পিকে মহানন্দিয়া ছিলেন ভারতের ওড়িসা রাজ্যের (বর্তমান ওডিশা) দরিদ্র নিম্নবর্ণের হিন্দু পরিবারের সন্তান। মানুষের ছবি আঁকতেন (স্কেচ) তিনি। তাঁর ব্যবসায়িক স্লোগান ছিল ১০ রুপিতে ‘১০ মিনিটে প্রতিকৃতি’।
১৯৭৫ সালের ডিসেম্বর মাস। মহানন্দিয়ার বয়স ছিল তখন ২৪। বিপণিবিতান ও ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু দিল্লির কনট প্লেসে মানুষের ছবি আঁকছিলেন মহানন্দিয়া। তাঁকে দেখে থমকে দাঁড়ান সেখানে পর্যটক হিসেবে যাওয়া সুইডেনের হারলত ফন হুয়েদবিন (২০)। মহানন্দিয়ার ১০ মিনিটে ছবি (স্কেচ) আঁকার দাবির সত্যতা পরীক্ষা করাটাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। আর সেখান থেকেই দুই মেরুর দুই তরুণ-তরুণীর ভালোবাসার অসাধারণ একটি গল্পের সূচনা। এই সুইডিশ তরুণীর জন্য স্থলপথে পাকিস্তান-আফগানিস্তান-ইরান-তুরস্ক হয়ে বাইসাইকেল চালিয়ে ক্লান্ত-বিধ্বস্ত অবস্থায় সুইডেন পৌঁছান মহানন্দিয়া। যাত্রাপথে খেয়ে না-খেয়ে থেকেছেন। ছবি এঁকে আয় করে খাবার নিজের জুগিয়েছেন। খাবার জন্য অর্থ জোগাড় করতে করেছেন রক্ত পর্যন্ত বিক্রি করতে হয়েছে তাঁকে।
এই দম্পতির গল্প নিয়ে সুইডিশ লেখক পার জে এনডারসনের লেখা সর্বাধিক বিক্রীত বইটি ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয়। গত মাসে ‘দ্য অ্যামেজিং স্টোরি অব দ্য ম্যান হু সাইকেলড ফ্রম ইন্ডিয়া টু ইউরোপ ফর লাভ’ নামে বইটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়।
প্রথম দেখায় সুইডিশ মেয়েটিকে দেখে হতবিহ্বল হয়ে পড়েন মহানন্দিয়া। তাঁর আঁকা ছবি দেখে মোটেই সন্তুষ্ট হননি হুয়েদবিন। পরের দিন আবার যান। সেদিনও মহানন্দিয়ার স্কেচ দেখে কোনো উন্নতি দেখতে পাননি হুয়েদবিন। এর কারণ হিসেবে মহানন্দিয়া বলেন, কয়েক বছর আগে তাঁর মায়ের দেওয়া ভবিষ্যদ্বাণীতে তিনি আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছেন। তিনি যখন ওডিশার একটি স্কুলে পড়তেন, তখন উচ্চবর্ণের ছাত্রদের দ্বারা বৈষম্যের শিকার হতেন। কারণ তিনি ছিলেন নিম্নবর্ণের দলিত সম্প্রদায়ের। বৈষম্যের শিকার হয়ে যখন তাঁর মন খারাপ হতো, তখন তাঁর মা তাঁকে বলতেন, রাশি অনুযায়ী এমন মেয়ের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হবে, যার রাশি বৃষ। মেয়েটি আসবে অনেক দূর থেকে এবং সে হবে একজন সংগীতজ্ঞ। পাশাপাশি সে একটি বনের মালিক থাকবে। হুয়েদবিনকে দেখামাত্রই তাঁর মায়ের এই ভবিষ্যদ্বাণীর কথা মনে পড়ে যায়। এরপর মহানন্দিয়া মেয়েটির কাছে জানতে চান, তিনি কোনো জঙ্গলের মালিক কিনা।
সুইডিশ অভিজাত পরিবার থেকে আসা হুয়েদবিন জবাবে বলেন, তিনি একটি জঙ্গলের মালিক। সংগীতের প্রতি তাঁর অনুরাগ তো রয়েছেই (তিনি পিয়ানো বাজানো পছন্দ করেন) পাশাপাশি তাঁর রাশিও বৃষ।
