বর্তমান জাতীয় সংসদ শুধুই নিয়ম রক্ষার। এটি কেবল ক্ষমতাসীন দলের একচ্ছত্র ভূবনে পরিণত হয়েছে। দশম সংসদের গত পাঁচ অধিবেশনেই এই কোরাম সঙ্কটের কারণে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩২ কোটি ৪২ লাখ ৩২ হাজার টাকা বলে মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। দুর্নীতিবিরোধী এ সংগঠনটি বলেছে, আরেকটি নির্বাচনই পারে জাতীয় সংসদকে কার্যকর করতে। রবিবার রাজধানীর ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে ‘পার্লামেন্টওয়াচ’ বিষয়ক প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী উপ-নির্বাচহী পরিচালক ড. সুমাইয়া খায়ের, পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান, রিসার্চ এন্ড পলিসি বিভাগের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ফাতেমা আফরোজ, মোরশেদ আক্তার, প্রোগ্রাম ম্যানেজার জুলিয়েট রোজেটি প্রমুখ।
সংবাদ সম্মেলনে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সার্বিকভাবে সংসদের কার্যক্রমে আমরা হাতাশ। সংসদে সরকারি ও বিরোধী দলের উপস্থিতি গ্রহণযোগ্য নয়। সংসদীয় আচরণ থেকে ব্যাপক বিচ্যুতি হয়েছে। একটি দল বা জোট যাদের সংসদে উপস্থিত নেই, তাদের নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। প্রতিপক্ষের সমালোচনা আগের সংসদের চেয়ে ১২ গুণ বেড়েছে। তিনি বলেন, সংসদীয় কমিটির মূল দায়িত্ব পালনের প্রতি অনিহা, ও সংসদ সদস্যদের অবহেলা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। নবম সংসদে বিরোধী দলের উপস্থিতর হার চার শতাংশ। এবার বিরোধী দলের উপস্থিতি ৫৩ শতাংশ। সেদিক থেকে সংসদে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ বেড়েছে। তবে বিরোধী দল কতটুকু বিরোধী তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘বিতর্কিত’ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের পর থেকে 'প্রশ্নবিদ্ধ প্রধান বিরোধী দলের’ জোরালো ভূমিকার ঘাটতিসহ নানা কারণে সংসদ প্রত্যাশিত পর্যায়ে কার্যকর হয়নি। এছাড়া ক্ষমতাসীন দলের একছত্র ভূবন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মূলত বর্তমান জাতীয় সংসদ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অধিবেশন শুরু হওয়ার নির্ধারিত সময়ের পর দেরিতে প্রবেশ করলেই হয় কোরাম সঙ্কট। দশম সংসদের গত পাঁচ অধিবেশনেই এই কোরাম সঙ্কটের কারণে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩২ কোটি ৪২ লাখ ৩২ হাজার টাকা।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, গত এক বছরে প্রতিটি কার্যদিবসে কোরাম সঙ্কটের কারণে বিলম্বে অধিবেশন শুরু হয়েছে। এখানে প্রতিদিন গড়ে ২৬ মিনিট কোরাম সঙ্কটের কারণে অপচয় হয়েছে। সংসদ পরিচালনার ব্যয়ের প্রাক্কলিত হিসাব অনুযায়ী সংসদ পরিচালনা করতে প্রতি মিনিটে গড়ে প্রায় ১ লাখ ১১ হাজার টাকা খরচ হয়। সে হিসাবে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২৮ লাখ ৮৬ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এমপিদের যোগ্যতা নেই, আইন সম্পর্কে ধারণা নেই। যে কারণে আইন প্রণয়ন কার্যাবলীতে এমপিদের অংশগ্রহণ হতাশাজনক। টিআইবি’র গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইন প্রণয়ন কার্যক্রমে মোট সময়ের মাত্র ৬ শতাংশ ব্যয় হয়েছে। দশম সংসদের দ্বিতীয় থেকে ৬ষ্ঠ অধিবেশন পর্যন্ত ৩০টি সরকারি বিল পাস হয়েছে। বিল উত্থাপন এবং বিলের ওপর মন্ত্রীর বক্তব্যের প্রেক্ষিতে একটি বিল পাস করতে গড়ে প্রায় ৩০ মিনিট সময় ব্যয় হয়েছে। অর্থবিল ছাড়া ২৪টি বিলের ওপর ২৯ জন সংসদ সদস্য আলোচনায় অংশ নিয়েছেন। যদিও তাদের আলোচনা আগের সংসদগুলোর মতোই কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে গেছে।
টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, সংসদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়ন কার্যবলীতে এমপিদের অংশগ্রহণ হতাশাজনক। ৩৫০ জন এমপির মধ্যে মাত্র ২৯ জন সদস্য আলোচনায় অংশ নিয়েছেন।
আমার মনে হয়, এমপিদের আইন প্রণয়ন কার্যবলী সম্পর্কিত আলোচনায় অংশ নেওয়ার যোগ্যতা নেই, দক্ষতা নেই। একই সঙ্গে এটিও হতে পারে, এমপিদের আইন সম্পর্কিত কার্যবলীতে আলোচনায় অংশ নেয়ার মানসিকতাও নেই, যোগ করেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি, দশম সংসদ নির্বাচন ছিল ‘বিতর্কিত’। একই সঙ্গে প্রশ্নবিদ্ধ ‘তথাকথিত’ বিরোধী দল দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করছে না। এটা উদ্বেগের, হতাশার। বিরোধী দল সরকারি দলের লেজুরবৃত্তি করছে। সরকারি দলের অংশ হিসেবে থাকায় তারা এখনও নিজেদের অবস্থান প্রমাণ করতে পারেনি।
কিন্তু ‘বিতর্কিত’ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের পর থেকে 'প্রশ্নবিদ্ধ প্রধান বিরোধী দলের' প্রত্যাশিত জোরালো ভূমিকার ঘাটতি; সংসদের বাইরের রাজনৈতিক জোট নিয়ে অপ্রাসঙ্গিক সমালোচনা ও অশালীন ভাষার প্রাধান্য; অসংসদীয় আচরণ ও ভাষার ব্যবহার বন্ধে স্পিকারের শক্তিশালী ভূমিকার অনুপস্থিততি; বিধান থাকলেও আন্তর্জাতিক চুক্তি বিষয়ক আলোচনা অনুষ্ঠিত না হওয়া; আইন প্রণয়ন; প্রশ্নোত্তর ও জনগুরুত্বপূর্ণ নোটিশের আলোচনায় সদস্যদের কম অংশগ্রহণ; কমিটির সদস্যদের ব্যবসায়িক সংশ্লিষ্টতাসহ স্বার্থের দ্বন্দ্ব সংসদীয় কার্যক্রমে তথ্যের উন্মুক্ততা ও অভিগম্যতার ঘাটতি ইত্যাদি কারণে সংসদ প্রত্যাশিত পর্যায়ে কার্যকর হয়নি। সবার অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন প্রত্যাশা করেন ইফতেখারুজ্জামান।
উল্লেখ্য, প্রতিবেদনটি ‘পার্লামেন্টওয়াচ’ ধারাবাহিকের ১২তম ও দশম জাতীয় সংসদের ওপর দ্বিতীয় প্রতিবেদন। ২০১৪ সালের জুন মাস থেকে ২০১৫ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত সময়ে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।