রাজধানী ঢাকার আশপাশে জঙ্গিরা আস্তানা পেতেছে। হলি আর্টিজানে হামলার পর রাজধানীতে একের পর এক অভিযানের মুখে আশপাশেই ঘাঁটি হিসেবে বেছে নেয় জঙ্গিরা। টঙ্গি, গাজীপুর, সাভার, আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জ, ডেমরা, রূপগঞ্জ, ফতুল্লা, সিদ্দিরগঞ্জ, বাসাবো, উত্তরা, দক্ষিণ খান, উত্তর খান, হরিরামপুরসহ আশপাশের এলাকায় জঙ্গি তৎপরতা বেড়েছে।
বেশি জঙ্গি তৎপরতা ডেমরা, সিদ্দিরগঞ্জ ও ফতুল্লায়। কেননা এসব এলাকায় প্রায় ৫ হাজার ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তবে এসব এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়মিত ব্লক রেইড ও অভিযানের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে গ্রামমুখী হচ্ছে জঙ্গিরা। ইতোমধ্যে রাজশাহী, ঝিনাইদহ, সিলেট ও গাজীপুরে অভিযানে জঙ্গি আটক হয়েছে।
বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা হামলা করে আত্মপ্রকাশ করে জেএমবি। পরে জেমমবি নেতা শায়খ আব্দুর রহমান ও বাংলা ভাইসহ ৬ শীর্ষ জঙ্গি নেতার ফাঁসি হয় ২০০৭ সালে। সেসময় বলা হয়, জঙ্গিদের শেকড় উপড়ে ফেলা হয়েছে। তবে নানা সময় অভিযানে জঙ্গি আটক হয়েছে। অভিযানও হয়েছে, জঙ্গিও ধরা পড়েছে। তবে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, এতো জঙ্গি আসছে কিভাবে?
গত বছরের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলা চালিয়ে নিজেদের জানান দেয় নব্য জেএমবির সদস্যরা। ওই ঘটনার পরদিন সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযানে নিহত হয় পাঁচ জঙ্গি। গুলশানের হলি আর্টিজান থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে গত ২০টি জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালিয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। এ ছাড়া বিচ্ছিন্নভাবেও চলে অভিযান। এসব অভিযানে নারী জঙ্গিদের সঙ্গে তাদের শিশু-সন্তানরাও নিহত হয়। এ পর্যন্ত মারা গেছে ৬ শিশু।
গুলশান হামলায় নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতারা নিহত হলেও এখনও ওই গ্রুপের সদস্যদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে তাদের অনুসারীরা। তবে নব্য জেএমবির আর কত সদস্য রয়েছে, তা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছেও সঠিক তথ্য নেই।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য মতে, গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার পর রাজধানীসহ ঢাকার আশপাশে জঙ্গিবিরোধী সফল অভিযান চালানো হয়। এতে বেশ কিছুদিন জঙ্গি তৎপরতা কমে গেলেও হঠাৎ করে ঢাকার বাইরের জেলা, বিভাগীয় শহর ও মহাসড়কগুলোর আশপাশে জঙ্গিরা শক্তিশালী আস্তানা তৈরি করে। জঙ্গিরা জনসমাগম কম এমন এলাকা বেছে নিয়ে গড়ে তুলছে অস্ত্র ও বিস্ফোরক মজুদের কারখানাসহ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এসব আস্তানার অধিকাংশ নব্য জেএমবির সদস্যদের। সম্প্রতি পার্বত্য অঞ্চলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে অস্ত্রসহ আটক হয় আরাকান আর্মির সদস্য ইমন। সেসময় সে জবানবন্দিতে উল্লেখ করে, পার্বত্য অঞ্চলে তিনটি সন্ত্রাসী গ্রুপের মাধ্যমে এদেশে জঙ্গিরা অস্ত্র পাচ্ছে। পাহাড়ের গহীন অরণ্যে জঙ্গিদের অস্ত্রের প্রশিক্ষণও দেয় সন্ত্রাসীরা। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে এসব তথ্য জানিয়েছে ইমন।
হলি আর্টিজান থেকে শুরু করে নানা অভিযানে এ পর্যন্ত নিহত হয়েছে র্যাব ও পুলিশের ৭ সদস্য। এসব ঘটনায় র্যাব ও পুলিশসহ আহত হয়েছে শতাধিক মানুষ। তবে পুলিশ কর্মকর্তাদের মতে, জঙ্গিদের বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা নস্যাত্ করে অভিযান জোরালো করায় জঙ্গিরা কৌশল পরিবর্তন করেছে।
