ত্বকে ব্রণ হওয়া বহুল পরিচিত একটি সমস্যা। নারী-পুরুষ, তরুণ-তরুণী এমনকি কিশোর-কিশোরীরাও এ সমস্যার আওতার বাইরে নয়। তবে সবাই সমানভাবে ব্রণের ভুক্তভোগী নয়। প্রাত্যহিক জীবনের চলাফেরা, কাজকর্ম, খাদ্য গ্রহণের অভ্যাস, পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে অসচেতনতা ব্রণের সমস্যার জন্য অনেকাংশে দায়ী। অনেকে সব সময় এটা নিয়ে চিন্তিত থাকে। এ থেকে রাতারাতি মুক্তি পাওয়ার জন্য তারা বিভিন্ন ধরনের ব্রণনাশকারী লোশন, ফেসপ্যাক ও ক্রিম ব্যবহার করতে থাকে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ফলাফল শূন্য। আমাদের মনে রাখতে হবে, মূলত বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ যত্ন বা সতর্কতার সমন্বয়ে এটা থেকে মুক্তি মিলতে পারে।
প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে ব্রণ প্রতিরোধের উপায়:
পাকস্থলী পরিষ্কার রাখা : প্রথমেই অভ্যন্তরীণ যত্নের কথা বলা যাক। আর সে জন্য সঠিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। সব সময় পাকস্থলী পরিষ্কার রাখা ব্রণ থেকে রক্ষা পাওয়ার অন্যতম প্রধান উপায়। যেকোনো উপায়ে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে হবে এবং প্রচুর পরিমাণে সবুজ শাক-সবজি খেতে হবে। যেমন-পালংশাক, লেটুস পাতা, বাঁধাকপি, মেথিশাক, সেলারি এবং প্রচুর পরিমাণে তাজা সবজির সালাদ ও মৌসুমি ফল। এ ছাড়া পানির পাশাপাশি প্রাকৃতিক, তাজা ও বোতলজাত নয় এমন ফলের রস পান করতে হবে। এসব খাবার টক্সিন দূর করতে সহায়তা করে এবং পরিপাকতন্ত্রের কার্যক্রম সহজ করে।
ব্রণ নিরাময়ের বিষয়ে অ্যাপোলো হাসপাতালের প্রধান পুষ্টিবিদ তামান্না চৌধুরী জানান, ব্রণ থেকে মুক্তি পেতে হলে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক দুইভাবেই যত্ন নিতে হবে। অভ্যন্তরীণ যত্নের ক্ষেত্রে ডায়েটের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ওজন কমানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে যাদের ওজন বেশি এবং যাদের থাইরয়েডের সমস্যা রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘যারা চর্বি জাতীয় খাবার যেমন ফাস্টফুড, ভাজাপোড়া বেশি খাচ্ছে, তাদের ব্রণ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ ছাড়া যারা পর্যাপ্ত পানি খায় না বা শাক-সবজি খায় না, তাদের ব্রণ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ব্রণ প্রতিরোধ করতে চাইলে দিনে ২ থেকে ৩ লিটার পানি পান করতে হবে। সেই সঙ্গে পর্যাপ্ত পরিমাণ ফলমূল ও শাক-সবজি। অর্থাৎ একজন মানুষের ফলমূল ও শাক-সবজির দৈনিক যে চাহিদা থাকে তা পূরণ করতে হবে। ভিটামিন সি-সমৃদ্ধ ফলমূল খেতে হবে। এটা ব্রণ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে ভালো কাজ করে। একই সঙ্গে ভিটামিন ই ও এ ত্বকের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। আর এর জন্য গাঢ় সবুজ ও লাল রঙের সবজি খেতে হবে। ভিটামিন ই ও এ পর্যাপ্ত থাকলে ভেতর থেকেই ব্রণ প্রতিরোধ হয়।’
যেসব খাবার বর্জনীয় : যাদের ত্বক ব্রণের ঝুঁকিতে রয়েছে, তাদের লাল মাংস অর্থাৎ গরু, খাসি ও ভেড়ার মাংস খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। যদি এমন হয় যে, মাংস ছাড়া আপনার চলে না সে ক্ষেত্রে চর্বিবিহীন মাংস, মাছ ও মুরগির মাংস খেতে পারেন। একই সঙ্গে আরো কয়েক ধরনের খাবার বর্জন করা উচিত। মিষ্টি, তেলে ভাজা খাবার, বেশি তেলযুক্ত ও মসলা জাতীয় খাবার, চকলেট, আইসক্রিম ও গ্যাস মেশানো পানীয় পান যেকোনো উপায়ে বর্জন করতে হবে। সাধারণত অল্পবয়স্ক ছেলেমেয়েরা পানির পরিবর্তে কোলা জাতীয় পানীয় দিয়ে তৃষ্ণা মেটায়। তাদের অভিভাবকও তাদের এ বিষয়ে সচেতন করে না। এটা কখনোই করা যাবে না। অভিভাবকদের এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রথম থেকেই আপনার সন্তানকে সবুজ শাক-সবজি, ফলমূল ও প্রচুর পরিমাণে পানি পান করাতে শেখান। এর জন্যই আপনার সন্তান আপনাকে ধন্যবাদ দেবে একসময়।
বাহ্যিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মাধ্যমে ব্রণ প্রতিরোধের উপায়:
নিয়মিত ত্বক পরিষ্কার : ত্বক পরিষ্কার রাখতে হবে। তৈলাক্ত ত্বক সব সময় ব্রণের আক্রমণের শিকার হয়। অনেক সময় এটা ব্ল্যাকহেড ও হোয়াইট হেড দিয়ে শুরু হয়। এরপর ধীরে ধীরে পুঁজভর্তি ব্রণ বের হয়। এ ক্ষেত্রে বাড়িতেই পুদিনা পাতা, ঠান্ডা পানি ও কর্পূর দিয়ে একটি অ্যান্টিসেপটিক তৈরি করে ব্যবহার করতে পারেন। ১ লিটার পানিতে ১০০ গ্রাম পুদিনা পাতা ফুটিয়ে ছেঁকে ঠান্ডা করে নিয়ে তার সঙ্গে ১ চা-চামচ কর্পূর মিশিয়ে মুখে ব্যবহার করলে ব্রণ থেকে মুক্তি পেতে পারেন। এই মিশ্রণটি ফ্রিজে সংরক্ষণ করে দিনে কয়েকবার ব্যবহার করলে তৈলাক্ততা দূর হবে।
প্রাকৃতিক ফেসপ্যাক ব্যবহার : ব্রণের সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে বাড়িতেই প্রাকৃতিক উপাদানের সাহায্যে ফেসপ্যাক তৈরি করতে পারেন। ফেসপ্যাকটি প্রস্তুত করতে চন্দন কাঠের গুঁড়া, মুলতানি মাটি, কর্পূর ও গোলাপজল লাগবে। এসব উপাদান একসঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে ছোট বাটিতে করে ফ্রিজে রেখে ঠান্ডা করে নিতে হবে। এরপর ত্বকে লাগিয়ে শুকিয়ে গেলে ঠান্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। ভালো ফলাফলের জন্য সপ্তাহে তিন থেকে চারবার লাগাতে হবে।
ব্রণে হাত না লাগানো : অধিকাংশ মানুষের একটি বদভ্যাস হলো হাত দিয়ে ব্রণ খোঁটানো। এটি ত্বকের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। কখনোই নখ দিয়ে ব্রণ খোঁটানো, চিমটি দিয়ে তোলার চেষ্টা বা টিপে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করা যাবে না। এতে করে ত্বকের ভেতরে ব্রণ থেকেই যায়। আর এতে শুধু ত্বকে সংক্রমণই হয় না বরং ব্রণের দাগও থেকেই যায়।
এ ক্ষেত্রে তামান্না চৌধুরী বলেন, ‘ব্রণ হলে আমার সবচেয়ে বড় সাজেশন হলো আয়না না দেখা বা হাত না দেওয়া ব্রণের ওপরে। হাত দিলে কালো দাগ হয়ে যায়, আয়না দেখলে ডিপ্রেশন (হতাশা) চলে আসে। সাইকোলোজিক্যাল স্ট্রেচ (মানসিক চাপ) চলে আসে। আর স্ট্রেচ থেকে ব্রণটা আরো বেশি সময় ধরে থাকে। তখন এটাকে নিরাময় করা মুশকিল হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে মানসিক চাপ না নিয়ে ওজন কমানো, ভালোভাবে ধোয়া, ত্বক বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে ভালো ফেসওয়াশ ব্যবহার করা ভালো।’ এ ছাড়া নরম ও আলাদা তোয়ালে ব্যবহার করা, ধুলোবালি থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেন তিনি। তবে যদি আপনি এরই মধ্যে হাত দিয়ে ব্রণ দিয়ে খুঁটিয়ে গালে দাগ করে ফেলেন, তবে খুব সহজেই বাড়িতে বসে একটি ফেসপ্যাক বানিয়ে ফেলুন।
কাঁচা মটরের গুঁড়া, চন্দন কাঠের গুঁড়া, ১০টি লবঙ্গ, চালের গুঁড়া, পুদিনা পাতার গুঁড়া, নিম পাতার গুঁড়া, মুলতানি মাটি, কর্পূর, গোলাপজলের মধ্যে মিশিয়ে মিশ্রণ তৈরি করতে হবে। এরপর ঘাড়সহ মুখমণ্ডলে লাগিয়ে আলতোভাবে ম্যাসাজ করতে হবে। ৫ থেকে ৭ মিনিট পর তা ধুয়ে ফেলুন। এতে ত্বকের দাগগুলো ফ্যাকাশে হয়ে যাবে এবং ত্বকের উজ্জ্বলতা বেড়ে যাবে। তবে এসব ফেসপ্যাক ব্যবহারের আগে নিজের চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
১২-১৮ বছর পর্যন্ত বেশি যত্ন নেওয়া
১২ থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সময় ব্রণের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানান পুষ্টিবিদ তামান্না চৌধুরী। তার মতে, টিনএজারদের ফাস্টফুডের প্রতি ঝোঁক বেশি থাকে বলে তাদের ব্রণ হয়। এই বয়সে নিয়মিত ফাস্টফুড খাওয়া ঠিক না। ডিম, দুধ, শাক-সবজি খেতে হবে। কারণ এই সময় যদি ব্রণ না হয় তাহলে, বড় হওয়ার পর খুবই কম হয়। বিশেষ করে বয়ঃসন্ধিকালে যখন শারীরিক বা হরমোন পরিবর্তন হয়, সে সময়টায় বেশি যত্ন নিতে হবে। সে সময় অভিভাবকেরা খাবারের পুষ্টিমান থেকে শুরু সব বিষয়ে, যেমন ফেসওয়াশ ব্যবহার, আলাদা তোয়ালে ব্যবহার এসব বিষয়ে সচেতন থাকলে ব্রণ কম হয়।
আর এরই মধ্যে যাদের ত্বকে ব্রণ দেখা দিয়েছে তাদের ক্ষেত্রে তামান্না চৌধুরীর পরামর্শ ত্বক বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে হবে, ত্বক পরীক্ষা করতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে ধৈর্য ধরতে হবে। ঘন ঘন চিকিৎসক পরিবর্তন করা যাবে না।