শেরপুরে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে বিবাহ বিচ্ছেদ

হাফিজুর রহমান লাভলু, শেরপুর প্রকাশ: ২০২৪-০৯-২৩ ১৫:৫৬:৩৫


কেউই বিচ্ছেদের কথা ভেবে বিয়ে করেন না। সম্পর্ক যাতে সুন্দর হয়, সে চেষ্টাও নিজের মতো করে করেন অধিকাংশে। তবু হাজার চেষ্টার পরেও অনেক সম্পর্কই সুখের হয় না। তখন নিজেদের পথ আলাদা করেও নিতে হয়। আর তারই ধারাবাহিকতায় শেরপুরে দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে বিবাহ বিচ্ছেদের হার।

গত এক বছরে শেরপুর জেলায় মোট বিবাহ নিবন্ধন হয়েছে ৮হাজার ৭২০টি সেই হিসেবে একই সময়ে তালাক নিবন্ধন‌‌‌ হয়েছে ৩ হাজার ৮৪৪টি।যা বিবাহের তুলনায় বিচ্ছেদের পরিমাণ দাড়িছে প্রায় ৪৪ শতাংশ। বিয়ে যত ধুমধামের মধ্য দিয়ে হয় তালাক সেভাবে সম্পন্ন হয় না। তালাক প্রক্রিয়া অনেক পরিবার অতি গোপনে সম্পন্ন করায় অনেক তালাক নিবন্ধনের আওতায় আসে না। তাই সংশ্লিষ্টদের ধারণা প্রকৃত বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা আরও বেশি হবে। এ ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় বিচ্ছেদে নারীরাই বেশি এগিয়ে বলে জানা গেছে।

জেলার বিভিন্ন এলাকায় বিবাহ বিচ্ছেদের পেছনে বড় কারণগুলো হলো, দাম্পত্যজীবনে বনিবনার অভাব, যৌতুক, বাল্যবিবাহ এবং বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক। তবে শেরপুরে ডিভোর্সের মধ্যে শিক্ষিত লোকের সংখ্যাই বেশি। সাধারণ মানুষের মধ্যে এই প্রবণতা কিছুটা কম। তবে পরিবারের অমতে লুকিয়ে করা প্রেম ঘটিত বিয়ে ভাঙার হার অনেক বেশি। যে সব প্রেমের বিয়ে পরিবারের সদস্যদের সম্মতিক্রমে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পন্ন হয়েছে সেগুলো ভাঙার হার খুব কম।

এ ছাড়াও জেলায় কিছু কিছু পরিবারে দীর্ঘ দিন সন্তান না হওয়ার ক্ষেত্রে বিচ্ছেদ হলেও পরিমাণে আগের তুলনায় কমেছে। জেলার বিভিন্ন পৌরসভা ও ইউনিয়নে দায়িত্বরত কাজী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সাথে কথা বলে উঠে আসে এই চিত্র। শেরপুর জেলা রেজিস্ট্রার অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত ১ বছরে শেরপুরে বিবাহ বিচ্ছেদ তুলনামূলকভাবে বেড়েছে। ২০২৩ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ১ বছরে জেলায় মোট বিবাহ নিবন্ধন হয়েছে ৮হাজার ৭২০টি। এর মধ্যে শেরপুর সদর উপজেলার ২ হাজার ৫৮৯টি, নকলা উপজেলায় ৯৮৯টি, নালিতাবাড়ী উপজেলায় ২ হাজার ৩৮৬টি, শ্রীবরদী উপজেলায় ১ হাজার ৭১৩টি ও ঝিনাইগাতী উপজেলা ১ হাজার ৪৩ টি। ঠিক এই একই সময়ে তালাক নিবন্ধন‌‌‌ হয়েছে ৩ হাজার ৮৪৪টি। যা মোট বিবাহ নিবন্ধনের ৪৪ শতাংশ। এর মধ্যে শেরপুর সদর উপজেলায় ১ হাজার ৯১টি, নকলা উপজেলায় ৫১১টি, নালিতাবাড়ী উপজেলায় ৯২১টি, শ্রীবরদী উপজেলায় ৮৯৫টি ও ঝিনাইগাতী উপজেলায় ৪২৬টি।

আনুপাতিক হারে জেলার শ্রীবরদী উপজেলায় সবচেয়ে বেশি বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে যা ৫২.২৫ শতাংশ এবং সবচেয়ে কম বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে নালিতাবাড়ী উপজেলায় যা ৩৮.৬০ শতাংশ।

