বাংলাদেশের একশ্রেণীর রিক্রুটিং এজেন্সি বিদেশ থেকে ভিসা এনে বিদেশগামী শ্রমিকদের কাছ থেকে সরকার নির্ধারিত খরচের চেয়ে বেশি অর্থ আদায় করছে। আবার দক্ষ কর্মীর চাহিদার বিপরীতে পাঠানো হচ্ছে অদক্ষ কর্মী। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এ অনিয়ম-দুর্নীতির সুযোগ পাচ্ছে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো। এতে একদিকে অভিবাসন ব্যয় বাড়ছে, অন্যদিকে দেশের ভাবমূর্তিও নষ্ট হচ্ছে।
বিএমইটির কর্মকর্তাদের এ অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি। নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিতকরণ ও অভিবাসন ব্যবস্থাপনায় সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবকে বিষয়টি অবহিত করেছেন মন্ত্রী।
গত ২৯ মার্চ প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিবকে এ-সংক্রান্ত বিশেষ নির্দেশনা পাঠান নুরুল ইসলাম বিএসসি। নির্দেশনায় তিনি উল্লেখ করেন, সম্প্রতি বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ উঠেছে, বিএমইটি বিদেশগামী কর্মীর বহির্গমন ছাড়পত্র প্রদানের ক্ষেত্রে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে দলীয় ভিসা ভেঙে একক ভিসায় রূপান্তর করছে। বিশেষ করে কুয়েত, কাতার ও সৌদি আরবে বহির্গমন ছাড়পত্র প্রদানের ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। এর সঙ্গে বিএমইটির বহির্গমন শাখা ও সার্ভারের কিছু সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত বলেও অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, কিছু সংখ্যক দুর্নীতিবাজ ব্যক্তির যোগসাজশে ড্রাইভিং ভিসার বিপরীতে ব্যাপক হারে সাধারণ কর্মী (যারা ড্রাইভিং জানে না) সৌদি আরবে গমন করছেন। এতে সৌদি আরবের শ্রমবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। তাই অভিযোগগুলো জরুরি ভিত্তিতে তদন্ত করা প্রয়োজন।
জানতে চাইলে মন্ত্রীর নির্দেশনা পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) জাবেদ আহমেদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, বিষয়টি এখনো পরিষ্কার নয়। নির্দেশনার বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনার জন্য সংশ্লিষ্টদের নিয়ে
আজ একটি জরুরি সভা ডাকা হয়েছে। এর পরই এ বিষয়ে মন্তব্য করা সম্ভব হবে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সৌদি আরবে কাজের জন্য বাংলাদেশ সরকারের নির্ধারিত খরচ ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। অথচ একজন অভিবাসী কর্মীকে ব্যয় করতে হয় সাড়ে ৫ লাখ থেকে ১২ লাখ টাকা পর্যন্ত। একইভাবে মালয়েশিয়ায় কাজের জন্য যেতে সরকার নির্ধারিত খরচ ৩৭ হাজার ৫৭৫ টাকা। যদিও একজন কর্মীকে এজন্য ব্যয় করতে হচ্ছে ৩-৪ লাখ টাকা। মূলত নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান, বিদেশী রিক্রুটিং এজেন্সি, বৃহৎ ভিসা ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র ভিসা ব্যবসায়ী, বাংলাদেশী রিক্রুটিং এজেন্সি, বিভাগীয় ও তৃণমূল দালালসহ বিভিন্ন পর্যায়ে ভাগ হয় এ অতিরিক্ত অর্থ। এর সঙ্গে যুক্ত হয় বিএমইটি ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে ছাড়পত্র নেয়ার সময় বিভিন্ন কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের ঘুষ বাণিজ্য।
অভিযোগ আছে, মালয়েশিয়ায় দক্ষ পেশায় অদক্ষ কর্মী পাঠানোর নামে বিএমইটি কর্মকর্তারা প্রত্যেকের কাছ থেকে ৫ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেন। এতে বেড়ে যাচ্ছে অভিবাসন ব্যয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএমইটির এক কর্মকর্তা জানান, একক ভিসার ক্ষেত্রে বিএমইটির ছাড়পত্রই যথেষ্ট। এক্ষেত্রে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্রের প্রয়োজন হয় না। আবার গ্রুপ ভিসার ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্রের প্রয়োজন হয়। এ কারণেই বিএমইটির কিছু অসাধু কর্মকর্তা গ্রুপ ভিসাকে একক ভিসায় রূপান্তর করে, যাতে কমিশনের ভাগ মন্ত্রণালয়ের অসাধু কর্মকর্তাদের দিতে না হয়। আবার গ্রুপ ভিসা হলে মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র পেতে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হয়, যা অনেক সময় রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো এড়িয়ে চলতে চায়।
জানা গেছে, কোনো রিক্রুটিং এজেন্সি যদি এক থেকে ২৫ জন কর্মীর চাহিদাপত্র আনে, তাহলে সেটা একক ভিসার আওতায় পড়ে। এক্ষেত্রে বিএমইটির ছাড়পত্র ফি জনপ্রতি দেড় হাজার টাকা। আর চাহিদাপত্র ২৫ জনের বেশি হলে সেটি গ্রুপ ভিসার আওতায় পড়ে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র ফি জনপ্রতি আড়াই হাজার টাকা। গ্রুপ ভিসার ক্ষেত্রে ছাড়পত্রসহ যাবতীয় খরচ নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানের বহন করার কথা থাকলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সে নিয়ম মানা হয় না। ফলে ছাড়পত্র নেয়ার বাড়তি খরচও বিদেশগামী কর্মীকে বহন করতে হয়।
বিএমইটি সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালে বিএমইটি থেকে ছাড়পত্র নিয়ে বৈধভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিয়েছেন মোট ৭ লাখ ৫৭ হাজার ৭৩১ জন। আর ২০১৫ সালে গেছেন ৫ লাখ ৫৫ হাজার ৮৮১ ও ২০১৪ সালে ৪ লাখ ২৫ হাজার ৬৮৪ জন। তার আগের বছর ২০১৩ বিদেশে যান ৪ লাখ ৯ হাজার ২৫৩ জন বাংলাদেশী।
এদিকে চলতি বছর জনশক্তি রফতানির হার বেড়েছে। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে বিভিন্ন দেশে কাজ নিয়ে গেছেন ১ লাখ ৬৬ হাজার ৪৭২ জন কর্মী। গত বছরের এ সময়ে বিভিন্ন দেশে কাজ নিয়ে যান ১ লাখ ২৬ হাজার জন।
বিএমইটি বলছে, সৌদি বাজারে বিপুল সংখ্যক কর্মী নিয়োগ হওয়ার ফলে এ পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। প্রথম দুই মাসে যেসব কর্মী বিদেশে গেছেন, তার মধ্যে অর্ধেকের বেশি নিয়োগ হয়েছে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। সূত্র: বনিকবার্তা
সানবিডি/ঢাকা