পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর উদ্যোক্তা পরিচালকদের সমন্বিত শেয়ার ধারণে সর্বনিম্ন সীমার ব্যাপারে গত বছরের সেপ্টেম্বরে কঠোর নির্দেশনা দেয় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। তখন বিএসইসি বলেছিল, আগামী ১৫ দিনের মধ্যে (৩০ সেপ্টেম্বর) যেসব কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালক সমন্বিতভাবে ৩০ শতাংশের কম শেয়ার ধারণ করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। সেই নির্দেশনার পর পাঁচ মাস পার হলেও এর কোনোপ্রকার কার্যকারিতা দেখা যায়নি।
সেসময় বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম বলেছিলেন, ‘সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। চলতি বছরের (২০২৩) সেপ্টেম্বরের পর যেসব কোম্পানি নিয়ম মানবে না, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যাবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।’ তবে এর পাঁচ মাস পর ফেব্রুয়ারি শেষে কোন কোন কোম্পানি নির্দেশনা মানেনি এবং কতটি কোম্পানি পরিকল্পনা জমা দিয়েছে এ ব্যাপারে গতকাল তার কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়টি নিয়ে গত বছরের সেপ্টেম্বরে কোম্পানিগুলোর কাছে পরিকল্পনা জমা দেয়ার জন্য বলা হয়েছিল। এরমধ্যে কিছু কোম্পানি পরিকল্পনা জমা দিয়েছে আর কিছু দেয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘যেসব কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকদের শেয়ার ধারণ ৩০ শতাংশের কম সেসব কোম্পানিগুলোর পরিকল্পনা কমিশন নিচ্ছে। এখনো যারা জমা দেয়নি এবং যারা দিয়েছে তাদের ব্যাপারে কমিশনের পরিবর্তী সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেয়া হবে।’ তবে কতটি কোম্পানি এ পর্যন্ত পরিকল্পনা জমা দিয়েছে এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারেননি তিনি।
কোনো কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালক শেয়ার ধারণ ক্ষমতার বাধ্যবাধকতার নিয়ম না মানলে বিএসইসি সেই কোম্পানির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে পর্ষদ পুনর্গঠন করতে পারে।
সম্প্রতি একটি বৈঠকে বিএসইসি ৭টি তালিকাভুক্ত কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের কাছে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণে তাদের অসম্মতির বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়েছে বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। কোম্পানিগুলো হচ্ছে- অ্যাকটিভ ফাইন কেমিক্যালস, অ্যাপোলো ইস্পাত, সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালস, ফ্যামিলিটেক্স বিডি, মিথুন নিটিং, নর্দার্ন জুট এবং সুহ্নদ ইন্ডাস্ট্রিজ। অন্যদিকে, ৩০ শতাংশ শেয়ার নেই এমন ৬টি কোম্পানিতে দুজন করে স্বাধীন পরিচালক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কোম্পানিগুলো হলো- ফার্মা এইডস, আলহাজ টেক্সটাইল, আজিজ পাইপস, এফএএস ফাইন্যান্স, জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশন এবং রিং শাইন টেক্সটাইল। এছাড়াও, ১৩টি কোম্পানি ৩০ শতাংশ শেয়ার ধাারণ করার জন্য এক বছর সময় পেয়েছে। কারণ কোম্পানিগুলি ৩০ শতাংশ শেয়ার কীভাবে পূরণ করবে, সে বিষয়ে বিএসইসির কাছে পরিকল্পনা জমা দিয়েছে।
ওই ১৩টি কোম্পানি হল- আফতাব অটোমোবাইলস, ইনটেক লিমিটেড, সিএন্ডএ টেক্সটাইলস, আরএসআরএম লিমিটেড, ফাইন ফুডস, সালভো কেমিক্যাল, ফু-ওয়াং ফুডস, আইএসএন লিমিটেড, এএফসি অ্যাগ্রো বায়োটেক, ন্যাশনাল ব্যাংক, অলিম্পিক এক্সেসরিজ, পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্স এবং ডেল্টা স্পিনার্স।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ২৭ ফেব্রুয়ারির তথ্য অনুযায়ী, তালিকাভুক্ত ৩৩টি কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকরা সেই নির্দেশনা পরিপালন করেনি। কোম্পানিগুলোর উদ্যোক্তা পরিচালকরা নিজেদের সুবিধামতো শেয়ার ধারণ করে দাম বাড়িয়ে তা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ধরিয়ে দিচ্ছেন। এতে বড় ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। এতে এসব কোম্পানির শেয়ার দরেও দেখা যায় বড় উত্থান-পতন।
নির্দেশনার না মানার মধ্যে বস্ত্র খাতের ৭টি, ওষুধ ও রসায়ন খাতের ৫টি, প্রকৌশল খাতের ৮ টি, আইটি খাতের ২টি, খাদ্য খাতের ২টি, আর্থিক খাতের ৪টি, পাট খাতের ১টি, জীবন বিমা খাতের ২টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
