সারাদেশে প্রতিটি খাতে উন্নয়নের ব্যাপক কর্মযজ্ঞ দৃশ্যমান হলেও বিভিন্ন নির্বাচনে এর তেমন সুফল পাচ্ছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রায় প্রতিটি সূচকে সমসাময়িক অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশ এগিয়ে থাকার পরেও ভোটের মাঠে কেন এর প্রতিদান পাচ্ছে না সরকার? সর্বশেষ কুমিল্লা সিটি করপোরেশন (কুসিক) নির্বাচন এবং সাম্প্রতিক সময়ে অনুষ্ঠিত ঢাকা আইনজীবী সমিতি ও সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের ভোটের ফলাফলের পর এই প্রশ্ন বড় আকারে সামনে এসেছে। এর বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা ও রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব্ব-কোন্দলের চেয়েও মাঠপর্যায়ে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের কারও কারও দুর্ব্যবহারের ফলে পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে ভোটে। ব্যক্তির খারাপ আচরণ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঔদ্ধত্যের মাশুল দিতে হচ্ছে সরকার ও দলকে।
রাজনীতি বিশ্লেষকরা এ-ও বললেন, কেবল বর্তমানে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের অনেকেই সাধারণ মানুষের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করছেন, বিষয়টি কিন্তু তা নয়। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে যারাই ক্ষমতায় ছিলেন তাদের নেতা-কর্মীরাই কম-বেশি একই ধরণের আচরণ করেছেন। পরবর্তী সময়ে ভোটের প্রতিযোগিতায় সেসব দলকেও খেসারত দিতে হয়েছে। আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিষয়টি ভাবনায় ফেলেছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে। ইত্তেফাকের সঙ্গে পৃথকভাবে আলাপকালে দলটির নেতারা বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গত আট বছরের শাসনামলে উন্নয়নের বিচারে বাংলাদেশ নতুন করে জেগে উঠেছে। উন্নয়নের ঢেউ কম-বেশি দেশের প্রতিটি গ্রামে লেগেছে। টিআর, কাবিখা, জিআর প্রকল্পে বরাদ্দ অতীতের যে কোনো সময়ের রেকর্ড ভেঙ্গেছে। রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ, পুল-কালভার্টসহ গ্রামীণ অবকাঠামোগত উন্নয়নের চিত্র দলমত নির্বিশেষে সবার সামনে স্পষ্ট। বিদ্যুত্ উত্পাদনসহ প্রতিটি খাতেই নতুন গতি পেয়েছে সামগ্রিক উন্নয়ন। বিভিন্ন খাতে সরকার শহর থেকে শুরু করে তৃণমূলে বহুমাত্রিক বরাদ্দ পাঠাচ্ছে। উন্নয়নের মাইলফলক হিসেবে সরকার নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণ করছে। এত উন্নয়নের পরেও কেন কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে ভোটে হারলো আওয়ামী লীগ? কেন আইনজীবীদের শীর্ষ দুটি সংগঠনের নির্বাচনে ফল ঘরে এলো না? এ রকম প্রশ্নের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে রীতিমতো বিষ্ময়-ই প্রকাশ করলেন আওয়ামী লীগের এই নেতারা।
এই প্রশ্নের অনেকটাই উত্তর মেলে দলের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যে, মন্তব্যে। সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে দলের সভা-সমাবেশে তিনি প্রতিনিয়তই বলছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের যে উন্নয়ন করেছেন তা শুধু দেশেরই নয়, বিদেশেরও কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। কিন্তু এই উন্নয়ন অনেক ক্ষেত্রে ম্লান হয়ে যাচ্ছে দলের নেতা-কর্মীদের কারও কারও খারাপ আচরণের কারণে। এসব সভা-সমাবেশে দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, মানুষের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করুন, ভালো ব্যবহার না করলে মানুষ ভোটের সময় জবাব দেবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ামের এক সদস্য ইত্তেফাককে বলেন, শুধু সাধারণ মানুষের সঙ্গেই নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তা, এমনকি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও দলের কেউ কেউ দুর্ব্যবহার করছেন। শর্ত পূরণ না করেও দরপত্র ভাগিয়ে নিতে কেউ কেউ সরকারি কর্মকর্তাদের হুমকি-ধমকিও দেন। দরপত্র পাওয়ার পর ঠিকমত কাজ না করে বিল পেতেও অনেকে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে রূঢ আচরণ করছেন। আর তৃণমূল নেতা-কর্মীদের কেউ কেউ স্থানীয় মুরব্বি ও গণমান্য ব্যক্তিদের অশ্রদ্ধা করছেন। তাদের এই ধরনের আচরণের প্রভাব গিয়ে পড়ছে ভোটে। সাধারণ মানুষ বা ভোটাররা ব্যালটের মাধ্যমে ব্যক্তির অপরাধের প্রতিশোধ নিচ্ছেন সরকার ও দলের বিরুদ্ধে। তাছাড়া বিভিন্ন স্থানে ভোটকেন্দ্রে দলের নেতা-কর্মীদের অনেকের বাড়াবাড়ি, কেন্দ্র দখলের চেষ্টা এবং নির্বাচন কমিশন (ইসি) ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের প্রতিফলনও ঘটছে ভোটের ব্যালটে।
এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য লে. ক. (অব.) ফারুক খান গতকাল সোমবার ইত্তেফাকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘এটা ঠিক, আমাদের নেতা-কর্মীদের কারও কারও খারাপ ব্যবহারের কারণে ভোটে আমাদেরকে খেসারত দিতে হচ্ছে। বিষয়টি দলকেও চিন্তায় ফেলেছে। তিনি এ-ও বললেন, কুমিল্লা এবং আইনজীবীদের নির্বাচনে আমাদের পরাজয়ের আরেকটি কারণ অভ্যন্তরীণ কোন্দল বা অনৈক্য। কিন্তু কুমিল্লা থেকে সবচেয়ে বড় অর্জন হলো, এটা প্রমাণিত হয়েছে যে-প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বর্তমান ইসির অধীনে দেশে অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন হচ্ছে। ইসি নিয়ে বিএনপি যেসব অভিযোগ করেছে তা অসত্য প্রমাণিত হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়গুলোতে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরের নির্বাচনে ক্ষমতাসীনরা পরাজিত হয়েছেন। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে ১১ হাজার ৮৫ ভোটের ব্যবধানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমাকে হারিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন বিএনপির প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পরাজয়ের কারণ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সরকারের উন্নয়ন তৃণমূলে ভোটারদের মন গলাতে পারছে না। দলীয় নেতা-কর্মীদের মন্দ আচরণের কারণে উন্নয়নের সুবাতাস বইছে না ভোটের মাঠে। স্থানীয়ভাবে নেতায়-নেতায় রাজনৈতিক আধিপত্য, স্বার্থগত দ্বন্দ্ব ও পেশিশক্তির প্রদর্শন, মানুষের উপর দমন-নিপীড়ন, মামলা-হামলার পাশাপাশি মারামারি-হানাহানির ঘটনায় সাধারণ মানুষ এক ধরনের আতঙ্কে।
কুমিল্লায় ভোটের দিন দুপুর ২টায় শালবন বিহার প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের দুইশ গজ দূরে ২২ বছর বয়সী এক যুবকের সঙ্গে কথা হয়। বুকে নৌকার ব্যাজ পরিহিত ওই ভোটার ইত্তেফাককে বলেন, ‘এবার আমি প্রথম ভোট দিয়েছি। আমি বুকে নৌকার ব্যাজ পরলেও ধানের শীষে ভোট দিয়েছি।’ ধানের শীষে ভোট দেয়ার কারণ জানতে চাইলে ওই যুবক জানান, তিনি কোনো দল করেন না। তবে কান্দিরপাড়ে তার ছোট ব্যবসা আছে। আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ না হলে ব্যবসা করা কঠিন। এজন্য নৌকার সমর্থক হয়ে কাজ করছেন। দলের সমর্থন না পেলে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে-এই ভয়ে থাকেন সবসময়। অন্যদিকে বিএনপির প্রার্থী তাকে ব্যক্তিগতভাবে না চিনলেও দেখা হলে খোঁজখবর নেন। তাই ভালো লাগা থেকে ধানের শীষে ভোট দিয়েছেন।
পাশে বসা আরেক যুবক যিনি দুই মাস পর মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি জমাচ্ছেন, নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘ভাই ওদের (আওয়ামী লীগ) অত্যাচারে এলাকায় থাকাটাই দায় হয়ে পড়েছে। কথায় কথায় মামলা-হামলার শিকার হতে হয়। এজন্য যত উন্নয়ন হোক, দিন শেষে মানুষের মনে অত্যাচারের চিত্র ফুটে ওঠে। এ জন্য গ্রামগঞ্জের মানুষ জীবিকার সন্ধানে বিদেশ চলে যাচ্ছে।’
দুই যুবকের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ৬৫ বছর বয়সী এক ভোটারের দেখা মেলে। তিনি বলেন, ‘আমি দল না করলেও বিএনপিকে ভোট দিয়েছি। ভোট দেয়ার আগে স্থানীয় পোলাপানের বাধার সম্মুখীন হয়েছি। তারা বলেছে, চাচা নৌকায় ভোট দেবেন। আমি বলেছি, দেবো। কিন্তু আমি নৌকায় ভোট দিইনি। কারণ নৌকার প্রার্থীকে পাস করিয়ে লাভ নেই। যা লাভ হওয়ার তা ওই প্রার্থীর পরিবারের হবে। তাই আমার মতো অনেকে ধানের শীষে ভোট দিয়েছেন।’ শহরের টমসম মোড়ে এসে কথা হয় দুইজন দোকানদারের সাথে। তারা ইত্তেফাককে বলেন, ‘দলীয়ভাবে আওয়ামী লীগ এক থাকলেও তারা পাস করতো না। তাদের আচরণে মানুষ অসন্তুষ্ট।’ শুধু কুমিল্লা নয়, এর আগে বিভিন্ন স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উন্নয়নের পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে ভালো আচরণও প্রত্যাশা করেন তারা।
এসব বিষয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক গতকাল ইত্তেফাকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘শুধু সাধারণ নেতা-কর্মী নন, আমাদের কোনো কোনো সংসদ সদস্যও নিজেদের কর্মকাণ্ডের কারণে মানুষ থেকে দূরে সরে গেছেন। বিষয়গুলো ইতোমধ্যে আমরা দলীয় সভায় মূল্যায়ন করেছি।’