মহানন্দিয়ার বয়স এখন ৬৫। আর হুয়েদবিনের ৬১। সুইডেনের বোরাস থেকে স্কাইপিতে সানডে টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ৪০ বছরের বেশি সময় আগেকার ঘটনা স্মরণ করেন এই দম্পতি। মহানন্দিয়া তখন দিল্লি কলেজ অব আর্টসে চারুকলায় পড়তেন।
মহানন্দিয়া বলেন, ‘আমি জানতাম আমাদের দেখা হওয়াটা ছিল পূর্বনির্ধারিত। আমি তাঁকে বললাম যে সে আমার বউ হতে যাচ্ছে। এ কথা তাঁকে বলার পরই সে কাছেই থানায় যায় কি না, সে বিষয়ে আমি ভীত হয়ে পড়ি।’ হাসতে হাসতে মহানন্দিয়া বলেন, ‘আমি এমনকি তাঁর নামও জানতে চাইনি। আমি জানতে চেয়েছিলাম তাঁর জন্ম মে মাসে কি না এবং তিনি একটি বনের মালিক কি না। এর জবাব এসেছিল, হ্যাঁ।’
হুয়েদবিনের বলেন, ‘আমি তখন তাঁর প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেছিলাম। আমার উষ্ণ অনুভূতির জন্ম হয়েছিল। আমার মনে হয়েছিল, চওড়া হাসি ও কোঁকড়া চুলের মহানন্দিয়া একজন দারুণ লোক।’
এরপর তিন সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে ওডিশা রাজ্যে মহানন্দিয়ার বাড়িতে যান হুয়েদবিন। সেখানে তাঁরা আঞ্চলিক প্রথা অনুসারে বিয়ে করেন। হুয়েদবিন বলেন, ‘আমার কাছে ওডিশা যাওয়াটা ছিল নিজের বাড়িতে যাওয়ার মতো। ওডিশায় যখন আমি পা রাখি, সেই অনুভূতি আমি এখনো অনুভব করতে পারি।’
মহানন্দিয়া বলেন, ‘ও যখন আমার বাবার সঙ্গে দেখা করেছিল, তখন শাড়ি পরেছিল। আমি এখনো জানি না, কীভাবে সামাল দিয়েছিল ও। আমার বাবা ও পরিবারের সদস্যদের আশীর্বাদ নিয়ে আমরা স্থানীয় প্রথা অনুসারে বিয়ে করি।’ বিয়ের পর হুয়েদবিন তাঁর বাবা-মাকে জীবনসঙ্গীকে খুঁজে পাওয়ার খবর জানান।
হুয়েদবিন তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে ‘হিপি ট্রেইল’ দিয়ে ভারত এসেছিলেন। ওই যুগে দীর্ঘ চুলের হিপিরা স্থলপথে তুরস্ক, ইরান, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান হয়ে ইউরোপ থেকে ভারত যেত। হুয়েদবিন একই পথ দিয়ে সুইডেন ফিরে যান। মহানন্দিয়া তাঁকে সুইডেনের বোরাসে গিয়ে তাঁর সঙ্গে মিলিত হওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। তবে সুইডেন যাওয়ার জন্য অর্থ নিতে অস্বীকৃতি জানান মহানন্দিয়া।
এক বছরের বেশি সময় পার হয়ে যায়। এরপর যেকোনোভাবে সুইডেন যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন মহানন্দিয়া। তবে ওই সময়ে চিঠির মাধ্যমে তাঁদের যোগাযোগ ছিল।
উড়োজাহাজে যাওয়ার সামর্থ্য মহানন্দিয়ার ছিল না। যাবতীয় সম্বল বিক্রি করে ৬০ রুপি দিয়ে তিনি একটি পুরোনো বাইসাইকেল কেনেন। ইউরোপ থেকে মোটরসাইকেলে করে কীভাবে লোকেরা ভারতে আসেন, তা জানার পর হিপি ট্রেইল দিয়েই তিনি সুইডেন যাত্রার সিদ্ধান্ত নেন। মহানন্দিয়া বলেন, ‘আমার চিন্তা ছিল, মোটরসাইকেল দিয়ে যাওয়া গেলে বাইসাইকেল দিয়েই বা কেন নয়?’