যেসব কোম্পানি ৩০ শতাংশ উদ্যোক্তা পরিচালকের সমন্বিত শেয়ার ধারণে ব্যর্থ এগুলো হচ্ছে- অ্যাপোলো ইস্পাত, সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইল, ফাইন ফুড, ফ্যামিলিটেক্স, এফএএস ফাইন্যান্স, অ্যাক্টিভ ফাইন, পিপলস লিজিং, আফতাব অটোমোবাইলস, প্রিমিয়ার লিজিং, আলহাজ টেক্সটাইল, ফনিক্স ফাইন্যান্স, আজিজ পাইপস, বিডি থাই অ্যালুমিনিয়াম, সেন্ট্রাল ফার্মা, ডেল্টা স্পিনিং, রিং শাইন, ফু-ওয়াং ফুড, জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশন, আইএফআইসি ব্যাংক, রতনপুর স্টিল রি-রোলিং মিলস, ন্যাশনাল ব্যাংক, ইনটেক, ইনফরমেশন সার্ভিসেস নেটওয়ার্ক, মিথুন নিটিং, নর্দান জুট, ফার্মা এইড, এএফসি অ্যাগ্রো, সালভো কেমিক্যাল, পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্স, সন্ধানী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজ, ইস্টার্ন কেবলস এবং অলিম্পিক এক্সেসরিজ লিমিটেড।
তথ্য অনুযায়ী, ৩৩টি কোম্পানির মধ্যে ২০ শতাংশের নিচে উদ্যোক্তা-পরিচালক শেয়ার ধারণ করেননি এমন কোম্পানির সংখ্যা ১২টি। এরমধ্যে আবার ১০ শতাংশের নিচে শেয়ার ধারণ করেছেন এমন কোম্পানি রয়েছে ৩টি।
সমন্বিতভাবে কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের ৩০ শতাংশ শেয়ারধারণ পুঁজিবাজারের জন্য ইতিবাচক মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, যেসব কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকরা ৩০ শতাংশের কম শেয়ার ধারণ করবে তাদের পরিষদ থেকে বের করে দেয়া উচিত। তাদের বাদ দিয়ে যেসব বিনিয়োগকারী ব্যক্তিগতভাবে ২ শতাংশের বেশি শেয়ার ধারণ করে তাদের দায়িত্ব দেয়া উচিত।
তিনি আরও বলেন, বিএসইসির উচিত এই সমস্যাটার তাড়াতাড়ি একটা সমাধান বের করা। কমিশন চাইলেই এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যেতে পারে। এই ক্ষমতা কমিশনের আছে।
২০১০ সালে পুঁজিবাজার ধসের পরে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ২০১১ সালে এই নিয়ম জারি করে। এর মাধ্যমে কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের দায়িত্বশীল করাই উদ্দেশ্য। ২০২০ সালের জুলাইয়ে বিএসইসির নতুন নেতৃত্ব উদ্যোক্তা পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ এবং প্রত্যেক পরিচালকের সর্বনিম্ন ২ শতাংশ শেয়ারধারণের নিয়মের পক্ষে কঠোর অবস্থান নেয়। সে বছরের জুলাই মাসে ৪৪টি তালিকাভুক্ত কোম্পানিকে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ করার নির্দেশনা দিয়েছিল বিএসইসি। ন্যূনতম ২ শতাংশ শেয়ারধারণের শর্ত পূরণ না করে পদে থাকায় সেই বছরের সেপ্টেম্বরে ৯টি কোম্পানির ১৭ জন পরিচালককে সরিয়ে দেয় বিএসইসি। সেই সঙ্গে উদ্যোক্তা পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ারধারণের শর্ত পূরণে ব্যর্থ কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হবে বলেও জানানো হয়।
মিডওয়ে সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশেকুর রহমান বলেন, ‘সেই ২০১১ সালে উদ্যোক্তা পরিচালকদের জন্য এই আইন করা হয়েছিল। কিন্তু ১২ বছর পার হয়ে গেলেও এর বাস্তবায়ন এখনো সেভাবে দেখা যায়নি। বিএসইসির ক্ষমতা আছে যেসব কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালক এই নিয়ম ভঙ্গ করবে তাদের সরিয়ে দেয়ার। তাদের বদলে ইন্ডিভিজুয়ালি যেসব বিনিয়োগকারী ২ শতাংশের বেশি শেয়ার ধারণ করেন তাদের মধ্য থেকে নির্বাচিত করে দিলেও সমস্যাটা সমাধান করা যায়।’
আশেকুর রহমান আরও বলেন, ‘যদি কোনো উদ্যোক্তা পরিচালক নিজেই ৩০ শতাংশের কম শেয়ার ধারণ করেন, আবার তা বিক্রি দেন তাহলে বিনিয়োগকারীদের সেই কোম্পানির পক্ষে আস্থা আসবে কোথা থেকে? আর যেসব পরিচালক নিয়োগ দেয়া হয় দেখা যায় এর বেশিরভাগ হচ্ছেন এডুকেশনাল ব্যাকগ্রাউন্ডের। পুঁজিবাজারে ব্যবসা করতে হলে ব্যবসায়ীক ব্যাকগ্রাউন্ডের লোক দরকার। এছাড়া বাজারের সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠা কষ্টকর হয়ে যাবে।’
গত ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের পরিশোধিত মূলধনের ন্যূনতম ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণের বিষয়ে পুনরায় কঠোর অবস্থান নেয়। যেসব কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা পরিশোধিত মূলধনের ন্যূনতম ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ করেনি তাদেরকে সেই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে (১৫ দিনের মধ্যে) এ বিষয়ে পরিকল্পনা জমা দিতে নির্দেশনা জারি করেছিল। পাঁচ মাস পার হলেও যার কোনো কার্যকারিতা দেখা যায়নি।
এএ