সুস্থতার জন্য মেডিটেশন
সানবিডি২৪ প্রকাশ: ২০২৪-০৫-১৯ ১১:২৭:৪১
ডা. সাজেদুল ইসলাম নাহিম:
কর্মব্যস্ত দিনশেষে শরীর সুস্থ রাখতে পর্যাপ্ত ঘুম প্রয়োজন। ঘুমে শরীর, মন ও মস্তিষ্ক বিশ্রাম পায়। শরীর ও মন সুস্থ রাখার আরেকটি মাধ্যম হচ্ছে মেডিটেশন। সেটা কীভাবে? প্রতিদিনের টেনশন, কাজের চাপ, অতিরিক্ত চিন্তার ধাক্কা সামলে সুস্থ থাকার অন্যতম ওষুধই হচ্ছে মেডিটেশন। মেডিটেশন বলতে যদিও আমরা সাধারণভাবে ধ্যান করা বলে বুঝে থাকি। এর নির্দিষ্ট কিছু পদ্ধতি ও বিভিন্ন ধাপ রয়েছে। সঠিক পদ্ধতিতে নিয়মিত মেডিটেশন করলে শারীরিক এবং মানসিকভাবে সুস্থ থাকা যায়। নিয়মিত মেডিটেশন অবসাদ, উদ্বেগ, অনিদ্রাসহ নানা সমস্যা উপশম করে।
প্রফেসর ডা. স্টিভেন লরিস নিউরোসায়েন্স গবেষণায় বর্তমান বিশ্বে নেতৃস্থানীয় গবেষকদের একজন। ব্যক্তিজীবনে তিনি খুব সংকটময় একটা সময়ে মেডিটেশন ও ইয়োগা চর্চা শুরু করেছিলেন। অতঃপর সফলভাবে ডিপ্রেশন কাটিয়ে ওঠেন। ২০২১ সালে প্রকাশিত তার ‘দ্য নো-ননসেন্স মেডিটেশন বুক: অ্যা সায়েন্টিস্ট’স গাইড টু দ্য পাওয়ার অব মেডিটেশন’ বইতে তিনি বলেন, প্রতিদিন ভোর সাড়ে ৫টায় আমি ঘুম থেকে উঠি। এরপর ইয়োগা করি এবং এক ঘণ্টা মেডিটেশন করি। এটি সুনিশ্চিতভাবেই স্ট্রেস কমায়। মেডিটেশন হতে পারে পাশ্চাত্যের আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থার পরিপূরক।
আরেক চিকিৎসক প্রফেসর ডা. ডেভিড আর স্যান্ডওয়েস। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ইউটাহ্ হেলথের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ। ২০১৮ সাল থেকে তিনি মাইন্ডফুলনেস নিয়ে নানা ধরনের কার্যক্রমে জড়িত।
তিনি বলেন, একবার মৃত্যুপথযাত্রী এক শিশুকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছি। বুঝতে পারলাম, বছর পেরোনোর আগেই হয়তো শিশুটির মাকে তার সন্তানের মৃত্যুর সংবাদটা জানাতে হবে। উপলব্ধি করলাম এই পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য আমি এখনও প্রস্তুত নই। মেডিকেল স্কুলগুলো আমাদের চিকিৎসক হিসেবে দক্ষ করে তুলেছে। কিন্তু শেখায়নি কীভাবে আমরা হারানোর বেদনা, ভুলভ্রান্তি আর পরাজয়ের মুহূর্তগুলোকে মোকাবিলা করব। ফলে শোক আর অনিশ্চয়তা কখনও কখনও সুনামির মতো ভর করে। দিনে ১২-১৪ ঘণ্টা হাসপাতালে কাজের পর স্থির থাকাও কঠিন। তাই মানসিক স্থিরতার জন্যে চিকিৎসকদের মেডিটেশন চর্চা প্রয়োজন।”
যুক্তরাষ্ট্রের দ্য ফিজিশিয়ানস্ ফাউন্ডেশন ২০২৩ সালে একটি জরিপ চালায়। এর তথ্যমতে, প্রতি ১০ চিকিৎসকের মধ্যে ছয়জন বার্ন-আউট বা ক্ষোভে-অবসাদে ফেটে পড়ার মতো অনুভূতিতে ভোগেন প্রায়ই। ৭৫ শতাংশ মেডিকেল শিক্ষার্থী ভোগেন তীব্র বিষণ্নতায়। ৫৫ শতাংশ বলছেন, তারা হতাশ এবং জীবনের কোনো অর্থ খুঁজে পান না।
