দুই প্লেটের বিচ্ছেদেই এই বিপর্যয়। গত সোমবার ঘটে যাওয়া শক্তিশালী ভূমিকম্পের কারণ হিসেবে এমনটিই আঁচ করছেন বিজ্ঞানীরা। এর আগে গত এপ্রিলে নেপালে ঘটে যাওয়া দুটি ভূমিকম্পের কারণ নিয়ে ভূ-বিজ্ঞানীদের মধ্যে দ্বিমত ছিল না। সকলে মেনে নিয়েছিলেন, ইন্ডিয়ান প্লেট আর ইউরেশিয়ান প্লেট একটি অন্যটির নিচে ঢুকে যাওয়াতেই ওই বিপত্তি। কিন্তু এদিন আফগানিস্তানের হিন্দুকুশ পর্বতে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পের কারণ কী? তা নিয়ে একাধিক তত্ত্ব ঘুরে বেড়াচ্ছে বিজ্ঞানী মহলে। খবর আনন্দবাজার অনলাইনের।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, রিখটার স্কেলে ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্পটিতে ছিল প্রায় ৫০টি পরমাণু বোমার (হিরোশিমায় যেমন ফাটানো হয়েছিল) সমান শক্তি। যা কিনা কম্পনের কেন্দ্রস্থলের আশপাশে তামাম এলাকাকে একেবারে দুমড়েমুচড়ে দিয়েছে!
এ ব্যাপারে ভারতীয় গবেষণাগার আইআইটি খড়গপুরের ভূ-পদার্থবিদ্যার গবেষকেরা বলছেন, এ দিনের ভূমিকম্প দুটি বিচ্ছিন্ন ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়ার যোগফল। বিভাগীয় প্রধান শঙ্করকুমার নাথের ব্যাখ্যা : নেপালে গত ২৫ এপ্রিলের সেই ৮.১ রিখটার মাত্রার ভূমিকম্পের সময়ে ইউরেশীয় প্লেট ও ইন্ডিয়ান প্লেট একটি অন্যটির নিচে তীব্র গতিতে ঢুকে গিয়েছিল। এবার তা হয়নি। উল্টো দুটি প্লেট পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে।
তাদের বক্তব্য, ইন্ডিয়ান প্লেটটি যে গতিতে ইউরেশিয়ান প্লেটের দিকে এগোচ্ছিল, একই গতিতে এবার তা ঢুকে গিয়েছে হিন্দুকুশের নিচে। একই ভাবে ইউরেশিয়ান প্লেট ঢুকে গিয়েছে পামির মালভূমির নিচে। দুয়ের সম্মিলিত প্রতিক্রিয়ায় এই ভূকম্পন।
দুটি প্রক্রিয়া কি একসঙ্গে হয়েছে? এ ব্যাপারে এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত না হলেও তাদের পর্যবেক্ষণ, এ দিন কম্পনের উৎসস্থলে যে পরিমাণ শক্তি নির্গত হয়েছে, দুটি প্রক্রিয়া একসঙ্গে না ঘটলে তা হওয়া দস্তুরমতো কঠিন। ‘ওই তল্লাটের ছবি দেখলে মনে হবে, যেন মাটির নিচে প্রবল ঘূর্ণিঝড় বয়ে গিয়েছে।’ মন্তব্য শঙ্কর কুমারের।
তার দাবি, এ দিন ওই দুটি ভিন্ন প্রক্রিয়ার জেরে মাটির ২০০ কিলোমিটার নিচে গোটা ভূস্তর উথালপাথাল হয়ে গিয়েছে। নেপালের ভূমিকম্পের তুলনায় তীব্রতা কম হলেও এটি মাটির অনেকটা গভীরে ঘটায় গোটা অঞ্চলের এমন অবস্থা, যেন আখমাড়াই কলে আখ পেষা হয়েছে। কম্পন অনুভূত হয়েছে বিরাট এলাকাজুড়ে। আফগানিস্তান থেকে দিল্লি- গোটা দক্ষিণ এশিয়া কেঁপে উঠেছে।