জেলার বেশ কয়েকজন কাজীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগে তালাকের প্রধানতম কারণ ছিল দারিদ্রতা বা পারিবারিক ব্যয় বহনের অক্ষমতা। সেই সঙ্গে শ্বশুর-শাশুড়ির দ্বন্দ্বের জের ধরে পারিবারিক অশান্তি শেষে তালাক। এ ছাড়াও নানা কলহ-বিবাদের জেরে স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর শারীরিক নির্যাতনের ফলে। এ সমস্যাগুলো যেসব এলাকায় অভাব-দারিদ্র্য যত বেশি সেসব এলাকায় তালাক বেশি হতো।

অনেক ক্ষেত্রে গ্রামের দরিদ্র বাবা-মার সন্তান লালন-পালনের সক্ষমতা কম থাকায় মেয়ে সন্তান একটু বড় হলেই বিয়ে দিয়ে দিত। তুলনামূলক অনেক বেশি বয়সের স্বামীর ঘর করতে না পারায় হতো তালাক। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ধর্মীয় অনুশাসন কমে গিয়ে নৈতিক অবক্ষয় বেড়ে যাওয়া অবাধ তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক স্থাপনের হার বৃদ্ধি পাওয়ায় তালাক বেশি হচ্ছে।
আধুনিক যুগে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রেম যতটাই বেশি, বিচ্ছেদও ঠিক ততটাই। সবচেয়ে বেশি বিবাহ বিচ্ছেদ হয় ভালোবাসার অভাব ও নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির কারণে। বর্তমানে সম্পর্কের দুজনেই দুজনের ভুল ধরতে ব্যস্ত। শোধরাতে নয়। তাই সব শেষে বিয়ে ভেঙে দেওয়ার রাস্তায় হাঁটেন তারা।

শেরপুর পৌরসভার কাজি আবুজর আল আমিন বলেন, আমি প্রতিদিনই বিয়ের নিবন্ধন করি। আবার তালাক নিবন্ধনও করি। আমি বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পর স্বামী ও স্ত্রী উভয় পক্ষকে কাবিননামার বিষয়বস্তু ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়ে দুই পক্ষকে নকল প্রদান করি। আগে তালাক রেজিস্ট্রেশন কম হতো, এখন অনেক বেড়েছে। যা খুবই দুঃখজনক ও আশঙ্কাজনক। আমার দেখায় শিক্ষিতরা তালাকে সব চেয়ে এগিয়ে। আগে ছেলেদের পক্ষ থেকে তালাক বেশি হতো। এখন মেয়েদের পক্ষ থেকে তালাক বেশি হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেয়েদের অতিরিক্ত জেদের কারণে তালাক হচ্ছে।

এ ব্যাপারে জেলার শ্রীবরদী উপজেলার প্রবীণ শিক্ষক মৌলভী নুরুল ইসলাম বলেন, আমি একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে অবসরে আছি। আমার স্ত্রী স্বাস্থ্য বিভাগে সরকারি চাকরি থেকে অবসরে গেছেন। আমাদের সংসারে দুই ছেলে দুই মেয়ে। বর্তমানে আমার দুই ছেলে এবং দুই মেয়ের উভয় পক্ষের নাতিদেরও সন্তান হয়ে গেছে। তারাও এখন স্কুলে পড়ে। আমি বড় বাবা হয়ে গেছি। আমার ৫০ বছরের অধিক সময়ের দাম্পত্য জীবনে কোনো কলহের সৃষ্টি হয়নি। কারণ হিসেবে আমার কাছে মনে হয়েছে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা। আমাদের এক সঙ্গে চলার দীর্ঘ সময় পারস্পরিক বিশ্বাস, পারস্পরিক সম্পর্ক, একে অপরের হক সম্পর্কে সচেতনতা, বিনয় ও ছাড়ের মানসিকতা ছিল। এরপর আমার স্ত্রী ও মেয়েদের পর্দা রক্ষা করা, পর পুরুষ কিংবা পরনারীর সঙ্গে সম্পর্ক ও মেলামেশা থেকে বিরত থেকেছি।

