কাগুজে প্রতিষ্ঠানকে ১৬৩৫ কোটি টাকা ঋণ আইএফআইসি ব্যাংকের
আপডেট: ২০২৪-১০-৩০ ১২:০৩:২২
- ঋণ অনুমোদনে বাধ্য করেন সালমান এফ রহমান
- কাগজে আমদানি-রপ্তানি, বাস্তবে কিছুই নেই
- দেড় বছরে গড়ে উঠে তিন প্রতিষ্ঠান
- ব্যবসায়িক প্রোফাইলে বিস্তর অসামঞ্জস্যতা
- প্রান্তিক পর্যায়ে রয়েছে আইসিআরআর
- ঋণ পরিশোধে নেই সক্ষমতা
মাত্র দেড় বছরের কোম্পানি, ঋণ পরিশোধের নেই সক্ষমতা, ব্যবসার ধরণ আমদানি-রপ্তানি দেখালেও আমদানি-রপ্তানির নেই কোনো তথ্য, প্রাক্কলিত নগদ প্রবাহ কম থাকলেও প্রাক্কলিত নিট মুনাফা দেখানো হয়েছে অনেক বেশি, আইসিআরআর একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে এবং ব্যবসায়িক প্রোফাইলেও রয়েছে বড় অসামঞ্জস্যতা, তারপরও এমন তিনটি কাগুজে প্রতিষ্ঠানকে ৬৭৫ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে আইএফআইসি ব্যাংক। শুধু এখানেই শেষ নয়, গত ২৪ জুন আবার এই তিন ভুয়া প্রতিষ্ঠানের ঋণ সীমা ৯৬০ কোটি টাকা বৃদ্ধি করেছে ব্যাংকটি। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা।
প্রতিষ্ঠানগুলো হল গ্লোয়িং কন্ট্রাকশন এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ভিস্তা ইন্টারন্যাশনাল ও স্কাইমার্ক ইন্টারন্যাশনাল। চলতি বছরের ২৪ জুন এবং ১ জুলাই অনুষ্ঠিত আইএফআইসি ব্যাংকের ৮৮৭ ও ৮৮৯তম বোর্ড সভায় তিনটি প্রতিষ্ঠানের ঋণ সীমা (ওডি) ৯৬০ কোটি টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
জানা যায়, গ্রাহকের ঋণ আবেদন, শাখা কর্তৃক ঋণ প্রস্তাবনা প্রধান কার্যালয়ে প্রেরণ, পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক অনুমোদন ও সবশেষে সব ধরনের নিয়মকানুন উপেক্ষা করে উল্লিখিত ঋণ বিতরণসহ ইত্যাদি অস্বাভাবিক কার্যক্রম একই দিনে বা স্বল্প সময়ে সম্পন্ন করা হয়। ঋণের সদ্ব্যবহার ও প্রকল্প পরিদর্শন করে যথাযথ প্রক্রিয়ায় ঋণ বিতরণ হয়নি।
তথ্য বলছে, আএফআইসি ব্যাংক পিএলসির প্রিন্সিপাল শাখার গ্রাহক যথাক্রমে গ্লোয়িং কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লি., ভিস্তা ইন্টারন্যাশনাল লি. এবং স্কাইমার্ক ইন্টারন্যাশনাল লি.-এর অনুকূলে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঋণ দেওয়ায় অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান এবং ব্যাংকের সদ্য সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী (পরবর্তী সময়ে ব্যাংকের অ্যাডভাইজর) শাহ আলম সারোয়ার।
প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানসমূহের অনুকূলে হিসাব খোলার মাত্র দেড় বছরের মধ্যে ৩টি প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে সর্বমোট ৯৬০ কোটি টাকার ওডি (অন্যান্য) ঋণের সীমা বৃদ্ধিসহ মোট স্থিতি ১৬৩৫ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা ঋণের সদ্ব্যবহার বিষয়ক অনিশ্চয়তার ঝুঁকি তৈরি করে। এছাড়া, পরিচালকগণ আমদানি ও রপ্তানি কার্যক্রমের সাথে জড়িত থাকলেও স্মারক পর্যালোচনায় তাদের আমদানি রপ্তানি সংক্রান্ত কোনো তথ্য যেমন: রপ্তানি/আমদানির পরিমাণ, পণ্যের বিস্তারিত বিবরণ, আমদানিকৃত পণ্যের দেশ বা উৎপত্তি, ট্রাক রিসিট প্রভৃতি পাওয়া যায় না।
