পথে ডাকলেন এবং নিজের সত্যায়নে উজ্জ্বল নিদর্শনসমূহ তুলে ধরলেন। যেমনটি ঘটেছে হাদিসে বর্ণিত সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে। যাদের পানি ফুরিয়ে গিয়েছিল এবং বাহনজন্তু মরে গিয়েছিল। অতঃপর তারা এমন এক ব্যক্তিকে দেখতে পেল, যার চিরুনি কাটা চুল থেকে গোসলের পানি টপকিয়ে পড়ছে। যা সেই অঞ্চলের পানি ও সতেজ গাছগাছালি বিদ্যমানতার প্রমাণ বহন করে। তাই তারা সেই অবস্থা বিবেচনা করে তার কথা বিশ্বাস করে তার অনুসরণ করল। সে তাদের কথা দিল যে রোম ও পারস্য বিজয়ে তার সহায়তা করলে তাদেরকে সেই রাজ্যদ্বয়ের ধনরত্নের ভাণ্ডার থেকে পুরস্কৃত করবে। আবার এই ধনরত্নের মোহে আটকে যাওয়া থেকে সতর্ক থাকতে উপদেশও দিল।
ঠিক এমনিভাবে নবী কারিম (সা.) ও আখিরাতের প্রস্তুতির জন্য যথাসম্ভব দুনিয়ার উপায়-উপকরণ ব্যবহার করতে অনুমতি দিয়েছেন। আর সবাই তাঁর কৃত সমস্ত অঙ্গীকারের সত্যতাও অবলোকন করেছে। কিন্তু যখন তাঁর ওয়াদা অনুযায়ী তাদের সামনে দুনিয়ার নিয়ামতের দরজাকে খুলে দেওয়া হলো তখন বেশির ভাগ মানুষ সেই ধনসম্পদ সংগ্রহ ও জমানোতে ব্যস্ত এবং এ ব্যাপারে পরস্পরের মাঝে প্রতিযোগিতা শুরু হলো। তারা দুনিয়ার জীবন ও তার ভোগ-বিলাসিতা নিয়েই সন্তুষ্ট রইল এবং আখিরাতের কথা ভুলে গেল, যার জন্য প্রস্তুতি নিতে সবাইকে আদেশ দেওয়া হয়েছিল। তবে অল্প কিছু লোক তার এই অমূল্য উপদেশ মেনে আখিরাতের জন্য কাজ করেছে ও যথাযথ প্রস্তুতি নিয়েছে। আর এরাই নাজাত পেয়েছে। পরকালীন জীবনে তাঁরাই নবীজির সঙ্গ পাবে, যেভাবে তারা দুনিয়ায় তাঁর আদেশ-উপদেশের মান রেখেছে। তাঁর দেখানো পথে চলে আখিরাতের পাথেয় সংগ্রহ করেছে। অন্যদিকে যারা আখিরাত ভুলে দুনিয়ার ভালোবাসায় মত্ত হয়ে ছিল তাদের একদিন হঠাৎ মৃত্যু এসে এই নেশাকে কাটিয়ে দিয়েছে এবং তারা ধ্বংস হয়ে গেছে।
আমাদের করণীয় হলো, স্থায়ী ঠিকানা আখিরাতের ঘরের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য প্রতিদিন নিজেকে কমপক্ষে একবার হলেও মৃত্যুকে স্মরণ করিয়ে নেওয়া। শয়তান ও দুনিয়ার চাকচিক্যের মোহ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা। (জামিউল উলুমি ওয়াল হিকাম : ২/৩৮০-৩৮১)
এনজে