রেমিট্যান্স প্রাপ্তি ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার ক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রণালয়ে বায়োমেট্রিক ভেরিফিকেশনের সুপারিশ করা হয়েছে। মূলত অবৈধ লেনদেন ও উগ্রবাদী অর্থায়ন ঠেকাতেই ব্যাংকিং সেবায় জাতীয় পরিচয়পত্রের পাশাপাশি বায়োমেট্রিক ভেরিফিকেশন চালু করা যায় কিনা- তা বিবেচনা করার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কাছে সুপারিশ করেছে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহা-পরিদফতর। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্রে জানা যায়, সন্ত্রাসী বা জঙ্গি কর্মকাণ্ডের জন্য বিদেশ থেকে আসা অর্থ নিরীহ গ্রাহকদের নকল জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে তোলা হচ্ছে। অর্থ তুলতে যেন কোনো সমস্যায় পড়তে না হয়, সেজন্য দুষ্কৃতকারীরা গ্রহীতার কাছে সিকিউরিটি কোডও সরবরাহ করছে। ফলে সহজেই এ অর্থ তোলা যাচ্ছে। এতে একদিকে যেমন নিরীহ গ্রাহকটি ফেঁসে যাচ্ছেন, অন্যদিকে জঙ্গিরাও অর্থের গন্তব্যস্থল গোপন রাখতে পারছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি পাঠিয়েছে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহা-পরিদফতর। এতে অনলাইনে জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাই ব্যবস্থা আরও কার্যকর এবং অর্থ লেনদেন ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার ক্ষেত্রে বায়োমেট্রিক ভেরিফিকেশন চালুর কথা বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. ইউনুসুর রহমান চিঠি পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়পত্র অনলাইনে যাচাই আরো নিখুঁত করা যায় কিনা- তা আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। পাশাপাশি ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র শনাক্তকরণে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হবে। অবৈধ বা সন্ত্রাসে লেনদেন ঠেকাতে বিকল্প হিসেবে বায়োমেট্রিক পদ্ধতির ব্যবহার করারও চিন্তাভাবনা আমাদের রয়েছে। তবে পুরো বিষয়টিতে সিদ্ধান্ত নিতে আমরা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বসব। জঙ্গি অর্থায়ন রোধে সম্ভাব্য সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমে বলেন, এটি একটি ভালো উদ্যোগ। তবে তথ্যপ্রযুক্তির দুর্বলতার কারণে অনেক সময় বিপত্তি দেখা দেয়। তাই এসব ক্ষেত্রে সাইবার নিরাপত্তার বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করা দরকার।
প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহা-পরিদতফরের চিঠিতে উল্লেখ আছে, প্রবাসে অবস্থানকারী বাংলাদেশিরা তাদের রেমিট্যান্স বা প্রবাস আয় সাধারণত ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের মানি অ্যাক্সচেঞ্জ, বিএ এক্সপ্রেস, আরআইএ, মানিগ্রাম ইত্যাদি এজেন্টের মাধ্যমে বাংলাদেশে পাঠান। সম্প্রতি উগ্রবাদী অর্থায়ন বন্ধ করার লক্ষ্যে বিদেশ থেকে পাঠানো রেমিট্যান্সের উৎস ও গন্তব্যস্থল সঠিকভাবে শনাক্তকরণ বিশেষভাবে জরুরি হয়ে পড়েছে। সন্ত্রাসীরা ইচ্ছে করে টাকার গন্তব্যস্থল গোপন রাখতে চায়। এজন্য তারা নিরীহ অপরিচিত মানুষের নামে গ্রাহকের অজ্ঞাতসারে বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স গ্রহণের একটি পদ্ধতি অবলম্বন করছে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে প্রতিবেদনে টাকা পাঠানোর বিভিন্ন পদ্ধতি ও অবৈধ বিষয়ের ওপর আলোকপত করা হয়েছে। উল্লেখ করা হয়েছে, প্রবাস থেকে টাকা পাঠানোর পর বিভিন্ন রেমিট্যান্স এজেন্টের মাধ্যমে প্রাপ্ত টাকা বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে উত্তোলনের সময় সাধারণত জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি প্রদর্শন বা জমা করতে হয়। এ ছাড়া বিদেশ থেকে পাঠানো সিকিউরিটি কোড সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে প্রদান করতে হয়।