এছাড়া, প্রতিষ্ঠান তিনটির ঋণ পরিশোধ ও সক্ষমতা যাচাই সংক্রান্ত বিষয়ে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠান ৩ টির ব্যবসায়িক সাফল্য ও ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা যাচাই সংক্রান্ত লিভারেজ রেশিও, তারল্য, পরিচালন দক্ষতা, এবং উপার্জন সক্ষমতা অগ্রহণযোগ্য পর্যায়ে এবং অন্যান্য নির্দেশকসমূহ প্রান্তিক পর্যায়ে রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে আইএফআইসি ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর সৈয়দ মনসুর মোস্তফাকে একাধিকবার ফোন করলে তিনি রিসিভ করেন নি। তার হোয়াটসঅ্যাপে জানতে চেয়ে মেসেজ দিলেও তিনি রিপ্লাই দেন নি।
এ বিষয়ে কথা বললে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, এগুলো ভুয়া লোন। এসব ঋণের আসল সুবিধাভোগী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান। তিনি প্রভাব খাটিয়ে কাগুজে প্রতিষ্ঠান খুলে ব্যাংকের বোর্ডকে ঋণ অনুমোদন দিতে বাধ্য করতেন।
জানা গেছে, ইতোমধ্যে বড় অঙ্কের ঋণ কেলেঙ্কারির বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ করেছে আইএফআইসি ব্যাংকের নতুন গঠিত পরিচালনা পর্ষদ।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভিস্তা ইন্টারন্যাশনাল লি. হিসাব খুলেছে ২০২২ সালের ১০ অক্টোবর। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত আইএফআইসি ব্যাংকের প্রতিষ্ঠানটির বিদ্যামন ঋণ ছিল ১৮০ কোটি টাকা। আর প্রতিষ্ঠানটির ঋণ সীমা আরও (ওডি) বৃদ্ধি করেছে ২৯০ কোটি টাকা। এটার মোট ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৪৭০ কোটি টাকা। জামানতের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি ৬ মাসের ডেফারেল সুবিধা নিয়েছে। এছাড়া, প্রতিষ্ঠানটির ইন্টারনাল ক্রেডিট রিস্ক রেটিং (আইসিআরআর) অন্যান্য সূচকগুলোই একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে রয়েছে। আর তাদের ব্যবসার ধরণে আমদানি রপ্তানির কথা বলা হলেও আমদানি-রপ্তানির কোনো বিস্তারিত তথ্য তারা প্রদর্শন করেনি।
তথ্যানুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটি ২০২৪ সালের প্রাক্কলিত নগদ প্রবাহ ধরা হয়েছে মাত্র শূন্য দশমিক শূন্য ১ কোটি টাকা। কিন্তু প্রাক্কলিত নিট মুনাফা দেখিয়েছে ৯১ দশমিক ৮৯ কোটি টাকা। যেটা মাটেও বাস্তবসম্মত নয়। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির নিট ওয়ার্থ শূন্য দশমিক ৭৭ কোটি টাকা। আর পরিচালকদের নিট ওয়ার্থ শূন্য দশমিক ২৮ কোটি টাকা। আর পরিশোধিত মূলধন রয়েছে মাত্র ১ কোটি টাকা।
এছাড়া, প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসায়িক প্রোফাইলের বাস্তবতার সাথে বিস্তর অসামঞ্জস্যতা লক্ষ্য করা যায়। ভিস্তা ইন্টারন্যাশনাল লিঃ এর ক্ষেত্রে মাত্র ১ বছরের ব্যবধানে নিরীক্ষিত ও অনিরীক্ষিত পরিচালন মুনাফা, নিট মুনাফা ও নেট ওয়ার্থ এর মধ্যে যথাক্রমে ২,৩৬৭.৫২%, ১১,৮১৭.৯০% ও ১১,৯১৭.৯০% পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়েছে।
