টানা সাত কার্যদিবস দরপতন ঘটেছে দেশের শেয়ার বাজারে। সেইসঙ্গে কমে গেছে লেনদেনের পরিমাণও। কম দামে শেয়ার কিনতে কোনো বিশেষ গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে এ দরপতন ঘটাচ্ছে বলে শেয়ার বাজার সংশ্লিষ্ট কারো কারো ধারণা।
বাজার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ দরপতনের জন্য ইসলামী ব্যাংকের কম লভ্যাংশ ঘোষণাকে অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। বিভিন্নভাবে বাজারে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে ইসলামী ব্যাংকের মতো বড় প্রতিষ্ঠান কম লভ্যাংশ দেয়ায় অন্য ব্যাংকগুলোও আশানুরূপ লভ্যাংশ দেবে না।
আর ব্যাংক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো ভালো মুনাফা না দিলে সার্বিক বাজারেই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ গত কয়েক মাস ধরে বাজারে যে ঊর্ধ্বগতি ছিল তার মূলে ছিল ব্যাংক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো। ব্যাংক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারের দাম এবং লেনদেন বাড়ায় সার্বিক বাজারেও মূল্য সূচক ও লেনদেন হু হু করে বেড়ে যায়।
এদিকে, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মার্চ মাসের লেনদেনের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মাসটিতে ডিএসইতে যে লেনদেন হয়েছে তার ২১ দশমিক ৬৭ শতাংশই ছিল ব্যাংক খাতের শেয়ারের। শতকরা হিসাবে যা প্রায় ২০১০ সালের সমান। ২০১০-১১ সময়কালে মোট লেনদেন ২৫-২৭ শতাংশই ছিল ব্যাংক খাতের শেয়ারের। কিন্তু মহাধসের পর ব্যাংক খাতের শেয়ারের লেনদেন কমতে কমতে ২০১৬ সালে মাত্র ৮ শতাংশে এসে পৌঁছে।
এরপর চলতি বছরের শুরু থেকেই শেয়ার বাজারে ব্যাংকের শেয়ারের লেনদেন বাড়তে থাকে। চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে ডিএসইর মোট লেনদেনে ব্যাংকের শেয়ারের অংশ ছিল ১৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ। পরের মাস ফেব্রুয়ারিতে ছিল ১২ দশমিক ১৭ শতাংশ। ব্যাংকের শেয়ারের লেনদেন বাড়ায় বেড়ে যায় মোট লেনদেনের গতিও।
জানুয়ারি মাসের ২৩ কার্যদিবসের মধ্যে ২১ কার্যদিবসই এক হাজার কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হয়। আর প্রতি কার্যদিবসে গড়ে লেনদেন হয় প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আর ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসজুড়ে প্রতি কার্যদিবসে গড়ে লেনদেন হয় ১ হাজার কোটি টাকার ওপরে। চলতি মাসের প্রথম নয় কার্যদিবসে প্রতি কার্যদিবসের গড় লেনদেন কমে দাঁড়িয়েছে ৮শ’ কোটি টাকায়। আর শেষ পাঁচ কার্যদিবসের প্রতিদিনই লেনদেন হয়েছে ৮শ’ কোটি টাকারও কম।
মূলত গত ৩০ মার্চ ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ শেয়ার হোল্ডারদের জন্য ১০ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণার পরের কার্যদিবস থেকেই বাজারে ধারাবাহিক নেতিবাচক প্রবণতা বিরাজ করছে। ইসলামী ব্যাংকের ওই লভ্যাংশ ঘোষণার পরের কার্যদিবসেই একের পর এক ব্যাংকের শেয়ারের লেনদেন কমতে থাকে। দিন শেষে ২৪টি ব্যাংকের শেয়ার দাম আগের দিনের তুলনায় কমে যায়। ব্যাংক খাতের শেয়ারের এ দরপতন এখনো অব্যাহত রয়েছে। প্রতিদিনই সিংহভাগ ব্যাংকের শেয়ার দাম কমছে।
ইসলামী ব্যাংকের কম লভ্যাংশ ঘোষণার বিষয়ে ডিএসইর পরিচালক শরিফ আতাউর রহমান বলেন, বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা ছিল ইসলামী ব্যাংক ভালো লভ্যাংশ দেবে। কিন্তু ব্যাংকটি এমন লভ্যাংশ ঘোষণা করলো, যা স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে কম। আমার ধারণা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
ডিএসইর আরেক পরিচালক রকিবুর রহমান জগো নিউজকে বলেন, এভাবে দরপতন হওয়ার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। আমার কাছে কাছে এ দরপতন অস্বাভাবিক মনে হয়। আমার ধারণা সবাই ট্রেডার হয়ে যাচ্ছেন। কেউ কেউ হয়তো কম দামে শেয়ার কেনার জন্য নিষ্ক্রিয় আছেন। না হলে বর্তমানে রাজনৈতিক অবস্থা ও অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় এমন দরপতন হওয়ার কোনো কারণ নেই।
ডিএসইর আরেক পরিচালক শাকিল রিজভী জগো নিউজকে বলেন, এ দরপতন স্বাভাবিক। এর আগে টানা দুইমাস দাম বাড়ার কারণেই এ দরপতন হচ্ছে। টানা যখন দাম বেড়েছিল সে সময় কিছু কোম্পানির শেয়ার দাম অযৌক্তিকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। এখন দাম কমাটাই স্বাভাবিক। আমার ধারণা কিছুদিনের মধ্যেই বাজার ঠিক হয়ে যাবে।
বাজার পর্যালোচনায় আরও দেখা যায়, গত বছরের শেষ কার্যদিবসে ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক ডিএসইএক্স ছিল ৫ হাজার ৩৬ পয়েন্ট। অনেকটা ধারাবাহিকভাবে বেড়ে সেই সূচক মার্চ মাস শেষে দাঁড়ায় ৫ হাজার ৭১৯ পয়েন্টে। অর্থাৎ তিন মাসে ডিএসইএক্স বাড়ে প্রায় ৬৮৩ পয়েন্ট। আর গত সাত কার্যদিবসের টানা পতনে ডিএসইএক্স কমেছে ১৩২ পয়েন্ট।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, এমন টানা দরপতন কারোই কাম্য নয়। এটাকে স্বাভাবিক দরপতন বলা যায় না। পরিকল্পিতভাবে এই দরপতন ঘটানো হচ্ছে কি না বিষয়টি বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) খতিয়ে দেখা উচিত।
বিএসইসির সাবেক এই চেয়ারম্যান আরও বলেন, ইসলামী ব্যাংকের কম লভ্যাংশ ঘোষণার কারণে বিনিয়োগকারীরা যদি গুজবে কান দিয়ে বিনিয়োগ করে সেটি ভুল হবে। ইসলামী ব্যংকে কিছু ঝামেলা গেছে, এজন্য হয়তো প্রতিষ্ঠানটি কম লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। কিন্তু একটি প্রতিষ্ঠান দিয়ে সব প্রতিষ্ঠানকে বিবেচনা করা ঠিক হবে না।
বিএসইসির সাবেক আরেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, টানা ছয় বা সাত কার্যদিবস পতন তেমন কোনো বিষয় না। এর আগে তো টানা তিন মাস দাম বেড়েছে। সে সময় তো কেউ কিছু বলেনি। আমার ধারণা এটি স্বাভাবিক দরপতন। টানা উত্থানের কারণেই এই দরপতন।