সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রস্তাব করেছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিরপেক্ষ, অবাধ ও সুষ্ঠু করতে ১৩টি প্রস্তাবও তুলে ধরেন তিনি।
গতকাল শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর একটি হোটেলে ‘নির্বাচন কমিশন গঠন এবং শক্তিশালীকরণ: বিএনপির প্রস্তাবাবলী’ শীর্ষক একটি অনুষ্ঠানে খালেদা জিয়া এই প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হবে। নতুন কমিশন দায়িত্ব নেবে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি তাঁর প্রস্তাব তুলে ধরেন।
খালেদা জিয়ার এই প্রস্তাবে নির্বাচনকালে প্রতিরক্ষা বাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। অবশ্য প্রস্তাবের কোথাও সরাসরি জামায়াতে ইসলামীর নাম উল্লেখ না থাকলেও পুরো প্রক্রিয়ায় বিভিন্নভাবে দলটির সম্পৃক্ততা বোঝানো হয়েছে। প্রস্তাবের অন্তত সাতটি জায়গায় সকল দলের ঐকমত্যের কথা বলা হয়েছে। এমনকি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনাসহ বিভিন্ন পর্যায়ে যে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কথা বলা হয়েছে, তাতে নিবন্ধিত দল ছাড়াও প্রথম জাতীয় সংসদ থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এটা জামায়াতকে এই প্রক্রিয়ায় রাখার কৌশল বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। বিশিষ্ট আইনজীবী রফিক-উল হক বলেছেন, জামায়াতকে নিয়ে যেখানে বিতর্ক ও সমালোচনা আছে, সেখানে কৌশলে এই দলটি রাখা গ্রহণযোগ্য নয়।
খালেদা জিয়া প্রস্তাবে বলেন, নতুন কমিশন নিয়োগ দেওয়ার আগে রাষ্ট্রপতি সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি বাছাই কমিটি গঠন করবেন। দলগুলো বাছাই কমিটির কাছে নাম দেবে। যে নামগুলো সব দল থেকেই এসেছে, সেখান থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) পদে দুজন ও প্রত্যেক নির্বাচন কমিশনারের বিপরীতে দুজনের নাম চূড়ান্ত করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবে কমিটি।
রাষ্ট্রপতি সেখান থেকে সিইসি ও ইসি নিয়োগ করবেন। যতক্ষণ পর্যন্ত দলগুলোর দেওয়া নামের প্রস্তাবে মিল না পাওয়া যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত বাছাই কমিটি দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাবে।
খালেদা জিয়ার প্রস্তাবে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ আইনের (আরপিও) বিভিন্ন ধারায় সংশোধনী আনা, কমিশন সচিবালয়কে শক্তিশালী করার বিষয়টিও আছে। পাশাপাশি তাঁর প্রস্তাবে ভোট গ্রহণ, গণনার ক্ষেত্রে আইনে পরিবর্তন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞা পরিবর্তনের কথাও বলা হয়েছে। তিনি নির্বাচনের সময় প্রতিরক্ষা বাহিনীকে (সেনা, নৌ ও বিমান) বিচারিক ক্ষমতা দেওয়ারও প্রস্তাব করেছেন। প্রতিরক্ষা বাহিনীকে নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে আরপিওর সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেন তিনি।
অবশ্য এসব প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলেই যে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে, তা মনে করেন না খালেদা জিয়া। তিনি মনে করেন, বর্তমান বাস্তবতায় সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কমিশনকে প্রশাসনিক ও অন্যান্য সহযোগিতা দেওয়া, প্রতিরক্ষা বাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমর্থন ও সহযোগিতা দরকার। তাই নির্বাচন কমিশন যেন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে পারে, সে জন্য একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের প্রয়োজন। তিনি বলেন, বিএনপি নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখা ভবিষ্যতে জাতির সামনে উপস্থাপন করবে।