প্রতিবেদন বলছে, স্কাইমার্ক ইন্টারন্যাশনাল লি. হিসাব খুলেছে ২০২২ সালের ৩ আগস্ট। জুন শেষে প্রতিষ্ঠানটির ঋণের স্থিতি ছিল ১৪৫ কোটি টাকা। আর প্রতিষ্ঠানটির ঋণ সীমা বৃদ্ধি করেছে ৪০০ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির মোট ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৫৪৫ কোটি টাকা। জামানতের ক্ষেত্রে ডেফারেল সুবিধা নিয়েছে ৬ মাস। প্রতিষ্ঠানটির ইন্টারনাল ক্রেডিট রিস্ক রেটিং (আইসিআরআর) অন্যান্য সূচকগুলোই একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে রয়েছে।
তথ্য বলছে, প্রতিষ্ঠানটি ২০২৪ সালের প্রাক্কলিত নগদ প্রবাহ দেখিয়েছে মাত্র শূন্য দশমিক শূন্য ৪ কোটি টাকা। কিন্তু একই বছরের প্রাক্কলিত নিট মুনাফা দেখিয়েছে ৭৯ দশমিক ১৩ কোটি টাকা। যেটা সম্পূর্ণ অবাস্তব। আর প্রতিষ্ঠানটির পরিশোধিত মূলধন হল ১ কোটি টাকা।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, গ্লোয়িং কন্ট্রাকশন এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লি. হিসাব খুলেছে ২০২২ সালের ১৩ ডিসেম্বর। আইএফআইসি ব্যাংকের প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান ঋণের স্থিতি ৩৫০ কোটি টাকা। আর নতুনভাবে আরও অনুমোদন দিয়েছে ২৭০ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির মোট ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৬২০ কোটি টাকা।
প্রতিবেদন বলছে, প্রতিষ্ঠানটির ইন্টারনাল ক্রেডিট রিস্ক রেটিং (আইসিআরআর) অন্যান্য সূচকগুলোই একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে রয়েছে। জামানতের ক্ষেত্রেও তিন মাসের ডেফারেল সুবিধা নিয়েছে।
প্রতিষ্ঠান তিনটির দেয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক তার প্রতিবেদনে বলেছে, ২০২৪ সালে দুটি প্রতিষ্ঠানের নগদ প্রবাহ মাত্র ০.০১ কোটি টাকা ও ০.০৪ কোটি টাকা ধরা হলেও প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাক্কলিত নিট মুনাফার পরিমাণ যথাক্রমে ১৩৭.০৮ কোটি টাকা, ৯১.৮৯ কোটি টাকা ও ৭৯.১৩ কোটি টাকা এবং প্রাক্কলিত নিট ওয়ার্থের পরিমাণ যথাক্রমে ১৩৮.০৮ কোটি টাকা, ৯২.৬৬ কোটি টাকা ও ৮১.১০ কোটি টাকা, যা মোটেই বাস্তবসম্মত নয় মর্মে প্রতীয়মান হয়। ঋণের সোর্স অব পেমেন্ট হিসাবে গ্রাহকের নিজস্ব সোর্সের কথা উল্লেখ থাকলেও গ্রাহকগণের অন্যান্য ব্যবসা সংশ্লিষ্ট স্টক রিপোর্ট এর তথ্য স্মারকে নেই এবং পরিচালকগণের নিট ওয়ার্থ এর পরিমাণ প্রদত্ত ঋণের চেয়ে অনেক কম। ৩টি প্রতিষ্ঠানের প্রতিটির পরিশোধিত মূলধন মাত্র ১ (এক) কোটি টাকা। এছাড়াও, প্রতিষ্ঠান ৩টির নিজ নামে বা পরিচালকগণের নামে বা অপর কোন গ্রুপের নামে ব্যাংকিং খাতে কোন দায় না থাকায় সিআইবি পর্যালোচনায় গ্রাহকের পরিশোধ আচরণ যাচাই করার কোন সুযোগ নেই।
এএ