বাংলাদেশের ব্যাংক খাতকে ক্ষত-বিক্ষত করে পালিয়েছেন সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। গত দুই বছরে তার আশ্রয়- প্রশ্রয়ে ব্যাংক খাতে যে পরিমাণ ক্ষত তৈরি হয়েছে এমন ঘটনা অতীতে আর কখনো ঘটেনি। তিনি সকল অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করেছিলেন। আর তিনিই ছিলেন একমাত্র গভর্নর যিনি সরকার পরিবর্তনের পর পালিয়ে বেড়াচ্ছেন এবং পলাতক থেকেই পদত্যাগ করেছেন। তার আগে গভর্নর পদে দায়িত্ব পালনকারী ১১ জনের কাউকেই সরকার পতনের পর পালিয়ে যেতে হয়নি। নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর তাদের কাউকে পদত্যাগ করতেও দেখা যায়নি।
আওয়ামী লীগ সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বাদশ গভর্নর হিসেবে ২০২২ সালের ১২ জুলাই আব্দুর রউফ তালুকদারকে নিয়োগ দিয়েছিল। গভর্নর নিযুক্তির আগে অর্থ সচিব ছিলেন তিনি। চাকরি জীবনের প্রায় পুরো সময়েই কাটিয়েছিলেন অর্থ মন্ত্রণালয়ে। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত আমলা হিসেবেও পরিচিতি ছিল তার।
এছাড়া অর্থমন্ত্রণালয়ে দীর্ঘদিন থাকার সুবাধে ব্যবসায়ীদের সাথেও গভীর সম্পর্ক ছিল আব্দুর রউফ তালুকদারের। তাই তাকে গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দিতে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকেও সরকারের কাছে জোড়তদবির করা হয়েছিল। আর ব্যবসায়ীরা মূলত অতিরিক্ত সুবিধা নিতেই তালুকদারকে গভর্নর হিসেবে চেয়েছিলেন। আর গভর্নর হওয়ার পর আব্দুর রউফ তালুকদারও অকৃতজ্ঞ হননি। নিয়ম-নীতি সব সব বিসর্জন দিয়ে তিনি ব্যবসায়ীদেরকে সুবিধা দিয়েছেন। এমনকি গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার মাত্র পাঁচ দিনের মাথায় ২০২২ সালের ১৮ জুলাই ঋণ খেলাপিদেরকে বড় ছাড় দিয়ে একটি মাস্টার সার্কুলার জারি করে।
এসব বিষয়ে কথা বললে বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ব্যাংক খাতের এসব অনিয়ম তদন্তে একটা শক্তিশালী ব্যাংক কমিশন গঠন করতে হবে। গত দেড় দশকে ব্যাংক খাতে অনেক অনিয়মের ঘটনা ঘটেছিল। বিশেষ করে আব্দুর রউফ তালুকদারের আমলে অনিয়ম- দুর্নীতি বেশি বিস্তার লাভ করেছিল। ব্যাংক কমিশন গঠন হলে তখন এসব অনিয়ম- দুর্নীতির বিষয়গুলো বিশ্বাসসযোগ্যতার ভিত্তিতে খতিয়ে দেখবে।
তিনি বলেন, যদি ব্যাংক কমিশন গঠন হয় উন্নয়নের তাহলে তারা এটাও খতিয়ে দেখবে যে অনিয়মের কারণে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া যেসব কর্মকর্তা ব্যাংকগুলোতে পরিদর্শনে যান তারা যাতে স্বাধীনভাবে তদন্ত করতে পারে সেটাও নিশ্চিত করতে হবে।
সার্কুলারে আড়াই থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ অর্থ জমা দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দিয়েছিলেন। আগে যা ছিল ১০ থেকে ৩০ শতাংশ। আবার এসব ঋণ পরিশোধ করার সময় দিয়েছিলেন ৫ থেকে ৮ বছরের মধ্যে। আগে এ ধরনের ঋণ পরিশোধে সর্বোচ্চ দুই বছর সময় দেওয়া হতো।
এমনকি খেলাপি ঋণে কী সুবিধা দেওয়া হবে, তা নির্ধারণ করার পুরো ক্ষমতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের হাতে তুলে দিয়েছেন। ফলে ব্যাংকমালিকরাই ঠিক করতেন, তাঁরা ঋণখেলাপিদের কী সুবিধা দেবেন। আগে বিশেষ সুবিধায় ঋণ নিয়মিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগত, যা স্বয়ং গভর্নর অনুমোদন করতেন। কিন্তু আব্দুর রউফ তালুকদার গভর্নরের দায়িত্ব নিয়ে সেই ক্ষমতার পুরোটাই ব্যাংকগুলোর হাতে তুলে দিয়েছেন। এরপর ব্যাংকগুলো বাছবিচার ছাড়াই হাজার হাজার কোটি টাকা পুনঃতফসিল করে ব্যাংক উদ্যোক্তাদের ঋণ খেলাপি হওয়া থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। তার পরও ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমেনি।
