# দিশেহারা বিনিয়োগকারীদের বিক্রয় চাপে একদিনেই ডিএসইএক্স কমলো ৩ শতাংশ
# বিএসইসি চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবিতে অব্যাহত মানববন্ধন গতকালও চলমান ছিল
# একদিনেই বাজার মূলধন কমেছে পৌনে ১০ হাজার কোটি টাকা
দেশের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের রক্তক্ষরণ বেড়েই চলেছে। প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সূচক কমতে কমতে সাড়ে তিন বছরে সূচকের সর্বোচ্চ পতন দেখেছে বিনিয়োকারীরা। গতকাল রোববার সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ার দরপতন হারানোয় ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স ১৪৯ দশমিক ২০ পয়েন্ট হারিয়ে ৪৯৬৫ দশমিক ৩৯ পয়েন্টে নেমেছে। এতে দিশেহারা বিনিয়োগকারীদের বড় একটি অংশ খোদ নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবিতে একমাসেরও বেশি সময় ধরে আন্দোলন করে যাচ্ছে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের পুঁজিবাজার মানেই দর পতনের ইতিহাস। তবে যখন রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সংস্কার চলছে, অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার আভাস মিলছে, তখন এমন দর পতন মেনে নেওয়া যায় না। অর্থনীতির বড় সংকটের মধ্যে থেকেও সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার সহায়তায় শ্রীলঙ্কার পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। পাকিস্তানের পুঁজিবাজার উঠেছে রেকর্ড উচ্চতায়। অথচ দেশের পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা পুঁজি হারিয়ে প্রতিদিন হতাশ হচ্ছেন।
এ বিষয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক পরিচালক ও বিএলআই সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে, পুঁজিবাজারের হাল কতটা করুণ। অথচ দায়িত্বশীল কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান থেকে এমন কোনো বক্তব্য বা বিবৃতি নেই, যা দেখে বাজারের এই দুরবস্থার কথা মানুষ জানতে পারবে।
শেয়ারবাজার পরিস্থিতি
বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, ডিএসইর সার্বিক সূচক ডিএসইএক্স গতকাল একদিনেই ১৪৯ দশমিক ২০ পয়েন্ট হারিয়ে ৪ হাজার ৯৬৫ দশমিক ৩৯ পয়েন্টে নেমেছে। সূচকের এই পতন হার ২ দশমিক ৯১ শতাংশ। হার বিবেচনায় গতকালের এই পতন ২০২১ সালের ৪ এপ্রিল বা গত সাড়ে তিন বছরের সর্বোচ্চ। ওই দিন ঢাকার পুঁজিবাজারের ডিএসইএক্স সূচকটি ১৮১ পয়েন্ট বা ৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ হারিয়ে ৫ হাজার ৮৯ পয়েন্টে নেমেছিল। এদিকে গতকালের পতনের মাধ্যমে ডিএসইক্স প্রায় ৪ বছর বা ৪৭ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমে এসেছে। এর আগে ২০২০ সালের ২ ডিসেম্বর সূচকটি ৪ হাজার ৯৩৪ পয়েন্টে নেমেছিল।
এক্সচেঞ্জটির অন্য সূচকগুলোর মধ্যে গতকাল ডিএসই শরিয়াহ সূচক ৩৬ দশমিক ২৮ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ১০৮ পয়েন্টে নেমেছে। আর বাছাইকৃত ৩০ কোম্পানির সূচক ডিএস৩০ দিনের ব্যবধানে ৪৮ দশমিক ১৮ পয়েন্ট হারিয়ে ১ হাজার ৮৩০ পয়েন্টে নেমেছে।
ঢাকার শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ৩৯৭ কোম্পানির শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে গতকাল ৩৯৪টির কেনাবেচা হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ২৯টির দর বেড়েছে। বিপরীতে ৩৪১টিই দর হারিয়েছে। কমপক্ষে ৫ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ১৬ শতাংশ পর্যন্ত দর হারিয়েছে ১৫৯টি শেয়ার। আর ২৬টির দর এদিন অপরিবর্তিত রয়েছে।
বাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে যাওয়ার কারণেই এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বাজার সূত্রে জানা গেছে, বাজারের পতনে আতঙ্কিত বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে দেওয়ার চেষ্টা করছেন, কিন্তু শেয়ার কেনার ক্রেতা একদমই কম। অনেক বিনিয়োগকারী তাদের বিও হিসাব বন্ধ করে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন।
এমন পরিস্থিতিতে গতকাল ডিএসইতে লেনদেনের পরিমাণও। এদিন লেনদেন হয়েছে ৩০৩ কোটি ৮০ লাখ টাকার শেয়ার। যেখানে আগের কার্যদিবসে লেনদেন হয়েছিল ৩০৬ কোটি ০১ লাখ টাকার শেয়ার। লেনদেন কমেছে ২ কোটি ২১ লাখ টাকা। গত দুই মাসের বেশি সময়ে পুঁজিবাজারের অব্যাহত দরপতনে হাজার হাজার কোটি টাকার বাজার মূলধন হারিয়েছে বিনিয়োগকারীরা। গতকাল একদিনেই বাজার মূলধন কমেছে পৌনে ১০ হাজার কোটি টাকা।
মিডওয়ে সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আশেকুর রহমান বলেন, অবশ্যই অর্থনৈতিক, রাজনৈতিকসহ আগের সমস্যাগুলো আছে। তবে এখন প্যানিক সেল এবং যারা ঋণ নিয়ে শেয়ার ক্রয় করেছিলেন, তাদেরকে ফোর্সড সেলের মধ্যে পড়তে হচ্ছে। বাজারে ট্রাস্ট (আস্থা) বড় ইস্যু। গত কয়েক দিন ধনে ভালো শেয়ারের দাম পড়ে গেছে। অর্থাৎ বিনিয়োগকারীরা আস্থা থেকে অনেকখানি দূরে চলে গেছেন। এখন তারা সব শেয়ার বিক্রি করে পুঁজি যতটুকু সম্ভব রক্ষা করার চেষ্টা করছেন।
বিএসইসি চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবিতে মানববন্ধন
এদিকে অব্যহত দরপতনে ফুঁসে ওঠা বিনিয়োগকারীরা গতকালও বিএসইসি চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের পদত্যাগ দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচী পালন করেছেন। রাজধানীর মতিঝিলে পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের ব্যানানে এদিন দুপুরে কয়েকশ বিনিয়োগকারী আন্দোল করেন। তারা বিএসইসির চেয়ারম্যানকে অযোগ্য দাবি করে তার পদত্যাগ দাবি করেন। বলেন, বিএসইসি চেয়ারম্যান শেয়ারবাজার বুঝেন না। যার কারণে আমরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছি। এই লোকের পদত্যাগ খুবই জরুরী। যার কোন বিকল্প নেই।
তবে বিএসইসির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পুঁজিবাজারে লেনদেনে সুশাসন ফেরাতে এ সংস্থা আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিছু বিনিয়োগকারীরা যেভাবে দাবি করছেন, এ কমিশনের কারণে দরপতন হচ্ছে, আদতে তা সত্য নয়। বর্তমান কমিশন কারসাজিমুক্ত একটি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক শেয়ারবাজার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছে।
এ বিষয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ‘তারল্য বৃদ্ধির জন্য প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বিশেষ করে ব্যাংক, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি এবং অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি, যারা মিউচুয়াল ফান্ড পরিচালনা করে তাদের দিক থেকে বিনিয়োগ আসবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।’