বাংলাদেশের শেয়ারবাজার সংস্কার: কারসাজি বনাম উন্নয়ন

আপডেট: ২০২৪-১২-০৫ ১৭:০৯:৪৬


বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে “কারসাজি” শব্দটা যেন অনেকটা চিরচেনা। বছরের পর বছর ধরে দেখা গেছে, বড় বড় কারসাজিকারীরা নতুন নামে আবার ফিরে এসেছে। সময় বদলালেও, তারা কিন্তু ঠিকই থেকে গেছে এবং পুরো বাজারকে নিজেদের মতো করে প্রভাবিত করে আসছে। উন্নত দেশের বাজারের সাথে যদি আমাদের বাজারের তুলনা করা যায়, তাহলে বোঝা যায় সমস্যাগুলো কোথায় এবং কিছুটা হলেও সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।

বাজার কারসাজির কারণ:

বাজারের আকার বনাম কারসাজি

বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে কারসাজি একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা, যার অন্যতম প্রধান কারণ বাজারের আকার। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের মোট মূল্যমান ছিল মাত্র ৫৮ বিলিয়ন ডলার, যা অ্যাপলের ৩.৪৭ ট্রিলিয়ন ডলারের মাত্র ১.৭%। এই ছোট্ট বাজার দেশের ধনী ব্যক্তিবর্গ এবং ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলোর বিশাল আর্থিক ক্ষমতার কাছে নিতান্তই দুর্বল। ফলে, তাদের জন্য বাজারে কারসাজি করা অত্যন্ত সহজ হয়ে দাঁড়ায়।

অন্যদিকে, বড় বাজারগুলো যেমন যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজার, আকারে বিশাল এবং বৈচিত্র্যময় কোম্পানির তালিকায় পূর্ণ। এসব বাজারে কারসাজি করা তুলনামূলকভাবে অনেক কঠিন। উদাহরণস্বরূপ, কিছু বছর আগে বিল ও মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন ট্রাস্ট মাইক্রোসফটের শেয়ারে ৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছিল। কিন্তু, সেই বিনিয়োগের ফলে মাইক্রোসফটের শেয়ারের দামে উল্লেখযোগ্য কোনো প্রভাব পড়েনি।

এর বিপরীতে, একই পরিমাণ অর্থ যদি বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা হতো, তাহলে পুরো বাজারেই বড় ধরনের অস্থিরতা তৈরি হতো। এটি স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের আকার এত ছোট যে এটি সহজেই কারসাজির শিকার হতে পারে। বাজারের এই প্রেক্ষাপট দেশের শেয়ারবাজারকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে ।

বাজার বনাম অর্থনীতি

বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের একটি বড় সমস্যা হলো, বাজারে তালিকাভুক্ত বেশিরভাগ কোম্পানিই দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এর ফলে শেয়ারবাজার এবং অর্থনীতির মধ্যে একটি বড় ফাঁক বা disconnect স্পষ্টভাবে দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, ২০১০ সালে ডিএসই সূচক যে উচ্চতায় পৌঁছেছিল, ২০২৪ সালেও সেই উচ্চতায় পৌঁছাতে পারেনি। বরং বর্তমানে সূচক প্রায় ৪০% নিচে অবস্থান করছে। অথচ, একই সময়ে বাংলাদেশের জিডিপি ৩.৮ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি স্পষ্ট করে যে, শেয়ারবাজার এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মধ্যে তেমন কোনো যোগসূত্র নেই।

অন্যদিকে, উন্নত দেশগুলোর শেয়ারবাজার নতুন এবং উদ্ভাবনী কোম্পানিগুলোর নেতৃত্বে এগিয়ে যায়। সেখানে বাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো উদ্ভাবন, প্রবৃদ্ধি এবং অর্থনীতির সাথে সরাসরি সংযুক্ত থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের শেয়ারবাজার এখনো পুরনো এবং স্থবির কোম্পানির উপর নির্ভরশীল। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর অনেকের সাথেই উদ্ভাবনী কার্যক্রম বা দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির তেমন কোনো সম্পর্ক নেই।

