ঘাতকরা ছিল এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের পূর্বপরিচিত- এমনই তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। তবে পুলিশ হত্যাকান্ডে সরাসরি জড়িত অভিযোগে গতকাল সোমবার পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সন্দেহভাজন ১৮ জনকে আটক করেছে। রাতে এমপির ছোট বোন ফাহমিদা বুলবুল কাকলী অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করে সুন্দরগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা করেছেন।
শনিবার সন্ধ্যায় গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের সাহাবাজ গ্রামে নিজ বাড়িতে গুলিবিদ্ধ হন এমপি লিটন। পরে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, এ হত্যার কারণ নির্ণয়ে ৫টি সম্ভাব্য বিষয়ের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়গুলো হলো- জেএমবি ও জঙ্গিদের পরিকল্পিত হত্যাকান্ড, জামায়াত-শিবির চক্রের হামলা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, পারিবারিক শত্রুতা এবং জেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে বিরোধ। পুলিশ আশাবাদী খুব শিগগির তারা হত্যার মূল কারণ বের করে ফেলতে পারবে। এই মোটিভ জানা সম্ভব হলেই প্রকৃত হত্যাকারীদের খুঁজে বের করার সহজ হবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনকে গুলি করে হত্যার ঘটনা সন্ত্রাসীদের নতুন কৌশল হতে পারে। এ ঘটনায় সন্দেহভাজনদের ধরা হচ্ছে। তার (লিটন) টেলিফোন ও আশপাশের ফোনে যে তথ্য আদান-প্রদান হয়েছে, সেগুলো এনে আমরা তথ্য উদঘাটনের চেষ্টা করছি। আমরা নিশ্চিত, যে-ই এ ঘটনা করে থাকুক আমরা অচিরেই এদেরকে শনাক্ত করে ধরতে পারব। সেজন্য আমাদের পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো একযোগে কাজ করছে।
এলাকাবাসী ও গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এমপি লিটনের বাড়ি (সর্বানন্দ ইউনিয়নের উত্তর সাহাবাজ গ্রাম) সুন্দরগঞ্জ উপজেলা শহর থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে, রেল লাইনের পাশে। ৫ একর নিয়ে বাড়ির সীমানা। একটি দোতালা ভবন ও তিনটি টিনসেড ঘর। খুব কাছাকাছি আর কোন বাড়ি নেই। এ বাড়িতে থাকতেন এমপি লিটন, তার স্ত্রী ও কয়েকজন কাজের ছেলে। ও লেভেল পড়ুয়া একমাত্র ছেলে রাতিন থাকেন ঢাকার ধানমন্ডির ফ্ল্যাটে।
এলাকাবাসী জানান, লিটন এমপি হলেও এলাকাবাসী তাকে ভীষণ ভয় করতেন। খুব প্রয়োজন না পড়লে সচরাচর তার সাথে কেউ বাড়িতে এসে দেখা করতো না। তাছাড়া কারো সঙ্গে দেখা করার বিষয়ে তার কিছু বিধি-নিষেধ ছিল। কোন অপরিচিত ব্যক্তি তার সঙ্গে দেখা করতে এলে মূল ঘরের বাইরে কথা বলতেন। আর পরিচিত হলেই কেবল তাদের ড্রইংরুমে ( বৈঠকখানায়) নিয়ে কথা বলতেন। তাদের সন্দেহ ঘাতকরা সবাই বা তাদের মধ্যে দু’একজন লিটনের পূর্বপরিচিত ছিল। এ কারণেই তিনি তাদেরকে ড্রাইংরুমে নিয়ে কথা বলেন।
খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়:এলাকাবাসী সূত্র জানায়, লিটন গত ২৯ ডিসেম্বর সকালে স্ত্রীকে নিয়ে এলাকায় ফেরেন। এরপর থেকে তিনি আর বাইরে বের হননি। হত্যার ঘন্টা খানেক আগে থেকে এলাকার ৭/১০ জন কিশোর বাড়ির সামনের মাঠে ক্রিকেট খেলছিল। স্ত্রীকে নিয়ে তিনি তাদের খেলা দেখেন। আর হত্যাকান্ডের আধা ঘন্টা আগে মোটরসাইকেলে আসা যুকরা লিটনের সামনেই ধমক নিয়ে খেলা বন্ধ করে তাদের (কিশোরদের) চলে যেতে বাধ্য করে। এরপর তারা লিটনের ড্রইংরুমে (দোতলা ভবনের নীচতলায়) গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেন। আর কথা বলার সময় তার স্ত্রীকে সরে যেতে বলেন। মোটরসাইকেলে আসা যুবকেদের একজন আগে থেকেই ড্রইংরুমের জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। আর জানালার কাছেই সোফায় বসা ছিলেন লিটন। ওই যুবক জানালার পাশে দাঁড়িয়ে লিটনকে খুব কাছ থেকে গুলি করে। এরপরই যুবকরা দ্রুত মোটরসাইকেল যোগে পালিয়ে যায়। যাওয়ার সময় তারা ৩/৪ রাউন্ড ফাঁকা গুলিও ছুঁড়েছিল।