উল্লেখযোগ্য একটি জরিপ বাংলাদেশেও হয়েছে। ২০২০ সালে প্রকাশিত দ্য অফিশিয়াল জার্নাল অব ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ ঢাকা’র একটি প্রবন্ধে বলা হয়, এদেশের ৪০ দশমিক ৮ শতাংশ মেডিকেল শিক্ষার্থী ডিপ্রেশনে ভুগছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড হেলথ পাবলিশিংয়ের ২০২১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারির রিপোর্ট অনুসারে, ডিপ্রেশনের কার্যকর সমাধান হলো মেডিটেশন। ধ্যানী চিকিৎসকরা রোগীদের প্রতি বেশি মনোযোগী।
২০২০ সালে চীনে চিকিৎসক ও রোগীর সম্পর্ক নিয়ে একটি গবেষণা হয়। এতে ১০৬ চিকিৎসককে দুটি গ্রুপে ভাগ করা হয়। একটি গ্রুপকে আট সপ্তাহব্যাপী মেডিটেশন প্রোগ্রামে যুক্ত করা হয়। আরেকটি গ্রুপ তাদের চিরাচরিত রুটিনেই জীবনযাপন করেন। দেখা গেছে, ধ্যানী চিকিৎসকরা রোগীদের প্রতি সহমর্মী হয়ে উঠেছেন। রোগীর সঙ্গে কথোপকথনে তারা আগের চেয়ে মনোযোগী।
যুক্তরাষ্ট্রের রচেস্টার স্কুল অব মেডিসিন অ্যান্ড ডেন্টিস্ট্রির প্যালিয়েটিভ কেয়ার বিশেষজ্ঞ, লেখক ও কমিউনিকেশন অ্যান্ড মাইন্ডফুল প্র্যাকটিস ইন মেডিসিনের শিক্ষক রোনাল্ড এম এপস্টেইন বলেন, চিকিৎসক এবং চিকিৎসাপেশায় নিয়োজিতদের মধ্যে যারা মেডিটেশন করেন, তারা রোগীদের সঙ্গে কথা বলায় অধিক মনোযোগী। পেশাগত ত্রুটি শুধরে নিতে আন্তরিক এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণেও তৎপর। পেশাগত চাপ তাদের ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে না।”
বিশ্বজুড়ে এখন প্রায় ৫০ কোটি মানুষ নিয়মিত ধ্যান বা মেডিটেশন করেন। শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও আত্মিক অর্থাৎ সুস্থ থাকতে মেডিটেশন বা ধ্যানের কার্যকারিতা এখন চিকিৎসাবিজ্ঞানে প্রমাণিত।
পুরো বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও দিনদিন মেডিটেশনের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। পরিপূর্ণ সুস্থতার জন্য বিদ্যমান চিকিৎসার পাশাপাশি মেডিটেশন যে প্রয়োজন, সেই পরামর্শ এখন চিকিৎসকরা দিচ্ছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সম্প্রতি যোগ-মেডিটেশনকে স্বাস্থ্যসেবার পরিপূরক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে।
সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশে ২১ মে বিশ্ব মেডিটেশন দিবস পালন করা হয়। ১৯৯৫ সাল থেকে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। দিবসটি উপলক্ষে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন প্রতিবছর বিভিন্ন উন্মুক্ত স্থানে প্রাণায়াম বা দমচর্চা, প্রত্যয়ন পাঠ ও মেডিটেশন চর্চার আয়োজন করে থাকে। দুই বছর ধরে বাংলাদেশ ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আনুষ্ঠানিকভাবে পালিত হচ্ছে দিনটি।
সময় এসেছে নিজের দিকে তাকানোর। আপনি কি রোগী হওয়ার পর মেডিটেশন শুরু করতে চান, নাকি এখনই আজই সিদ্ধান্ত নিন।