মার্কেট ক্যাপ: বাস্তবতা বনাম মিথ

অনেকেই মনে করেন, বাজার মূলধন বৃদ্ধি মানেই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে আগের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো বাজারের মূলধন বাড়ানোর উদ্দেশ্যে বন্ড মার্কেট যুক্ত করেছিল। তবে বাস্তবে দেখা গেছে, বন্ড যুক্ত করেও বাজারে উল্লেখযোগ্য কোনো ইতিবাচক প্রভাব ফেলা সম্ভব হয়নি। এটি সহজেই উপলব্ধি করা যায়, কারণ বাজার মূলধনের বৃদ্ধির সাথে প্রকৃত অর্থনৈতিক উন্নতির সরাসরি সম্পর্ক থাকতে হয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো শেয়ারবাজারে বাজার মূলধন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেখানে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন উদ্ভাবনী কোম্পানি বাজারে অন্তর্ভুক্ত হয়, যা বাজার মূলধন এবং বাজারের কার্যক্রমে প্রাণ সঞ্চার করে। কিন্তু বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে এই চিত্র একেবারেই ভিন্ন। এখানে নিয়মিত যে কোম্পানিগুলো তালিকাভুক্ত হয়, তাদের সঙ্গে দেশের অর্থনীতি বা আন্তর্জাতিক প্রবৃদ্ধির খুব কমই সম্পর্ক রয়েছে। এই বাস্তবতায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কার্যকর “ইনডেক্স ফান্ড” কৌশল বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে নিকট ভবিষ্যতেও কার্যকর হবে না।

আইনহীনতার পরিণতি

বাংলাদেশের শেয়ারবাজার দুইবার বড় ধসের মুখে পড়েছে ১৯৯৬ এবং ২০১০ সালে। এই ধসগুলো সাধারন বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট করেছে। প্রতিবার ধসের পর কারসাজিকারীদের চিহ্নিত করে বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরি হলেও কার্যত কোনো জবাবদিহিতা হয়নি।

আইনের যথা যত প্রয়োগের অভাবের কারণে কারসাজিকারীরা বারবার ফিরে আসে, কারন তারা যেন জানে তাদের কিছু হবে না। প্রতিবারই ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ বিনিয়োগকারী, যারা তাদের কষ্টার্জিত টাকা বিনিয়োগ করে। যতদিন না শক্তিশালী আইন এবং নিয়ন্ত্রণ কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হবে, বাজারে স্বচ্ছতা আসা কঠিন।

শেয়ারবাজার উন্নয়নে করণীয়:

শক্তিশালী আইন কাঠামো

আইনের শাসন নিশ্চিত করা বাজার কারসাজি কমাতে পারে এবং অনানুষ্ঠানিক কার্যকলাপের ওপর নির্ভরতা হ্রাস করতে পারে। তবে এর ফলে বাজার স্থবির হয়ে যেতে পারে কারন আমাদের এই ছোট মার্কেটের বেশিরভাগ উত্থান পতন এই কারসাজিকারিদের মাধমেই হয়ে থাকে। কারসাজি ছাড়া বাজার কেবল তখনই নড়াচড়া করবে, যখন সস্তা অর্থ প্রবাহিত হবে বা সুদের হার কম হবে।

মিউচুয়াল ফান্ড: স্থিতিশীলতা নাকি ঝুঁকি?

কিছু ফান্ড ম্যানেজার দাবি করেন, আরও মিউচুয়াল ফান্ড বাজারকে স্থিতিশীল করবে। তবে, তাদের এই প্রচেষ্টা মূলত অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিগুলোর কমিশন বাড়ানোই লক্ষ্যে। এইদিকে, বর্তমানে মিউচুয়াল ফান্ডগুলোকে রেগুলাটরের নির্দেশনা অনুযায়ী সর্বনিম্ন ৬০% শেয়ারবাজারে সবসয় বিনিয়োগ রাখতে হয়, এই আইন করা হয় যেন ফান্ড ম্যানেজারা সাধারন বিনিয়োগকারীর মতো আচরণ না করে। কিন্তু ম্যানেজাররাই হয়তো নিকট ভবিষ্যতে এই নিয়ম তুলে দেওয়ার জন্য রেগুলেটরকে চাপ দিবে, কারন তারও চায় মুনাফার প্রবৃদ্ধি; আর এই প্রবৃদ্ধি মার্কেট পতনের সময়ও ৬০% বিনিয়োগ থাকলে সম্ভব নয়। আর যদি এই আইন তুলে নেয়া হয় তাহলে তারাও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মতো বাজার ওঠানামার সাথে বিনিয়োগ করতে পারবে এবং এইটা উত্থান পতনের গতি আরও ত্বরান্বিত করবে।

যদি অতিরিক্ত সংখ্যক মিউচুয়াল ফান্ড এর অনুমোদন দেয়া হয়, তবে সীমিত সংখ্যক শেয়ারের পেছনে বিপুল পরিমাণ অর্থ লগ্নি হতে পারে, যা বাজারকে ওভারভ্যালুয়েশনের দিকে নিয়ে যেতে পারে। তাই এই সময়ে অতিমাত্রায় ফান্ড অনুমোদন সমীচীন হবে না, আর এর মূল কারণ হলো উচ্চ সম্ভাবনাময় শেয়ারের অভাব।

তালিকাভুক্তির জন্য প্রণোদনা দেওয়া উচিত কি?

