চিকুনগুনিয়ায় আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের
আপডেট: ২০১৭-০৫-১৮ ২১:০১:১৯
বর্তমান সময়ে আলোচিত চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু জ্বর সম্পর্কে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। তারা বলছেন, এ রোগ প্রতিরোধের টিকা এখনো আবিষ্কার হয়নি। তাই সচেতনতার মাধ্যমে ভাইরাস সংক্রমিত রোগটি প্রতিরোধ করতে হবে। বৃহস্পতিবার রাজধানী মহাখালীর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটে চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গুজ্বর বিষয়ে সাংবাদিক অবহিতকরন সভায় তারা এ পরামর্শ দেন। সভায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক প্রফেসর আবুল কালাম আজাদ, ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের প্রফেসর খান আবুল কালাম আজাদ, রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের পরিচালক মীরজাদী সাব্রিনা ফ্লোরা ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের পরিচালক ডা. সানিয়া তাহমিনা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় বিশেষজ্ঞরা বলেন, চিকুনগুনিয়া একটি ভাইরাস জনিত জ্বর যা আক্রান্ত মশার কামড়ে মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায়। এ রোগটি ডেঙ্গু, জিকার মতই এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। এছাড়া এডিস ইজিপ্টি, এডিস এলবোপিকটাস মশার মাধ্যমে ছাড়ায়। এসব মশার শরীরে ও পায়ে সাদা কালো ও ডোরাকাটা দাগ থাকে। সাধারনত ভোর, দিনের বেলা এবং সন্ধ্যায় কামড়ায়। আর ভাইরাস আক্রান্ত রোগির মাধ্যমে ও ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার মাধ্যমে অসাবধানতা বশত এটি ছড়াতে পারে। এছাড়া হঠাৎ ভারী বর্ষণ ও বর্ষা মৌসুমে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগের প্রকোপ বাড়তে পারে।
বিশেষজ্ঞরা আরো জানান, ডেঙ্গুর লক্ষণ হলো- জ্বর ১০৪ থেকে ১০৫ ডিগ্রি হতে পারে। পাশাপাশি মাথা ব্যাথা, মাংস পেশি, চোখের পেছনে ও হারে ব্যাথা, চামড়া লালচে র্যাশ দেখা দেয়। আর জ্বরের প্রথম দিনই ডেঙ্গু পরীক্ষা করা যায়। এন্টিজেন পরীক্ষা করলেও ধরা পড়ে। আর হেমরজিক ডেঙ্গু জ্বরে ও ডেঙ্গু শক সিনড্রোম হলে দাঁতের মাড়ি, নাক মুখ ও পায়খানারা রাস্তায় রক্তপাত হতে পারে। ডেঙ্গুতে রক্তের প্লাটিলেট কমিয়ে রক্তশূন্যতা দেখা দিতে পারে।
অন্যদিকে চিকুনগুনিয়া জ্বর প্রথমে অল্প থেকে বেশি হবে এমনকি ১০৫ ডিগ্রি থেকেও অধিক হতে পারে। শরীরের চামড়াতে বেশি পরিমানে র্যাশ দেখা যাবে। তখন প্রথম ৫ দিন অন্তর পরীক্ষা করতে হবে। তবে এটি ডেঙ্গু জ্বরের মত হলেও রক্ত শূণ্যতা দেখা দেয়না। এ জ্বরে গোড়ালি থেকে পা ও হাঁটুতে প্রচন্ড ব্যথা হয় যা কয়েক মাস পর্যন্ত থাকতে পারে। ফলে গিটের ব্যাথার জন্য ঠান্ডা পানির সেক এবং হালকা ব্যায়াম উপকারি হতে পারে। চিকুন গুনিয়াতে রক্তের প্লাটিলেট কমবে না।