২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষেও দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। আর চলতি বছরের মার্চে এসে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। আর পুনঃতফসিল, অবলোপন, বেনামি ঋণসহ ঝুঁকিতে রয়েছে এমন ঋণের পরিমাণ এখন ৬-৭ লাখ কোটি টাকা হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
এরপর আব্দুর রউফ তালুকদার সবচেয়ে বেশি সুবিধা দিয়েছেন এস আলম গ্রুপকে। অনিয়ম আর ঋণ জালিয়াতির কারণে দুর্বল হয়ে পড়া এস আলমের ব্যাংকগুলোকে নগদ সহায়তা দিয়ে টিকিয়ে রেখেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এমনকি এ গ্রুপের সাতটি ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলতি হিসাবে ঋণাত্মক রেখেও বিনা বাধায় লেনদেন করতো।
সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ১৬ মে পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর চলতি হিসাব ঋণাত্মক রেখে লেনদেনের সুযোগ দেওয়া হচ্ছিল মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা দিয়ে। গভর্নরের বিশেষ ক্ষমতাবলে এস আলম গ্রুপের সাতটি ব্যাংক ডিমান্ড প্রমিসরি (ডিপি) নোটের বিপরীতে এ সুযোগ পেয়ে আসছে। তবে সরকার পরিবর্তনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এসব সুবিধা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
এছাড়া, আব্দুর রউফ তালুকদারের যোগদানের সময় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ ছিল ৪১ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার। আর চলতি বছরের ৩১ জুলাই এ রিজার্ভ ২৫ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। যদিও আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী (বিপিএম৬) দেশের রিজার্ভ রয়েছে ২০ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ব্যবহারযোগ্য বা নিট রিজার্ভ রয়েছে ১৫ বিলিয়ন ডলারের ঘরে।
তারপর, আব্দুর রউফ তালুকদারের সময়ে সবচেয়ে বেশি যেটা হয়েছে সেটা হল অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও ঋণ জালিয়াতির ঘটনা। ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি কিছু ব্যাংক মালিকও বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তিনি ব্যবসায়ী এবং ব্যাংক মালিকদেরকে নিয়ন্ত্রণ না করে উল্টো তাদের অনিয়ম-জালিয়াতিগুলোকে ঢেকে রাখার কাজে বেশি বেশি ব্যস্ত থাকতেন । বিশেষ করে তিনি ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগগুলোর কর্মকর্তাদের হাত-পা বেঁধে রাখতেন। কোনো প্রভাবশালী গোষ্ঠী অনিয়ম-জালিয়াতি করলেও সেগুলোর কোনো তদন্ত তিনি করতে দিতেন না। আর কর্মকর্তা পরিদর্শনে গিয়ে যেসব অনিয়ম পেতেন সেগুলোর প্রতিবেদন জমা দিলেও কোনো অ্যাকশন হতো না।
জানা গেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের কর্মকর্তাদেরকেও তিনি কোনঠাসা করে রাখতেন। কোনো গ্রাহক কিংবা অন্য কোনো ভোক্তভোগীর কাছ থেকে অনিয়ম- জালিয়াতির অভিযোগ আসলেও তারা স্বাধীনভাবে এগুলোর সমাধান করতে পারতে না। এমনকি ছোট ছোট অভিযোগের সমাধান করতে গেলেও ডেপুটি গভর্নর (ডিজি) কিংবা গভর্নরের অনুমতি নিতে হতো।