দেখা গেছে, এ দিনের কাঁপুনিতে আফগানিস্তান-পাকিস্তানে ঘর-বাড়ি, সেতু ভেঙে পড়েছে তাসের ঘরের মতো। এই বিধ্বংসী প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণ প্রসঙ্গে মার্কিন ভূ-বিজ্ঞান পর্ষদ (ইউএসজিএস)-এর বিবৃতিতেও শঙ্কর কুমারদের তত্ত্বের সমর্থন মিলেছে। যদিও ইউএসজিএস নিশ্চিত নয়, দুটি প্রক্রিয়া একসঙ্গে ঘটেছে, নাকি যেকোনো একটির কারণেই মাটি কেঁপে উঠেছে।
ইউএসজিএসের বক্তব্য: এ দিনের কম্পনের কারণ সম্পর্কে দুটি তত্ত্ব সামনে এসেছে। একটি বলছে, দুটি প্রক্রিয়াই (হিন্দুকুশের নিচে ইন্ডিয়ান প্লেটের প্রবেশ ও পামির মালভূমির নিচে ইউরেশিয়ান প্লেটের আগ্রাসন) একসঙ্গে হয়েছে। অন্যটি বলছে, দুটি প্রক্রিয়ার একটিই ভূকম্পন ঘটানোর জন্য যথেষ্ট ছিল।
এর বাইরে অন্য তত্ত্বও শোনা যাচ্ছে। ভূ-বিজ্ঞানীদের অনেকের মতে, নেপাল হিমালয়ে যেমন হয়েছিল, তেমন আফগান হিন্দুকুশেও দুই প্লেটের মধ্যে তীব্র গতির ঘষাঘষির ফলে ভূমিকম্পের উৎপত্তি। ভারতের প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-বিদ্যার প্রাক্তন প্রধান হরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের কথায়, ‘নেপালে যা ঘটেছিল, আফগানিস্তানে তা-ই হয়েছে। ইউরেশিয়ান প্লেট ও ইন্ডিয়ান প্লেট একে অন্যের তলায় ঢুকে গিয়েছে।’
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ববিদ সুগত হাজরার বক্তব্য : হিন্দুকুশ পর্বত তৈরিই হয়েছিল ইউরেশীয় প্লেটের নিচে ইন্ডিয়ান প্লেট ঢুকে গিয়ে। তাই ওখানে ইন্ডিয়ান প্লেটের উত্তরমুখী গতি (বছরে ৫০ মিলিমিটার) আটকে গেছে। পরিণামে দুই প্লেটের জোড়ে প্রচুর পরিমাণ শক্তি জমা হচ্ছে। যা আচমকা কোনো চ্যুতি (ফল্ট) বরাবর বেরিয়েও আসছে। এ দিনও তা-ই হয়েছে।
ভূ-বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, এই অঞ্চলটি বিশ্বের অন্যতম ভূকম্পপ্রবণ। বস্তুত হিন্দুকুশ পর্বতমালার এই অংশটি এত বেশি অস্থির যে, এখানে সব সময়েই ২-৩ রিখটার মাত্রার ভূমিকম্প হয়েই চলেছে। ৭.৫-৭.৮ মাত্রার ভূকম্পনও অপ্রত্যাশিত নয়। শঙ্কর কুমার জানিয়েছেন, ১৯১১-এর ১৮ জুলাই ৭.৪ মাত্রার ওই ভূমিকম্পে পামির মালভূমির মাঝের অংশটা লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল। একটি নদীর গতিপথ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। পাহাড়ে ধস নেমে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় বহু জনপদ।
এবারও ভূমিকম্পের পরে পাকিস্তান-আফগানিস্তানের পাহাড়ে ধস নেমেছে। তাতে ক্ষয়ক্ষতি কতটা হয়েছে, সে হিসেব এখনো মেলেনি। পামির মালভূমি ও সংলগ্ন অঞ্চলে বিপর্যয়ের বহর পরিষ্কার হলে ভূস্তরে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণেরও একটা আন্দাজ পাওয়া যাবে, মত ভূ-বিজ্ঞানীদের।
সানবিডি/ঢাকা/রাআ