কিছু লোক মনে করেন, প্রণোদনা দেওয়া ভালো কোম্পানিগুলোকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করতে উৎসাহিত করবে। হ্যাঁ, প্রণোদনা কিছু শক্তিশালী কোম্পানিকে আকৃষ্ট করতে পারে। কিন্তু যদি উদ্যোক্তারা শেয়ারবাজারে আসতে বাধ্য বোধ না করেন, তবে এই প্রণোদনার বড় অংশই অপচয় হবে। এমনকি যদি কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্তও হয়, তবুও এটি মূল সমস্যার সমাধান করবে না।
বিনিয়োগের সুযোগ বাড়ানো

বাংলাদেশে বিনিয়োগের সুযোগ এখনো বেশ সীমিত। রিয়েল এস্টেট ছাড়া কার্যকর বিকল্পের অভাবে অনেকেই বিনিয়োগের সুযোগ খুঁজে পাচ্ছেন না। এর ফলে সম্পত্তির দাম টরন্টো বা নিউইয়র্কের মতো উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কি করা যেতে পারে?

উন্নত দেশগুলোর মতো বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করতে হলে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক শেয়ারবাজারে প্রবেশাধিকার দিতে হবে। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও শীর্ষ বৈশ্বিক কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগের সুযোগ পাবে। ইউরোপের মতো যদি বাংলাদেশেও বৈশ্বিক বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করা যায়, তাহলে বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকি কমাতে পারবে এবং শীর্ষ কোম্পানিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে ভালো রিটার্ন পেতে সক্ষম হবে।

এই সুযোগ তৈরির দুটি প্রধান উপায় রয়েছে:

১। মিউচুয়াল ফান্ডের মাধ্যমে: অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিগুলো এমন মিউচুয়াল ফান্ড তৈরি করতে পারে, যা বৈশ্বিক শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করবে। বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীরা এই ফান্ডের ইউনিট কিনে বৈশ্বিক বাজারে অংশীদার হতে পারবে।

২। সরাসরি আন্তর্জাতিক শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ: বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য সরাসরি আন্তর্জাতিক শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করা যেতে পারে। তবে এটি স্থানীয় আইন ও নিয়ম মেনেই করতে হবে।

প্রশ্ন হলো, এটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব কি না? বাস্তবতা হলো, প্রযুক্তি ইতোমধ্যেই আমাদের হাতে আছে। উদাহরণস্বরূপ, কোয়ান্ট ফিনটেক লিমিটেড (কিউএফএল) এমন একটি ট্রেডিং সফটওয়্যার তৈরি করেছে, যা বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীদের আন্তর্জাতিক বাজারে বিনিয়োগের সুযোগ দিতে সক্ষম। এখন প্রয়োজন শুধু সঠিক নিয়ম-কানুনের বাস্তবায়ন এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার সমর্থন।

শেষের কথা
বাংলাদেশের শেয়ারবাজার এখনো কারসাজির জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এর কারণ হলো বাজারের ছোট আকার, তালিকাভুক্ত কোম্পানির প্রকৃতি, আর দুর্বল নিয়ম-কানুন। তাহলে কি এর সমাধান সম্ভব? হ্যাঁ, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশাধিকার বাড়ানো হতে পারে একটি কার্যকর সমাধান।

ভাবুন তো, যদি বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীরা বৈশ্বিক শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে পারে, তাহলে আমরা শুধু বৈশ্বিক প্রবণতার সাথে তাল মেলাতে পারব না, বরং আমাদের বিনিয়োগের ঝুঁকি কমানো এবং বিকল্পগুলো বৈচিত্র্যময় করার সুযোগ পাব।

যদি সঠিক সংস্কার আর বৈশ্বিক সংযুক্তি সম্ভব হয়, তাহলে বাংলাদেশের শেয়ারবাজার আরও শক্তিশালী, স্বচ্ছ এবং আন্তর্জাতিক মানে প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠতে পারে। এখন দরকার কেবল সাহসী পদক্ষেপ এবং সঠিক দিকনির্দেশনা।

লেখক:
মো. আহসান উল্লাহ রাজু
শেয়ারহোল্ডার ডিরেক্টর, কোয়ান্ট ফিনটেক লিমিটেড
ইমেইল: raju.mdahsanullah@gmail.com