আগে যেগুলো সংশ্লিষ্ট বিভাগের পরিচালকরাই সমাধান করতে পারতেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি এন্ড কাস্টমার সার্ভিসেস ডিপার্টমেন্ট (এফআইসিএসডি), হিউম্যান রিসোর্সেস ডিপার্টমেন্ট, ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ (বিআরপিডি), ডিপার্টমেন্ট অব অফ-সাইট সুপারভিশন (ডিওএস), বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগের মত গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, আগে কোনো ব্যাংকের বিরুদ্ধে কোনো অনিয়মের অভিযোগ উঠলেই ওই ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখায় পরিদর্শন করা হতো। অভিযোগের বিষয় তদন্ত হতো। আব্দুর রউফ তালুকদার আসার পর এগুলো খুব একটা করা হয়নি। ছোট ছোট অনেক সমস্যা সমাধান করতে হলেও ডিজির অনুমতি লাগে। তাদের কাছে গিয়ে বিভিন্ন অপ্রত্যাশিত প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। এ কারণে বড় কর্তার কাছে এমন অনেক কাজ না করে এড়িয়ে যাচ্ছেন। কারণ কাজ করলে নানা ধরণের জবাবদিহিতা করতে হয়। এর চেয়ে কাজ না করাই ভালো।
এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত প্রতিবেদনও বলছে, আব্দুর রউফ তালুকদার গভর্নর হিসেবে যোগ দেয়ার পর ব্যাংকগুলোতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শন কমে অর্ধেকে নেমেছে।
জানা গেছে, ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের ঋণ জালিয়াতিসহ বিভিন্ন অনিয়ম সনাক্তকরণে কাজ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি এন্ড কাস্টমার সার্ভিসেস ডিপার্টমেন্ট (এফআইসিএসডি)। এছাড়া, এফআইসিএসডি হল বাংলাদেশ ব্যাংকের একমাত্র ডিপার্টমেন্ট যেখানে গ্রাহকসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীও তাদের ব্যাংকিং লেনদেন সংক্রান্ত যেকোনো অভিযোগ জানাতে পারেন। গ্রাহকরা ই-মেইল, অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপস, বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইট, ডাক এবং কুরিয়ার পরিষেবার মাধ্যমেও তাদের অভিযোগ দাখিল করতে পারেন এফআইসিএসডিতে। মূলত তফসিলি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ জালিয়াতি ও অনিয়ম চিহ্নিতকরণে বিশেষ পরিদর্শন করে থাকে এফআইসিএসডি কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রতিবেদন বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরের চেয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে এফআইসিএসডি’র বিশেষ পরিদর্শন কমে প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। এছাড়া গত ২০২১-২২ অর্থবছরের চেয়ে ২০২২- ২৩ অর্থবছরে অভিযোগও এসেছে বেশি এবং সমাধান হয়েছে আগের তুলনায় কম।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে এফআইসিএসডি কর্তৃক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে মোট ১৭৯টি বিশেষ পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছিল। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিশেষ পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে ৯৪টি। সেই হিসাবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিশেষ পরিদর্শন কার্যক্রম কম পরিচালিত হয়েছে ৮৫টি বা ৪৭ শতাংশ।
এম জি