গুরুতর অভিযোগ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রেমিট্যান্সের টাকার গন্তব্যস্থল গোপন রাখার জন্য দুষ্কৃতকারীরা সাধারণত অন্য কোনো নিরীহ ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র নকল করে তা জমা করে। অপরদিকে দুষ্কৃতকারীর কাছ থেকে বিদেশ থেকে প্রেরক সরাসরি সিকিউরিটি কোডটি ই-মেইল বা এসএমএসের (ক্ষুদে বার্তা) মাধ্যমে পাঠিয়ে দেন।
টাকা গ্রহণকালে যখন কোনো গ্রাহক তার জাতীয় পরিচয়পত্র (যা অন্য কোনো ব্যক্তির নামে তৈরি নকল পরিচয়পত্র) এবং সঠিক সিকিউরিটি কোড সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কাছে উপস্থাপন করেন তখন ওই ব্যাংকটি ওই গ্রাহকের কাছে বিনা দ্বিধায় অর্থ প্রদান করে। এর ফলে টাকার প্রকৃত গন্তব্যস্থল গোপন রাখা সম্ভব হয়।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, জাতীয় পরিচয়পত্রের সঠিকতা যাচাই করার জন্য সব ব্যাংকের নিকট নির্বাচন কমিশন থেকে একটি সংযোগ প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু সরেজমিন যাচাইকালে দেখা যায়, ওই সংযোগ ব্যাংকগুলোর প্রধান শাখা কিংবা দুই-একটি নির্ধারিত শাখায় সীমাবদ্ধ রয়েছে। ফলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ব্যাংকগুলোর শত শত জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাই করা এই পদ্ধতি সহজলভ্য নয়।
জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাই করার পদ্ধতি সহজলভ্য না থাকায় দুষ্কৃতকারী কর্তৃক বেনামে ব্যাংক অ্যাকউন্ট করার সুযোগ থেকে যায়। ফলে বেনামি অ্যাকাউন্টে বিভিন্ন অবৈধ অর্থ লেনদেনের অনেক উদাহরণ রয়েছে। এ বিষয়ে একটি কেস স্টাডিও প্রতিবেদনে জুড়ে দেয়া হয়েছে। এখানে একজন ভুয়া পরিচয়পত্র দিয়ে অর্থ লেনদেন করেছে। ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে ব্যাংকগুলোতে অসংখ্য লেনদেন হচ্ছে বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
এসব ঘটনার প্রেক্ষাপটে অবৈধ অর্থ লেনদেন, মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসীদের অর্থ জোগান বন্ধে আরো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র অনলাইনে ভেরিফিকেশন বাধ্যতামূলক করা জরুরি হয়ে পড়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে তিন দফা সুপারিশও করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাংলাদেশের সব ব্যাংকের শাখাগুলোতে অনলাইনে জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাই করার পদ্ধতি চালু করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া যেতে পারে। বর্তমানে ন্যাশনাল ডাটাবেজে (জাতীয় পরিচয়পত্র ও মোবাইল কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে) দেশের সব প্রাপ্ত বয়স্ক নাগরিকদের বায়োমেট্রিক সংরক্ষিত। তাই ব্যাংকগুলোতে জাতীয় পরিচয়পত্র ভেরিফিকেশনের পাশাপাশি বায়োমেট্রিক ভেরিফিকেশন (ফিঙ্গার প্রিন্ট স্ক্যানারের মাধ্যমে) করার বিষয়টি পর্যায়ক্রমে বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে।
সর্বশেষ, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা ও রেমিট্যান্স গ্রহণের ক্ষেত্রে বায়োমেট্রিক ভেরিফিকেশন চালু করার জন্য প্রয়োজনীয় কারিগরি সহযোগিতা প্রদানের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নির্দেশনা দেয়া যেতে পারে।