গুলশান হামলার পর র্যাব ও পুলিশের পৃথক অভিযানে শতাধিক জঙ্গি গ্রেফতার হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ধারণা, জঙ্গিরা দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলসহ দেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছে। তাদের কাছে বিপুল অস্ত্র ও গোলাবারুদের মজুদ রয়েছে।
পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, জঙ্গিদের পরিকল্পিত হামলা চালানোর সুযোগ নেই। তারা তৎপর হলেই আমাদের জালে ধরা পড়ে যায়।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ বলেন, জঙ্গিদের তত্পরতা রয়েছে। তবে জঙ্গিদের মাথাচাড়া দিয়ে উঠার সুযোগ নেই। জঙ্গিবিরোধী অভিযান দেশব্যাপী চলছে।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেন, জঙ্গিদের তিনটি শাখা রয়েছে। সামরিক, দাওয়াতি ও প্রশিক্ষণ এবং মিডিয়া শাখা। তবে জঙ্গিদের এসব কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। সামরিক শাখা বিধ্বস্ত করে দিয়েছি আমরা। জঙ্গি মাথাচাড়া দিয়ে উঠলইে ধরা পড়বে। রাজধানীতে বাসা ভাড়া নিতে কষ্ট হয় বলেই জঙ্গিরা এখন গ্রামমুখী হয়েছে। ভারতীয় নাগরিক সফি আরমারের হামলার পরিকল্পনা বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ধরনের কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই।
পুলিশের আইজি একেএম শহীদুল হক বলেন, জঙ্গি তত্পরতা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ভারতের জঙ্গি নেতা সফি আরমারের বিষয়ে অনুসন্ধানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। জঙ্গিরা কোথাও আস্তানা পাততে পারবে না। সাধারণ মানুষও এখন অনেক সচেতন। জঙ্গিদের সম্পর্কে জানার সঙ্গে সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে তথ্য দিয়ে দিচ্ছে।
জঙ্গিবিরোধী যত অভিযান : ২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিজানে ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’, ২৬ জুলাই কল্যাণপুরের জাহাজবাড়িতে ‘অপারেশন স্টর্ম-২৬’ ও ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় ‘অপারেশন হিট স্ট্রং-২৭’ পরিচালিত হয়। নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় পরিচালিত অভিযানে নিহত হয় নব্য জেএমবির নেতা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম চৌধুরী। গত ২ সেপ্টেম্বর রাতে মিরপুরের রূপনগরে নিহত হয় নব্য জেএমবির অবসরপ্রাপ্ত মেজর জাহিদুল ইসলাম। গত ১০ সেপ্টেম্বর আজিমপুরে নিহত হয় নব্য জেএমবির অন্যতম শীর্ষ নেতা ও আশ্রয়দাতা তানভীর কাদেরী। গত ৮ অক্টোবর গাজীপুর, আশুলিয়া ও টাঙ্গাইলসহ চারটি আস্তানায় অভিযান চালায় র্যাব-পুলিশ। এসব অভিযানে জঙ্গিদের অর্থদাতাসহ নিহত হয় ১২ জঙ্গি। ২৪ ডিসেম্বর আশকোনার জঙ্গি আস্তানায় ‘অপারেশন রিপল ২৪’ অভিযানে জঙ্গি নেতা তানভীর কাদেরীর ছেলেসহ দুজন নিহত হয়।
চলতি বছর প্রথম জঙ্গিবিরোধী অভিযান চালানো হয় গত ১৭ মার্চ। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ‘অপারেশন অ্যাসল্ট ১৬’ নামে পরিচালিত এ অভিযানে নিহত হয় চার জঙ্গি। গত ২৫ মার্চ সিলেটের দক্ষিণ সুরমায় আতিয়া মহলে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে পরিচালিত অভিযানের নামকরণ করা হয় ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’। এতে নিহত হয় চারজন। গত ৩০ মার্চ মৌলভীবাজারের নাসিরপুরে ‘অপারেশন হিটব্যাক’-এ আত্মঘাতী হয়ে নিহত হয় নারী-পুরুষ-শিশুসহ একই পরিবারের সাতজন। গত ১ এপ্রিল মৌলভীবাজারের বড়হাটে ‘অপারেশন ম্যাক্সিমাস’ অভিযানে আত্মঘাতী হয়ে মারা যায় নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতা মুসাসহ তিনজন। ৭ মে ঝিনাইদহে পুলিশি অভিযানে দুই জঙ্গি নিহত হয়েছে। এছাড়া আহত হয়েছে পুলিশের তিন সদস্য। ১৩ জুন রাজশাহীর তানোরের ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের জঙ্গি আস্তানায় চালানো অভিযান ‘রিবার্থ’ শেষ হয়। ওই বাড়ি থেকে দুটি সুইসাইডাল ভেস্ট, পাঁচ রাউন্ড গুলিসহ একটি ৭.৬২ মডেলের বিদেশি পিস্তল ও একটি ম্যাগাজিন উদ্ধার করা হয়।