১৯৭৭ সালের ২২ জানুয়ারি ৮০ ডলারের কিছু বেশি অর্থ এবং রং-তুলি নিয়ে যাত্রা শুরু করেন মহানন্দিয়া। তাঁর ছবি আকার দক্ষতা কাজে এসেছিল। মহানন্দিয়া বলেন, যাত্রাপথে ‘লোকজন আমাকে খাবার দিত। কেউ কেউ আমাকে তাদের বাড়িতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল।’
এটা ছিল কঠিন এক ভ্রমণ। আফগানিস্তানের কাবুল পৌঁছার পর পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ হয়ে পড়ে। সেখান খাবারের জন্য অর্থ জোগাড় করতে একটি হাসপাতালে তাঁকে রক্ত বিক্রি করতে হয়েছিল। ভাগ্যবশত ওই সময়ে ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য মহানন্দিয়া কীভাবে সাইকেল চালিয়ে ইউরোপ যাচ্ছেন, তা নিয়ে কাবুল টাইমস একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। মহানন্দিয়া বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত ছবির অনেক খদ্দের জুটে যায় আমার।’
মহানন্দিয়া বলেন, ‘আফগানিস্তান একটি ব্যতিক্রম দেশ। দেশটি শান্ত ও সুন্দর। সেখানকার লোকজন শিল্প পছন্দ করে। দেশটির বিপুল এলাকা জনবহুল নয়।’ তিনি জানান, আফগানিস্তানের লোকজন হিন্দি বুঝতে পেরেছিল। তবে ভাষাটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়, যখন তিনি ইরানে প্রবেশ করেন। তিনি বলেন, ‘আবারও চিত্রকলা আমাকে উদ্ধার করে। আমি মনে করি, ভালোবাসা হলো বৈশ্বিক ভাষা এবং মানুষ এটা বুঝতে পারে।’
যাত্রাপথে পোস্ট অফিসের মাধ্যমে হুয়েদবিনের পাঠানো উৎসাহমূলক চিঠি পেতেন মহানন্দিয়া। সাধারণ বিতরণ সেবার মাধ্যমেই চিঠি পেতেন মহানন্দিয়া। ওই সেবায় প্রাপক না চাওয়া পর্যন্ত পোস্ট অফিস ওই চিঠি রেখে দেয়।
মহানন্দিয়া বলেন, ‘প্রায়ই ক্লান্ত হয়ে পড়তাম। পায়ে আঘাত পেতাম। তবে হুয়েদবিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং নতুন জায়গা দেখার উত্তেজনা আমাকে এগিয়ে নিয়েছে।’
চার মাস পর এবং ১১ হাজার কিলোমিটারের বেশি পথ পাড়ি দিয়ে ২৮ মে গোটেনবার্গের ভেনিস থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরত্বের বোরাসের ট্রেন ধরেন মহানন্দিয়া। আর সেখানে অপেক্ষায় ছিলেন তাঁর স্ত্রী। মহানন্দিয়া বলেন, ‘সে আমাকে দেখামাত্র ছুটে চলে আসে। আমি তাঁকে বলি, দুঃখিত, আমার গায়ে দুর্গন্ধ। তবে এরপরও সে আমাকে জড়িয়ে ধরে।’
অস্বাভাবিক ওই যাত্রার অবসানের পর সুইডেনে এই দম্পতির জীবন শুরু হয়। সুইডেনে মহানন্দিয়া চারুকলার শিক্ষক। তাঁর চিত্র সুইডেন ও ইউরোপে প্রদর্শিত হয়েছে। তাঁর স্ত্রী শেখান গান। তাঁদের দুটি সন্তান রয়েছে। এর মধ্যে বড় মেয়ে এমিলি (৩১) একজন বস্ত্র অর্থনীতিবিদ এবং ছেলে কার্ল সিদ্ধার্থ (২৮) একজন হেলিকপ্টার পাইলট।
হুয়েদবিন বলেন, ‘সে একজন ভালো স্বামী ও ভালো বাবা।’ তাঁদের ভালোবাসার গল্পের বিষয়ে মহানন্দিয়া বলেন, ‘সঠিক লোককে খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা সবারই আছে। আমরা দুজনই ভিন্ন অবস্থান থেকে এসেছি। তবে এটা এমন অমিল যা আমাদের জীবনের মূল্য তৈরি করেছে। আমরা যা পেয়েছি তা একটি উপহার।’
সাংস্কৃতিক ব্যবধানের কারণে হুয়েদবিনের বাবা-মাকে আকৃষ্ট করতে সমস্যায় পড়েন মহানন্দিয়া। শেষ পর্যন্ত দুজনই সুইডেনেও আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে করেন।
মহানন্দিয়া বলেন, ‘ইউরোপীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। তবে আমার স্ত্রী প্রতি পদক্ষেপে আমাকে সহায়তা করেছে। সে আমার কাছে একজন বিশেষ ব্যক্তি। আমি এখনো তাঁকে ততটাই ভালোবাসি ১৯৭৫ সালে যেমন বেসে ছিলাম।’
দ্য স্ট্রেইট টাইমস ও বিবিসি অবলম্বনে। ভাষান্তর: কৌশিক আহমেদ।
সানবিডি/ঢাকা/মেহেদী/এসএস