প্রফেসর খান আবুল কালাম আজাদ বলেন, এটি একটি নতুন রোগ বলে গ্রাম পর্যায়ে অনেক চিকিৎসকই জানেন না। তবে সেখানে প্রচার করা হচ্ছে। চিচুনগুনিয়া টোগা ভাইরাস গোত্রের ভাইরাস। মশাবাহিত হবার কারনে একে আরবো ভাইরাসও বলা হয়। আর এক্ষেত্রে ডেঙ্গু জিকা ভাইরাস একই মশার মাধ্যমে ছড়ায় এমনকি রোগের লক্ষণও একই রকম। এ রোগর উপসর্গ হল হঠাৎ জ্বর আসা, প্রচন্ড গিটে গিটে ব্যাথা, প্রচন্ড মাথা ব্যাথা, শরীরে ঠান্ডা অনুভূতি, বমিবমি ভাব, চামড়ায় লালচে দানা ও মাংসপেশিতে ব্যথা অনুভূত হয়। চিকৎসার বিষয়ে তিনি জানান, এ রোগের ভাইরাস সংক্রমনের চিকিৎসা মূলত উপসর্গ ভিত্তিক, এর কোন সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নাই। আক্রান্ত ব্যক্তিকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে। প্রচুর পরিমানে পানি ও তরল জাতীয় খাবার খেতে হবে। প্রয়োজনে জ্বর ও ব্যথার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ খাওয়া যেতে পারে। গিটের ব্যথায় সেক দেয়া যাবে। তবে জ্বর যদি পাঁচ দিনের মধ্যে ভালো না হয়। বমি হলে, ডায়াবেটিস আক্রান্ত বা গর্ভবতি হলে হলে দ্রুত নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্র নিতে হবে। আর এর বাইরে যদি স্বাভাবিক জ্বর হয় তবে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নাই।
মীরজাদী সাব্রিনা ফ্লোরা জানান, সাধারনত রোগটি এমনিতেই সেরে যায়, এর সুপ্তিকাল ৩ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত। আবার ২১ দিন পর্যন্ত থাকতে পারে। কখনো কখনো ব্যাথা কয়েক মাস এমনকি কয়েক বছরের বেশি সময়ও থাকতে পারে। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে রাজধানীর কলাবাগান, হাতির পুল, গ্রীনরোড, কাঠালবাগান এলাকাতে মোট ১৪৫ জন রোগি সনাক্ত করে আইইডিসিআরে নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এদের মধ্যে মাত্র ৩৫ জনের চিকুনগুনিয়া ভাইরাস ধরা পরেছে। আর সারা দেশে এপ্রিল থেকে মে মাসের গতকাল পর্যন্ত মোট ১৩৯ জন সন্দেহভাজন রোগিকে পরীক্ষা করে মোট ৮৬ জনকে চিকুনগুনিয়া পজিটিভ পাওয়া গেছে। তবে এতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই বলে তিনি মন্তব্য করেন।
প্রফেসর আবুল কালাম আজাদ বলেন, এটি জাতীয়ভাবে মোকাবেলা করতে হবে। এ রোগের উপসর্গ দেখা দিলে এক সপ্তাহের মধ্যে সেরোলজি এবং আরটি-পিসিআর টেষ্ট করে সনাক্ত করা যায়। সরকারের সহযোগিতায় গত বছর রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট দেশের তিন হাজার ৭০০ জন চিকিৎসককে এ বিষয়ে ট্রেনিং দেয়া হয়েছে। বর্তমানে উপজেলা পর্যায়ে প্রতি মাসে এবং বিভাগ জেলা পর্যায়ে সপ্তাহের সোম ও বৃহস্পতিবার ভিডিও কনফারেন্সের মাধম্যে হাসপাতালের সিভিল সার্জন চিকিৎসকদের সঙ্গে চলমান রোগ ব্যাধি নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে। এছাড়াও অধিদপ্তরের ই-মেইলে তাদের জানান দেয়া হচ্ছে। চিকুনগুনিয়ার পরীক্ষা-নীরিক্ষার জন্য আইইডিসিআর গাইডলাইন দিচ্ছে। আগাম সচেতনাতার জন্য মশার বংশ বিস্তার প্রতিরোধে সকল স্টেকহোল্ডারদের সমন্বয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। জনসচেতনায় মাইকিং ও প্রত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে। রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা (সিডিসি ও আইইডিসিআর) নিয়মিত ডেঙ্গু আক্রান্তদের তথ্য সংগ্রহ করতে বিভাগ জেলা, জেলা ও উপজেরা পর্যায়ে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে খোঁজ রাখছে।