বিতর্কিত কোচিং সেন্টার সাইফুর’সকে এখনো সরকারি কর্মকর্তাদের ইংরেজি ভাষায় দক্ষ করে তোলার দায়িত্বে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরি হওয়ার পর দক্ষ হ্যাকার বানানোর প্রলোভন দেখিয়ে ইংরেজি শিক্ষার বিজ্ঞাপন দিয়ে সমালোচনার মুখে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি। আর এ প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কর্মকর্তাদের ইংরেজি ভাষা শেখাচ্ছে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) প্রশাসন একাডেমি।
যদিও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানের আওতায় থাকা প্রতিষ্ঠানটিকে নিয়ে বিস্ময় ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।
আরেক বিতর্কিত প্রতিষ্ঠান নর্দান ইউনিভার্সিটিতে সরকারি কর্মকর্তাদের মাস্টার্স কোর্সের শিক্ষা দিচ্ছে বিসিএস প্রশাসন একাডেমি। বেসরকারি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে রয়েছে সার্টিফিকেট বাণিজ্যসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ। এ প্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে কটূক্তি করে গ্রেফতারও হয়েছিলেন।
দু’টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই জঙ্গিবাদে মদদ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এরপরও কিভাবে প্রতিষ্ঠান দু’টির সঙ্গে সরকারি প্রতিষ্ঠান বিসিএস প্রশাসন একাডেমি কাজ করছে, তা জানতে চেয়েছেন সংসদীয় কমিটির সদস্যরা।
এছাড়া প্রতিষ্ঠান দু’টিকে বাদ দিয়ে ইংরেজি শিক্ষার জন্য ব্রিটিশ কাউন্সিল এবং মাস্টার্স কোর্সের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে চুক্তি করার জন্য বলা হয়েছে।
সংসদ সচিবালয় সূত্রে জানা যায়, গত ৩০ অক্টোবর জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিসিএস প্রশাসন একাডেমির কার্যক্রম নিয়ে আলোচনার সময় ওই দু’টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নাম উঠে আসে। কারণ বিসিএস প্রশাসন একাডেমি সরকারি কর্মকর্তাদের ইংরেজি ভাষা শেখানোর দায়িত্বে রেখেছে বিতর্কিত কোচিং সেন্টার সাইফুর’সকে। আর নর্দান ইউনিভার্সিটিতে সরকারি কর্মকর্তাদের মাস্টার্স কোর্সের শিক্ষা দেওয়ানো হচ্ছে।
সংসদীয় কমিটির সদস্যরা এ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশের পাশাপাশি তীব্র ক্ষোভও প্রকাশ করেন। তারা বিতর্কিত প্রতিষ্ঠান দু’টির সঙ্গে কেন সরকারি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে জানতে চাইলে উপস্থিত কর্মকর্তারা কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। পরে ওই দু’টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করার সুপারিশ করেছে সংসদীয় কমিটি।
কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট মুস্তফা লুত্ফুল্লাহ বলেন, বিসিএস প্রশাসন একাডেমির কর্মকাণ্ড দেখে কমিটি বিস্মিত হয়েছে। দেশে ভালো ভালো ইংরেজি শিক্ষার প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয় থাকার পরও বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে কেন কর্মকর্তাদের শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। কিন্তু কর্মকর্তারা কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।
তিনি বলেন, কমিটির পক্ষ থেকে ওই দু’টি প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিয়ে ইংরেজি শিক্ষার জন্য ব্রিটিশ কাউন্সিল এবং মাস্টার্স কোর্সের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে চুক্তি করার জন্য বলা হয়েছে।
বৈঠকে উত্থাপিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বিসিএস প্রশিক্ষণ একাডেমি বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের দক্ষ, পেশাজীবী, স্বপ্রণোদিত ও উদ্যোগী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য নানা ধরনের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। প্রশাসন, ব্যবস্থাপনা, সরকারি ক্রয়, তথ্য ও প্রযুক্তি, ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা বৃদ্ধি, নৈতিকতা, আদর্শ, মূল্যবোধ, দুর্নীতি দমন ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ পরিচালনা করে। দক্ষ, যোগ্য ও উদ্যোগী পেশাজীবী গণকর্মচারী গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত এ একাডেমি এখন পর্যন্ত ২৬২টি দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি কোর্সের মাধ্যমে আট হাজার ৯৮ জনকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরি হওয়ার পর একটি সংবাদপত্রে ‘English-এর ভুলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৬০ কোটি টাকা হ্যাকারদের হাতছাড়া’ শিরোনামে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেছিল সাইফুর’স। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী লোকজনের দ্বারা পরিচালিত কোচিং সেন্টারটির বিরুদ্ধে তখন দক্ষ হ্যাকার বানানোর উদ্দেশ্যে ইংরেজি শেখায় প্রলুব্ধ করার অভিযোগ ওঠে। এরপর গত ২৩ মার্চ সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ কোচিং সেন্টারটির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন।
জানা যায়, ইংরেজি শেখানোর নামে বিজ্ঞাপন দিয়ে ‘দক্ষ হ্যাকার’ বানানোর প্ররোচনার অভিযোগ ওঠার পরপরই সাইফুর’সের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেয় সরকার। পরে সরকারের সঙ্গে ‘সমঝোতার’ উপায় খুঁজতে সাংবাদিক পরিচয়ধারী চার শিবিরকর্মীর সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা বৈঠক করেন বলেও অভিযোগ ওঠে। কোচিং সেন্টারটির এসব কর্মকাণ্ডের পর ২৮ মার্চ শিক্ষাসচিব মো. সোহরাব হোসাইনকে থানায় জিডি (সাধারণ ডায়েরি) করা, মামলা করা, দুদককে চিঠি দিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করার নির্দেশনা দেন শিক্ষামন্ত্রী।
শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী মন্ত্রণালয় থেকে সাইফুর’সের বিরুদ্ধে তথ্য অনুসন্ধানের জন্য দুদককে চিঠি দিয়ে অনুরোধ করা হয়। সাইফুর’স কোচিং সেন্টারে ইংরেজি শেখানোর নামে প্রতারণা, জালিয়াতি এবং প্রতিষ্ঠানটির মালিকের আয়-ব্যয়ের তথ্যসংবলিত একটি প্রতিবেদনও দুদকে পাঠায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওই প্রতিবেদনের তথ্য প্রাথমিকভাবে যাচাই শেষে সাইফুর’সের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক।