গত ৫ আগস্টের ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে সরকার পরিবর্তনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন সেক্টরে সংস্কার কাজ শুরু করেছে। এই সংস্কার কাজের অংশ হিসেবে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ধসেপড়া আর্থিক খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে বিগত সরকারের বসানো দুর্নীতিবাজদেরকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু দেশের সম্ভাবনাময় রপ্তানি খাত চারকোল শিল্পটি এখনো বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সিন্ডিকেটদের কব্জায়ই বন্দি রয়ে গেছে। পাটকাঠি থেকে উৎপাদিত চারকোল পণ্য বাংলাদেশের একটি উদীয়মান শিল্প হলেও, এই পণ্যটি রপ্তানিতে সাধারণ ব্যবসায়ীরা পদে পদে সিন্ডিকেটের মুখোমুখি হচ্ছেন। যার ফলে রপ্তানি নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন সাধারণ চারকোল উৎপাদক ও রপ্তানিকারকরা।
বিশেষ করে সাবেক পাট ও বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ নেতা মির্জা আজমের ছোট ভাই জিল্লুর রহমান শিপন চারকোল ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিসিসিএমইউএকে দখলে নিয়ে সারাদেশে নিজস্ব লোকদের দিয়ে একচেটিয়া বাজার নিয়ন্ত্রণ, কতিপয় ব্যবসায়ীকে দিয়ে বায়ারদের মিস-গাইড ও শিপিং লাইন নিয়ন্ত্রণ করে এই রপ্তানি খাতটিকে ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে এ খাতের রপ্তানির পাশাপাশি ব্যবসায়ীরাও বড় ধরণের ক্ষতির সম্মুখীন হবেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ফরিদপুর, মাগুরা ও মাদারীপুর এলাকায় বিভিন্ন চারকোল ফ্যাক্টরির মালিকরা সিন্ডিকেটের কারণে পাটকাঠির উচ্চ দামের ফলে এখনো ঠিকঠাক উৎপাদনে যেতে পারেনি।
ফ্যাক্টরি মালিকদের অভিযোগ, একটা গোষ্ঠী সিন্ডিকেট করে রাখার কারণে এই সিজনে পাটকাঠি কিনতে হচ্ছে ৩৫০-৩৭০টাকা দামে, অথচ এখন এই পাটকাঠির সিজনে আমরা গতবারও কাচামাল কিনেছি ২০০-২২০ টাকা দরে। ফ্যাক্টরি মালিকদের মতে, এবার কোনভাবেই বায়ার টেকানো সম্ভব হবে না আর।
তাদের অভিযোগ, মাঠে কাচামালের যোগান থাকা সত্ত্বেও, পাটকাঠি ব্যাপারিদের সাথে যোগসাজশ করে এসোসিয়েশন সভাপতি মির্জা শিপন ও তার নিজস্ব ৩-৪ জনের একটা সিন্ডিকেট পুরো ফরিদপুর অঞ্চলের পাটকাঠি ব্যাপারিদের জিম্মি করে চারকোল উৎপাদনে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চায়নার একটা নির্দিষ্ট বায়ারকে সুবিধা দিতে মরিয়া হয়ে কাজ করছে।
চারকোল ব্যবসায়ীরা জানান, বিগত ৭-৮মাস ধরেই চায়নার একটা বায়ারগোষ্ঠীর সাথে বাংলাদেশের চারকোল এসোসিয়েশনকে ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ নেতা ও এসোসিয়েশনের বর্তমান সভাপতি মির্জা জিল্লুর রহমান শিপন তার পছন্দের ১০টা কোম্পানি দিয়ে উক্ত বায়ারের সাথে চুক্তি করে বাংলাদেশের বাকি ফ্যাক্টরি মালিক ও রপ্তানিকারকদের কোনঠাসা করতেই বর্তমান এই ভরা উৎপাদনের মৌসুমে এই অচলাবস্থা সৃষ্টি করা হয়েছে, যার ফলে পুরো চারকোল বাজার চলে যাচ্ছে একটা সিন্ডিকেটের হাতে।
এ বিষয়ে চারকোল ব্যবসায়ী মাসউদ বলেন, অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়টি চারকোল ব্যবসায়ীদের জন্য একটা ভাল সময়। এই সময়েই আমরা বেশি পণ্য বিদেশে আমদানি করি। কিন্তু সংগঠনের সভাপতি নিয়ন্ত্রিত সিন্ডিকেটের কারণে আমরা ঠিক মতো রপ্তানি করতে পারছি না।
ব্যবসায়ীদের এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে বিসিসিএমইউএ’র সভাপতি জিল্লুর রহমান শিপনের মোবাইলে ফোন করলে নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে চারকোলের প্রধান আমদানিকারক দেশ চীন। এ ছাড়া তাইওয়ান, ব্রাজিল, মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্র, অস্টেলিয়া, কানাডা, জাপান, তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানিসহ ইউরোপের দেশগুলোতে রপ্তানি সম্ভাব্য বাজার রয়েছে। চারকোল থেকে মূলত কার্বন পেপার, কম্পিউটার ও ফটোকপিয়ারের কালি, আতশবাজি ও ফেসওয়াশের উপকরণ, মোবাইলের ব্যাটারি, প্রসাধনপণ্য, দাঁত পরিষ্কারের ওষুধ ইত্যাদি পণ্য তৈরিতে প্রধান উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছর প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার চারকোল পণ্য রপ্তানি হয়েছে। যা ভবিষ্যতে ৫ লহাজার কোটি টাকায় উন্নীত করা সম্ভব।
কিন্তু এ খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ চারকোল উৎপাদনকারী ও রপ্তারিকারক সমিতির (বিসিসিএমইএ) সভাপতি সাবেক পাট ও বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজমের ছোট ভাই জিল্লুর রহমান শিপন ও আওয়ামীপন্থী ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে সম্ভাবনাময় খাতটি নিয়ে রপ্তানিকারকদের সব স্বপ্নই চুরমার হয়ে যাচ্ছে।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, অ্যাসোসিয়েশনের আওয়ামীপন্থি ব্যবসায়ীরা ছাড়া কাউকেই শিপিং লাইনে যোগাযোগ করতে দিচ্ছে না। এমনকি আওয়ামী লীগপন্থি ব্যবসায়ীদের বাইরে অন্য কোনো ব্যবসায়ীকে পণ্য শিপিংয়ের ছাড়পত্রও দেওয়া হয় না। এতে করে পণ্য রপ্তানি নিয়ে তারা চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। এছাড়া, জিল্লুর রহমান শিপন ও তার সিন্ডিকেট একটি শিপিং কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেছেন। এখন সেই শিপিং ছাড়া অন্য কোনো শিপিংয়ে রপ্তানিকারকরা পণ্য রপ্তানি করতে পারছেন না।
আবার কমিশন বাণিজ্যের মাধ্যমে দেশের রপ্তানিকারকদের কম দামে পণ্য রপ্তানি করতে বাধ্য করেন তিনি। সভাপতি তার নিজস্ব কিছু লোক দিয়ে একচেটিয়া ফ্যাক্টরি ও বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন। এ ছাড়া চাইনিজ ফ্যাক্টরি মালিক ও বায়ারদের বাংলাদেশ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে নিজের পছন্দের ব্যবসায়ীদের দিয়ে সেসব ফ্যাক্টরির মালিকানা পাইয়ে দেওয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ফ্যাক্টরি মালিক বলেন, সিন্ডিকেটের জন্য কথাও বলা যায় না। খুবই বিপাকে আছি ব্যবসা নিয়ে। আগে যারা আওয়ামী লীগ ছিলো, রাতারাতি তারা খোলস পাল্টে বিএনপি নামধারী হয়ে পাটকাঠি থেকে শিপিং ও বায়ার সব নিয়ন্ত্রণ করছে। এভাবে চললে এই চারকল ব্যবসা টেকানো দায় হয়ে যাবে।
এএ