এক ক্যারেট (দশমিক ২ গ্রাম) ডায়মন্ডও বৈধভাবে আমদানি করেনি। অথচ গুলশান, বায়তুল মোকাররম ও উত্তরার আপন জুয়েলার্সের শোরুমে দেদারসে বিক্রি হচ্ছে ডায়মন্ডের অলঙ্কার। মূলত কাস্টমস কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশের মাধ্যমে এসব ডায়মন্ড শুল্ক ফাঁকি দিয়ে চোরাচালানের মাধ্যমে আনা হয়েছে। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য।
কাস্টমস ট্যারিফ অনুযায়ী, ডায়মন্ড আমদানির চূড়ান্ত করভার হচ্ছে ১৫২ দশমিক ৮২ শতাংশ। এইচএস কোড হচ্ছে ৭১০২.৩৯.০০। অর্থাৎ ১০০ টাকার ডায়মন্ড আমদানি করলে সরকারকে ১৫২ টাকা ৮২ পয়সা শুল্ক কর পরিশোধ করতে হয়। এর মধ্যে ২৫ শতাংশ শুল্ক, ৬০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক, ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর, ৪ শতাংশ অগ্রিম ট্রেড ভ্যাট ও ৪ শতাংশ রেগুলেটরি ডিউটি আরোপিত আছে। মূলত এই উচ্চ শুল্ক ফাঁকি দিতেই আপন জুয়েলার্স চোরাচালানের মাধ্যমে ডায়মন্ড আমদানি করেছে।
২০১৪ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে বৈধভাবে আমদানি করা ডায়মন্ডের তথ্য হাতে এসেছে। সেখানে দেখা গেছে, অল্প কিছু প্রতিষ্ঠান বৈধভাবে সামান্য পরিমাণ ডায়মন্ড আমদানি করেছে। এ তালিকায় আপন জুয়েলার্সের নাম নেই। এরপর আপন জুয়েলার্সের বিগত দুই বছরের আমদানির তথ্য অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি এক ক্যারেট ডায়মন্ডও বৈধভাবে আমদানি করেনি।
প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা গেছে, রাজধানীতে আপন জুয়েলার্সের ৮টি শোরুম রয়েছে। যেখানে স্বর্ণালঙ্কারের পাশাপাশি ডায়মন্ডের অলঙ্কারও বিক্রি হয়। নারী-পুরুষের উভয়ের ক্ষেত্রে ডায়মন্ডের অলঙ্কার বিক্রি করে আপন জুয়েলার্স। বিভিন্ন ওজনের ডায়মন্ডে আংটি, লকেট, নাকফুল, কানের দুল, চুড়ি এবং ডায়মন্ডের সেট ও লকেট সেটের দাম সর্বনিন্ম ১০ হাজার টাকা থেকে শুরু হয়ে সর্বোচ্চ ৪০ লাখ টাকা।
অনুসন্ধানের তথ্যের সত্যতা স্বীকার করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) ড. মইনুল খান বলেন, প্রাথমিকভাবে আপন জুয়েলার্সের ব্যবসা নিবন্ধন নম্বর (বিআইএন) তল্লাশি করে ডায়মন্ড আমদানির তথ্য পাওয়া যায়নি। এতে বোঝা যায়, তার হয়তো ডায়মন্ড চোরাচালানের মাধ্যমে দেশে আনে, অথবা মিস ডিক্লারেশনের (ঘোষিত পণ্যের পরিবর্তে অন্য পণ্য আনা) মাধ্যমে সেগুলো আনা হয়। শিগগিরই এ বিষয়ে শুল্ক গোয়েন্দা অনুসন্ধান শুরু করবে। তিনি আরও বলেন, তার দোকানে যেসব ডায়মন্ড বিক্রি হচ্ছে, সেগুলো আসল কিনা, সেগুলোর ক্রয়-বিক্রয় প্রক্রিয়া স্বচ্ছ আছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হবে।
এ বিষয়ে জানতে আপন জুয়েলার্সের স্বত্বাধিকারী দিলদার আহমেদ সেলিমের সেলফোনে শুক্রবার একাধিকবার ডায়াল করা হলে তিনি কল রিসিভ করেনি। একইদিন ওই সেলফোন নম্বরে এসএমএস করা হয়। তিনি এসএমএসের উত্তরে বলেন, ‘ক্যান আই কল ইউ লেটার (আমি কি পরে ফোন দিতে পারি)।’ এরপর রাত ১০টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তিনি আর ফোন দেননি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি (আপন জুয়েলার্স) তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করে শাড়ির ব্যবসার মাধ্যমে। ওই ব্র্যান্ডের নাম ছিল ‘আপন শাড়ি’। এরপর তারা জুয়েলারি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়। এ ব্যবসার মধ্য দিয়েই তাদের ভাগ্যের চাকা ফেরে। নিজস্ব সিন্ডিকেট তৈরির মাধ্যমে আপন জুয়েলার্স চোরাচালানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। জুয়েলারি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত প্রায় সবাই তাদের উত্থানের গোপন রহস্য কম-বেশি জানেন। বিভিন্ন সময় এ নিয়ে তার সমালোচনাও করা হয়েছে। কারও সমালোচনার তোয়াক্কা না করে সিন্ডিকেট পরিচালনার মাধ্যমে রাতারাতি ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ হয়ে যান তারা (আপন জুয়েলার্সের মালিক)। বিগত বিএনপি সরকারের আমলে রাইফেলস স্কয়ারে (বর্তমানে সীমান্ত স্কয়ার) আপন জুয়েলার্সের শোরুমে যৌথ বাহিনী অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ চোরাচালানের মাধ্যমে আনা স্বর্ণালঙ্কার জব্দ করে। পরে সেটিকে ধামাচাপা দেয়া হয়।
প্রসঙ্গত, ২৮ মার্চ বনানীর দ্য রেইনট্রি হোটেলে জন্মদিনের পার্টিতে দাওয়াত দিয়ে এনে দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে ধর্ষণ করে আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাত ও তার বন্ধুরা। ৬ মে রাতে ভুক্তভোগীদের একজন বনানী থানায় আসামিদের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন। এরপর আবারও আলোচনায় আসে আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদ সেলিমের অতীত কর্মকাণ্ড। সূত্র: যুগান্তর