প্রত্যক্ষদর্শী কিশোর যা বললো: সেখানে ক্রিকেট খেলারত সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সাইফুল ইসলাম ঘটনার বর্ণনা দিয়ে জানায়, দুটি মোটরসাইকেল যোগে ৫ জন বহিরাগত যুবক এমপি লিটনের সঙ্গে দেখার করার অজুহাতে বিকাল ৪টা থেকে তার বাড়ির সামনের মাঠে ও রেললাইন দিয়ে ঘোরাফেরা করছিল। তাদের খেলা চলায় যুবকরা এমপির সঙ্গে দেখা করতে বিলম্ব করে। আস্তে আস্তে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলে যুবকরা তাদেরকে খেলা ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য শাসায়। ভয় না পেয়ে খেলা অব্যাহত রাখার এক পর্যায়ে তারা দেখতে পায় রেললাইনে দাঁড়িয়ে দুই যুবক মোবাইল ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছে। কথা বলা শেষে তারা এমপি লিটনের বাড়ির উঠানে অবস্থান নেয়। সেখানে পূর্ব থেকে অবস্থানরত ৩ যুবক এমপিকে কথা বলার অজুহাতে তার অতিথি কক্ষে ডেকে নিয়ে আসে। তারা আকস্মিকভাবে এমপিকে লক্ষ্য করে পরপর ৫ রাউন্ড গুলি ছুড়ে এবং দ্রুত মোটরসাইকেল যোগে স্থান ত্যাগ করে।
গৃহকর্মী যা বলেন: লিটনের গৃহকর্মী ইউসুফ আলী জানায়, মাগরিবের নামাজ শেষ হওয়া মাত্র সে দেখে বাড়ির সামনের গাব গাছতলায় একটি মোটরসাইকেল ও গাড়ির গ্যারেজের নিকট অপর একটি মোটরসাইকেল স্টার্ট অবস্থায় দুইজন লোক চড়ে আছে। হঠাত্ সে গুলির শব্দ শুনতে পায়। এসময় সে দেখে গ্যারেজের নিকটে থাকা মোটরসাইকেলে একজন দৌড়ে এসে চড়লো এবং পিছনে গাবগাছ তলায় দাঁড়ানো মোটরসাইকেলটিকে আরো দুইজন দৌড়ে এসে চড়লো। সে তাদেরকে ধাওয়া করলে পিছনের মোটরসাইকেলে বসা একজন তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে। পরে সে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেয়। এসময় বাড়িতে থাকা এমপির ড্রাইভার ফোরকানও গাড়ি নিয়ে খুনিদের পিছে ধাওয়া করে টেকানির মোড় চৌরাস্তা পর্যন্ত যায়। তবে তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। সে আরো জানায়, পাঁচজনের পরনে ছিল কালো প্যান্ট, জ্যাকেট বা কোট ও কালো জুতা।
পুলিশের বক্তব্য: পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, তথ্য রয়েছে ঘাতকরা এমপি লিটনের পরিচিত। তবে বিষয়টি এখন নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এমপি লিটনের স্ত্রী এখন শোকে মূহ্যমান। একটু স্বাভাবিক হলে এ ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
সুন্দরগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ আতিয়ার রহমান জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ও যে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে এমপি লিটনের বাড়িসহ বামনডাঙ্গা ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলা শহরে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে পুলিশ। এছাড়া বিভিন্ন সড়ক ও গুরুত্বপূর্ণ এলাকাসহ বিভিন্ন সড়কের মোড়ে আইন-শৃংখলা বাহিনীর টহল জোরদার করা হয়েছে।