নির্বাচন কমিশন গঠন: খালেদা জিয়া তাঁর প্রস্তাবে বলেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি নিরূপণের জন্য নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মহাসচিব অথবা সাধারণ সম্পাদক কিংবা মনোনীত প্রতিনিধির সঙ্গে পৃথক বৈঠক করবেন। চাইলে কেবল বিএনপির নেতৃত্বে ২০-দলীয় জোট ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট একজন করে মূল প্রতিনিধি এবং তাঁকে সহায়তাদানকারী আরও দুজন প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক করতে পারে। রাষ্ট্রপতি নাগরিক সমাজের মধ্য থেকে সৎ, যোগ্য ও দলনিরপেক্ষ প্রতিনিধিদেরও আলোচনায় যুক্ত করতে পারেন।
খালেদা জিয়া বলেন, সিইসি ও অন্য কমিশনারদের যোগ্যতা, অযোগ্যতা ও মনোনয়নের প্রশ্নে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত দলগুলোর সঙ্গে বাছাই কমিটিকে আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে। বাছাই কমিটি সিইসি ও ইসি নিয়োগের জন্য দলগুলো থেকে পাওয়া ব্যক্তিদের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবে। কমিটি সেখান থেকে সিইসি পদে দুজন ও ইসি পদে আটজনের নাম বাছাই করবে।
বিএনপিপ্রধান আরও বলেন, সিইসি ও ইসি পদে মোট ১০টি অভিন্ন নাম পাওয়া না গেলে বাছাই কমিটি প্রয়োজনে বারবার আলোচনা করবে। এই প্রক্রিয়ায় কোনো রাজনৈতিক দল নতুন নাম প্রস্তাব করতে চাইলে বাছাই কমিটি ঐকমত্যে পৌঁছার স্বার্থে প্রস্তাবিত নতুন নাম গ্রহণ করবে। সিইসি পদে বাছাই করা দুজনই অসম্মতি প্রকাশ করলে ওই পদের জন্য পুরো প্রক্রিয়া নতুন করে শুরু করতে হবে। একইভাবে কমিশনার পদের ক্ষেত্রে একই পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে।
বাছাই কমিটি গঠন: রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি বাছাই কমিটি গঠন করবেন। সর্বজনশ্রদ্ধেয় সৎ, নিরপেক্ষ, অভিজ্ঞ, প্রাজ্ঞ এবং নৈতিকতা ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়ে পাঁচ সদস্যের একটি বাছাই কমিটি গঠন করবেন। বাছাই কমিটির আহ্বায়ক হবেন অবসরপ্রাপ্ত এবং কর্মক্ষম একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি, যিনি বিতর্কিত নন এবং অবসর গ্রহণের পর সরকারের কোনো লাভজনক পদে ছিলেন না। অপর সদস্যরা হবেন আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি, সচিব। তাঁরা হবেন অবসরপ্রাপ্ত। বিতর্কিত নন এবং অবসর গ্রহণের পর সরকারের কোনো লাভজনক পদে ছিলেন না। অবসরপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হবেন দলনিরপেক্ষ ও সর্বজনশ্রদ্ধেয়। শিক্ষাবিদ হিসেবে সুখ্যাতি থাকতে হবে। কমিটিতে একজন নারীকে রাখতে হবে। তিনি হবেন সর্বজনশ্রদ্ধেয়, দলনিরপেক্ষ, সৎ, দক্ষÿও যোগ্য। তবে অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং বিভিন্ন সময়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন, এমন কোনো কর্মকর্তা বাছাই কমিটির সদস্য হতে পারবেন না।
