কদিন বাদেই ফাইনাল পরিক্ষা। প্রস্তুতি পুরোদমে। নোটপত্র রেডি করে পড়ার টেবিলে বসে পড়লাম। বিকেল থেকেই কালো মেঘ আর গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। সন্ধ্যা সাড়ে ৭ টা। নিস্তব্ধ হয়ে যায় চারদিক। শোঁ শোঁ বাতাস আর গুড়মুড় শব্দে ধ্বংস লীলায় পরিণত হয় চারদিক। বলছিলাম ২০০৭ সালের ১৪ ই নভেম্বরের সেই ভয়াল রাতের কথা।
বাগেরহাট জেলার মোড়েলগঞ্জ থানার সন্ন্যাসী গ্রামে আমার বাড়ি। সুন্দরবন, নদী-নালা, খাল-বিল এই নিয়ে বন্যাপ্রবণ এলাকার মানুষ আমি। বন্যার সাথে লড়াই করে বাচঁতে হয় আমাদের। কখনো ভারী বৃষ্টি, কখনো জলেচ্ছাস আবার কখনো বা ভয়াবহ দুর্যোগে ভাসিয়ে নিয়ে যায় সবকিছু। কিন্তু, সবকিছুই হার মানিয়েছিল সেই ভয়াল রাত। যার নাম ‘সিডর’।
সেদিন বাবা বাসায় ছিল না। কোনো এক কাজে আমাদের পাশের থানা শরণখোলায় গিয়েছিল। বাড়িতে মা, আমি আর ছোট ভাইবোন। বিকেল থেকেই টিভিতে মহাবিপদ সংকেত অর্থাৎ ১০ নম্বর সংকেত দিয়েছিল। তারপরও আমরা সাইক্লোন সেল্টারে যাইনি। আমাদের গ্রাম থেকে সাইক্লোন সেল্টার অনেক দূরে। তাই মা বলছিল, কোথাও যাওয়ার দরকার নাই। আল্লাহ আমাদের পাশে আছে। কিছুই হবে না।
সন্ধার পরেই বিদুৎ চলে গিয়েছিল। চারদিকে প্রচন্ড বেগে বাতাস আর বৃষ্টি। তখন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। শুরু হল মহাতান্ডব। বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ আর গাছপালা,ঘরবাড়ি ভেঙে পড়ার শব্দ। পাশাপাশি মানুষের আত্মচিৎকার ‘বাঁচাও বাঁচাও’। যদিও পানি দেখতে পাইনি। কারণ, আমাদের ঘর ছিল বাধেঁর মধ্যে।
আমি আর আমার ছোট ভাইবোন মায়ের চারদিকে জড়োসরো হয়ে বসে থাকলাম। বিকট শব্দে একটি গাছ আমাদের ঘরের উপর এসে পড়ল। তখন সবাই মিলে চিৎকার দিতে থাকি। কিন্তু, কেউ শুনে না আমাদের চিৎকার। মা দোয়া পড়তে থাকে। ছোট ভাইবোনদের কান্নাকাটি যেন থামেই না। আমি ভেবেছিলাম এটাই হয়তো আমাদের শেষ দিন। আমাদের জড়িয়ে ধরে মা বলতে লাগল, বাবা, আমরা হয়তো কেউই বাঁচব না। এই মূহুর্তে তোর বাবাকে দেখে যেতে পারলাম না। জানিনা, তিনি কি অবস্থায় আছেন।
এদিকে আমাদের ঘর হেলে পড়ে। ঝড়ো হাওয়া আর বৃষ্টির পানিতে সবাই ভিজে গিয়েছিলাম। গায়েঁ কাঁথা দিয়েও সবাই শীতে কাঁপতে ছিলাম। যখন রাত সাড়ে ১২ টা, তখন ঝড়ের গতিবেগ অনেকটা কমতে থাকল। শান্ত হয়ে আসল চারদিক। কিন্তু, মানুষের চিৎকার আর আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছিল পুরো এলাকা। চারদিকে শুধু কান্না আর বাঁচাও বাঁচাও শব্দ।
চোখে ঘুম নেই। বেড়িয়ে পড়লাম বাহিরে। হঠাৎ, চিৎকার আর কাঁদতে কাঁদতে বাবা চলে এলো। সবাইকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি। সবাই মিলে একসাথে চিৎকার আর কাঁদতে লাগলাম। এর মধ্যে সকাল গড়িয়ে এল।
সকাল হতেই অন্য এক চিত্র ভেসে উঠলো আমাদের চোখের সামনে। চারদিক যেন একাকার। এক গ্রাম থেকে অন্যগ্রামে ছড়িয়ে পড়ল কন্নার রোল। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল গরু, ছাগল ,হাঁস-মুরগী আর মানুষের লাশ। গোটা এলাকা পরিণত হয় এক ধ্বংসস্তুপে। খাবার আর পরিধানের এক টুকরো কাপড়ের সন্ধানে অসহায় মানুষ ছুটছে এখানে সেখানে। আমাদের ঘরেও ছিল না কোন খাবার। ঘরে যা ছিল সবতো নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
ছোট-ভাইবোন নিয়ে না খেয়েই কাটল সেদিন। কিছুদিন পর পরিক্ষা তাই গেলাম বইয়ের সন্ধাণে। কোন বই-খাতা কিংবা নোট খুঁজে পেলাম না। অসহায়ের মত তাকিয়ে থাকলাম। এই ধ্বংসলীলা কোন দিনও ভুলব না। আজও সেই দিনটির কথা মনে পড়লে গাঁ শিউরে ওঠে।
লেখক
সাংবাদিক, অর্থসূচক
mehedi7755@gmail.com