এ ছাড়াও তিনি বলেন, আমরা যেহেতু দুজনই চাকরি করতাম তখন ছেলে-মেয়েদের দেখাশোনা ও পড়াশোনা সমস্যা হতো। তবুও দায়িত্ব বণ্টন করে চাকরি সংসার এগিয়ে নিয়ে সন্তানদের লেখাপড়া করিয়েছি। কখনো মতের অমিল হলে বুঝিয়ে সমাধান করেছি। নিজেরা সমাধান না করতে পারলে মুরুব্বিদের সহযোগিতা নিয়েছি। বৈবাহিক জীবনে ছোটখাট অমিল থাকবেই সেটা মানিয়ে নিয়ে চলতে হবে।

এ ব্যাপারে জেলার সবচেয়ে বড় ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামিয়া সিদ্দিকীয়া তেরাবাজার মাদ্রাসার মুহতামিম মাওলানা সিদ্দিক আহমাদ বলেন, ডিভোর্সের ফলে দুজনের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অন্য জীবনগুলোও সমস্যায় পড়ে। এটা সামাজিক বন্ধনকে শিথিল করে দেয়, যা মুসলিম সমাজের জন্য খুবই দুঃখজনক ও আশঙ্কাজনক।

ইসলামে ডিভোর্সের প্রতি নানাভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে অপ্রিয় হালাল হচ্ছে তালাক।’ সুনানে ইবনে মাজাহ: ২০১৮।
তিনি আরও বলেন, বর্তমান সময়ে ইন্টারনেটের মাধ্যমে যোগাযোগ সহজলভ্য হওয়ায় বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জড়াচ্ছে নারী-পুরুষ। তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ ব্যবহারের কুফলগুলোর মধ্যে এটি একটি। তবে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে জীবন পরিচালনার করলে কখনোই কোনো মানুষ বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়াবে না। কোনো সুযোগই নেই। প্রতিটি ধর্মেই এই মর্মবাণীগুলোই আছে। তিনি ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।

বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে অ্যাডভোকেট আলমগীর কিবরিয়া কামরুল বলেন, বিবাহবিচ্ছেদ দিন দিন বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ হচ্ছে তথ্য প্রযুক্তির অবাধ প্রবাহ, ভারতীয় টিভি চ্যানেলের সিরিয়াল, পরকীয়া, অপরিণত বয়সে বিয়ে, পারিবারিক বন্ধনে দূরত্ব সৃষ্টির পাশাপাশি মানুষের মধ্যে শ্রদ্ধাবোধ কমে যাওয়া।

তালাকের মূল কারণ অনুসন্ধানে কথা হয় কুড়িকাহনিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফিরোজ খান নুন এর সঙ্গে। তিনি বলেন, বর্তমান সময়ে মানুষের ধৈর্য ক্ষমতা একেবারে কমে গেছে। ছোট ছোট কারণেই সংসারে বিবাদ তৈরি হচ্ছে। কেউ কাউকে ছাড় দিচ্ছে না। এটা পারিবারিক শিক্ষার একটি অংশ। আমরা আমাদের সন্তানকে অধিকার সম্পর্কে শিক্ষা দিলেও নৈতিক শিক্ষা দিচ্ছি না। সেই সঙ্গে ধর্মীয় অনুশাসনে আমাদের সন্তানরা শিক্ষা পাচ্ছে না। এতে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রতিদিনই দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হচ্ছে। এমন কোনো দিন নেই যেদিন ইউনিয়ন পরিষদে পারিবারিক আদালতে এমন সালিশ আমাদের করতে হচ্ছেনা। বিবাহ বিচ্ছেদে স্বামীর প্রতি স্ত্রীর এবং স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব-কর্তব্য এবং শ্রদ্ধাবোধ থাকাটা জরুরি যা এখনকার প্রজন্মের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কমে গেছে।

এ ব্যাপারে শেরপুর জেলা রেজিস্টার কৃষিবিদ মো. নূর নেওয়াজ বলেন, আমরা শুধু বিবাহ রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করি। হোক সেটা বিবাহ অথবা তালাক। আমাদের এর বাইরে আর কোনো কাজ নেই। তবে প্রত্যেক কাজীই বিবাহ নিবন্ধনের সময় স্বামী এবং স্ত্রীর হক ও দ্বায়িত্ব কর্তব্যসমূহ উভয়কেই জানিয়ে দেয়। যেন তারা তাদের দাম্পত্য জীবনে নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে পারে। এ ছাড়াও বিয়ে সম্পন্ন করে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলারও পরামর্শ দেওয়া হয়।

এম জি