সিইসি ও ইসির যোগ্যতা: সিইসিকে সর্বজনশ্রদ্ধেয় সৎ, মেধাবী, দক্ষ, সাহসী, প্রাজ্ঞ এবং নৈতিকতা, ব্যক্তিত্ব ও কর্ম-অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এবং সকল বিচারে দলনিরপেক্ষÿএবং বিতর্কিত নন এমন একজন ব্যক্তি হতে হবে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান ছিলেন অথবা একজন সচিব, যিনি অবসর গ্রহণের পর সরকারের কোনো লাভজনক পদে নিয়োজিত নেই বা ছিলেন না অথবা একজন বিশিষ্ট নাগরিক সিইসি হিসেবে নিয়োগ পেতে পারবেন। তবে অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং বিভিন্ন সময়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন, এমন কোনো কর্মকর্তা সিইসি পদের যোগ্য হবেন না। সচিবকে অবশ্যই চাকরি থেকে অব্যাহতির পর তিন বছর পার করতে হবে।
খালেদা জিয়া বলেন, নির্বাচন কমিশনে একজন নারীকে কমিশনার রাখতেই হবে। সব কমিশনারকে সর্বজনশ্রদ্ধেয়, সৎ, মেধাবী, দক্ষ, প্রাজ্ঞ, সাহসী, নৈতিকতা, ব্যক্তিত্ব ও কর্ম-অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ও সব বিচারে দলনিরপেক্ষ এবং বিতর্কমুক্ত হতে হবে। কমপক্ষে জেলা জজের মর্যাদাসম্পন্ন অবসরপ্রাপ্ত বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদমর্যাদাসম্পন্ন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা, যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শিক্ষাবিদ এবং সর্বজনশ্রদ্ধেয় বিশিষ্ট নাগরিকদের মধ্য থেকে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিতে হবে।
আরপিও সংশোধনীর প্রস্তাব: আরপিওর ২ নম্বর ধারায় নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় প্রতিরক্ষা বাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেছেন খালেদা জিয়া। ২০০৯ সালে এই ধারা পরিবর্তন করে সংজ্ঞা থেকে প্রতিরক্ষা বাহিনীকে বাদ দেওয়া হয়।
খালেদা জিয়া তাঁর প্রস্তাবে ভোটকেন্দ্রে অতিরিক্ত ব্যালট বাক্স প্রকাশ্যে রাখা, ব্যালট পেপারে পরিপূর্ণ ব্যালট বাক্স সংশ্লিষ্ট বুথে রাখার প্রস্তাব করেন। এ কারণে আরপিওর ২৮-এর ৪ ও ৫ ধারায় বিষয়গুলো সংযোজনের কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া ৩৬-এর ৪ ধারায় শুধু ভোট গ্রহণে ব্যবহৃত বাক্স খোলা এবং ৩৬-এর ১১ ধারায় প্রিসাইডিং কর্মকর্তা তাঁর স্বাক্ষরিত ফলাফল পোলিং এজেন্টকে না দিয়ে ভোটকেন্দ্র ত্যাগ করতে পারবেন না কথাটি যুক্ত করার প্রস্তাব করেছেন।
নির্বাচন কমিশন শক্তিশালীকরণ: নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে কমিশনের নিজস্ব সচিবালয় গঠন করতে হবে। কমিশন সচিবালয়ের আর্থিক স্বাধীনতা থাকতে হবে। নির্বাচন কমিশন ও কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। দলীয় আনুগত্য ও পোষণকারী কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে তাঁদের প্রত্যাহার করতে হবে। যেসব কর্মকর্তা ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিধিবিধানের ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন, একটি কমিটি গঠনের মাধ্যমে তাঁদের তালিকা করে আগামী নির্বাচনী কার্যক্রম থেকে বিরত রাখতে হবে। প্রেষণে নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত প্রকাশ্য রাজনৈতিক মতাবলম্বী কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করতে হবে।
অন্যান্য প্রস্তাব: নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্বিন্যাস, ভোট গ্রহণের সাত দিন আগে প্রতিরক্ষা বাহিনী মোতায়েন এবং তাদের বিচারিক ক্ষমতা দেওয়া ও নির্বাচনী এলাকায় টহল, কেন্দ্রে ও বিশেষ বিশেষ স্থানে তাদের মোতায়েনের ব্যবস্থা করতে হবে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা, ২০-দলীয় জোটের নেতারা, বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক এবং বিশিষ্ট নাগরিকেরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
সানবিডি/ঢাকা/এসএস