অধ্যাপক আবুল বাশার খান
১৯৫০ সালের ঘটনা। শিল্পোন্নত অর্থনৈতিক পরাশক্তি ব্রিটেন সরকার সিদ্ধান্ত নিল, তারা ‘দরিদ্র’ তিব্বতকে উন্নয়নের নসীহত প্রদান করবে। নিমন্ত্রণ পেয়ে দালাই লামা লন্ডনে তার প্রতিনিধি দল পাঠালেন। সেই দলে যে কজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ও কর্মকর্তা ছিলেন, তাদের কেউই এর আগে কোনোদিন তিব্বতের বাইরে কোথাও যান নি। আকাশছোঁয়া পর্বতমালা আর দিগন্তজোড়া নির্জনতা দেখে তারা অভ্যস্ত। বিলেত তাদের কাছে যেন এক আশ্চর্য জাদুপুরী। তবে তিব্বতিরা সবচেয়ে বেশি অবাক হলো লন্ডনের পাতালরেলে চড়তে গিয়ে। সে এক বিরাট হাঙ্গামা!
প্ল্যাটফর্মে শত শত মানুষ গিজগিজ করছে। ট্রেন ধরার জন্যে লোকজন ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছে কিংবা চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করছে। সুযোগ পেলে হাতে ধরে রাখা খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছে কিন্তু কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছে না। সহযাত্রীর সাথে কথা বলা তো দূরের ব্যাপার! এর চেয়েও মারাত্মক হলো, প্ল্যাটফর্মের সেই জনসমুদ্রে কারো মুখে এক চিলতে হাসি নেই।
তিব্বতি প্রতিনিধি দলের প্রধান ছিলেন একজন ভিক্ষু। তিনি বিস্ময়াহত চোখে ইংরেজ গাইডের দিকে তাকিয়ে গভীর সমমর্মিতার সাথে জিজ্ঞেস করলেন, আমরা আপনাদের জন্যে কী করতে পারি, বলুন?
আর্থিক সমৃদ্ধি বনাম প্রশান্তির টিকেট
লন্ডনে অল্প কদিন কাটিয়েই তিব্বতি ভিক্ষু আঁচ করতে পেরেছিলেন, ঊর্ধ্বশ্বাসে এভাবে ছুটে চললে যে উন্নয়ন হবে তা প্রসব করবে আত্মকেন্দ্রিক একটি রুগ্ণ সমাজ।
পরবর্তী ৭৪ বছরে পাশ্চাত্যের (মূলত যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও পশ্চিম ইউরোপে) জনজীবন অধিকতর গতিময় হয়েছে। বেড়েছে ঐশ্বর্য ও পণ্যপ্রীতি। যাদের সামর্থ্য আছে বছর বছর তারা গাড়ির মডেল পাল্টায়। আরো জোরে ছোটার বাসনায় ঘণ্টায় ৩০০ কি.মি. গতির গাড়ি বদলে ৩৩৮ কি.মি. গতির গাড়ি কেনে। কিন্তু সেই গাড়ি কি তাদের সুখের গন্তব্যে পৌঁছে দেয়? নাকি ত্রস্ততার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ায় অস্থিরতা? যাবতীয় পরিসংখ্যান দ্বিতীয় সম্ভাবনাটির দিকেই ইঙ্গিত করে।
নিউ সায়েন্টিস্ট ৬ এপ্রিল ২০২৪ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার ওপর বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, ইউরোপ ও আমেরিকা পৃথিবীর বিষণ্নতম ও সবচেয়ে উদ্বেগ-কবলিত অঞ্চল। পাশ্চাত্যে গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে একাকিত্বজনিত মহামারি। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমীক্ষা (২০২০) অনুযায়ী, আমেরিকার ৬১ শতাংশ নাগরিক একাকিত্বে ভুগছে। যুক্তরাষ্ট্রের সার্জন জেনারেল ডা. বিবেক মূর্তি বলেন, একাকিত্ব একটি গুরুতর সমস্যা যা হৃদরোগ, স্ট্রোক, ডিমেনশিয়া ও অকালমৃত্যুর ঝুঁকি বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। (ইউএসএ টুডে; ২৪ ডিসেম্বর ২০২৩)
এই সমস্যাগুলো তৈরির পেছনে সম্পদের অভাব কিন্তু মোটেই দায়ী নয়। কেননা, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে বাস করে পৃথিবীর মাত্র ১৩ শতাংশ মানুষ, যারা পৃথিবীর ৫৪ শতাংশ সম্পদের মালিক। এই অঢেল সম্পদ সমস্ত আরাম-আয়েশ দিয়েছে, কেবল সুখ বা প্রশান্তি ছাড়া।
প্রাচ্যের জ্ঞানই পাশ্চাত্যের ভরসা
আধুনিক প্রযুক্তি ও বস্তুবাদী জ্ঞানের কারখানা যখন আত্মিক শূন্যতার দাওয়াই দিতে ব্যর্থ হলো, পাশ্চাত্য মুখ ফেরাল তথাকথিত ‘পশ্চাৎপদ’ প্রাচ্যের দিকে। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে হযরত এনায়েত খান, মহাঋষি মহেশ যোগী প্রমুখের প্রচেষ্টার ফলে ধ্যান বা মোরাকাবার ব্যাপারে পশ্চিমা জনগণ আগ্রহী হয়ে ওঠে। ধ্যান ও আধ্যাত্মিকতা বিষয়ক প্রচুর বই ইউরোপীয় ভাষাগুলোতে অনূদিত হলো। নিয়তির পরিহাস বটে!
ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শিক্ষানীতি আরোপের কুশীলব লর্ড ম্যাকলের দাবি ছিল—ভারতবর্ষ ও আরবের সমস্ত সাহিত্যকর্ম মিলেও ইউরোপের ভালো কোনো লাইব্রেরির একটি মাত্র বইয়ের তাকের সমকক্ষ হবে না। আর এখন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি সুফিসাধক মওলানা জালালউদ্দিন রুমি!
ধ্যানের প্রতি মার্কিনিদের কৌত‚হল বাড়ে ১৯৭০-এর দশকে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে বহু তরুণের মতো ডা. জন কাবাত-জিনও জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে হয়ে পড়েন সন্দিহান। তখন তিনি এমআইটির গবেষক। অবশেষে ধ্যানের মধ্যে তিনি খুঁজে পান প্রশান্তির চাবিকাঠি। তার অনুপ্রেরণায় অক্সফোর্ডের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খোলা হয় মাইন্ডফুলনেস সেন্টার। বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যত হ্যাপিনেস কোর্স চালু করেছে, প্রত্যেকটির সঞ্জীবনী শক্তি মেডিটেশন।
প্রেসক্রিপশনে মেডিটেশন
যত দিন যাচ্ছে, শারীরিক ও মানসিক সুস্থতায় মেডিটেশনের গুরুত্ব তত স্পষ্ট হচ্ছে। উদ্বেগ নিরসনে নিউ সায়েন্টিস্ট যে ৫টি দাওয়াই দিয়েছে, তার অন্যতম হলো মেডিটেশন। রোগীদের শিথিলায়ন প্রেসক্রাইব করার পাশাপাশি চর্চাকারীদের তালিকায় শামিল হচ্ছেন ডাক্তাররাও।
ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে নিউইয়র্কের মেমোরিয়াল স্লোয়ান কেটারিং ক্যান্সার সেন্টারে ভর্তি হন খ্যাতিমান ইতালীয় সাংবাদিক তিজিয়ানো তেরজানি। এটি বিশ্বসেরা ক্যান্সার হাসপাতাল। সার্জারির আগে প্রধান অ্যানেস্থেশিওলজিস্টের সাথে তার সাক্ষাৎ হয়। আলাপের একপর্যায়ে শ্বেতাঙ্গ ডাক্তার বলেন, আমি কিন্তু একজন সুফি।
খোদ নিউইয়র্কে নামজাদা হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলছেন, তিনি সুফি! কী ঘটনা? পেশাগত ব্যস্ততা ও প্রতিযোগিতা তাকে ক্লান্ত অবসন্ন করে ফেলে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের বড় ডিগ্রি, স্লোয়ান কেটারিংয়ের উঁচু পদ—কিছুই তার শূন্যতা দূর করতে পারে নি। শেষমেশ তিনি প্রশান্তির সন্ধান পান ধ্যানের মধ্যে।
প্রিয় পাঠক, পুরো বিশ্বের মত আমাদের দেশেও দিনদিন মেডিটেশনের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। পরিপূর্ণ সুস্থতার জন্য বিদ্যমান চিকিৎসার পাশাপাশি মেডিটেশন যে প্রয়োজন, সেই পরামর্শ এখন চিকিৎসকরা দিচ্ছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সম্প্রতি যোগ-মেডিটেশনকে স্বাস্থ্যসেবার পরিপূরক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে।
সারা বিশ্বের মত বাংলাদেশে ২১ মে বিশ্ব মেডিটেশন দিবস পালন করা হয়। ১৯৯৫ সাল থেকে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। দিবসটি উপলক্ষ্যে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন প্রতিবছর বিভিন্ন উন্মুক্ত স্থানে প্রাণায়াম বা দমচর্চা, প্রত্যয়ন পাঠ ও মেডিটেশন চর্চার আয়োজন করে থাকে। গত ২ বছর ধরে বাংলাদেশ ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আনুষ্ঠানিকভাবে পালিত হচ্ছে দিনটি।