'রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোই একমাত্র সমাধান। জাতিসংঘের চলতি অধিবেশনে এদের ফেরত পাঠানোসহ রোহিঙ্গা সংকটই আলোচনায় প্রাধান্য পাবে।'
রোববার ঢাকায় নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী রবার্ট ওয়াটকিন্স সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে এসব তথ্য দেন।
জাতিসংঘের চলতি অধিবেশনের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আরও সঠিক ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত আসবে বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।
পরদিকে, কমনওয়েলথ মহাসচিব পেট্রিসিয়া স্কটল্যান্ড বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়ায় বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। সুইজারল্যান্ড রোহিঙ্গাদের জন্য জরুরি সহায়তা ঘোষণা করেছে।
রোববার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের সঙ্গে এক বৈঠক করেন ঢাকায় নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী রবার্ট ওয়াটকিন্স।
বৈঠক শেষে রবার্ট ওয়াটকিন্স সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে বলেন, বৈঠকে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। আমরা জেনেছি, ২৫ আগস্টের ঘটনার পর থেকে এ পর্যন্ত ৪ লাখ ১৯ হাজার রোহিঙ্গা এসেছে। তাদের মানবিকভাবে সাহায্যের জন্য আমরা আলোচনা করেছি।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের ত্রাণ সহায়তার জন্য জাতিসংঘের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক সহায়তা চাওয়া হয়েছে। নতুন করে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের নিয়ে ভাবলেই শুধু চলবে না, আমাদের মনে রাখতে হবে, বহু বছর ধরে রোহিঙ্গারা এখানে এসেছেন। তাদেরও সহায়তা দিতে হবে। এটি কঠিন একটি কাজ।
রোহিঙ্গা সংকটের দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের বিষয়ে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী বলেন, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোই একমাত্র সমাধান। এদের শান্তিপূর্ণভাবে সেখানে পাঠানোই হতে পারে একমাত্র সমাধান। রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব বিবৃতি দিয়েছেন। এছাড়া বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনা হয়েছে।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে মিয়ানমারের ওপর অবরোধ আরোপ করা সম্ভব হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। এটা টেবিলে আলোচনা করে ঠিক করতে হবে। যে কোনো সিদ্ধান্তই টেবিলে আলোচনার মাধ্যমে সবার মতামতের ভিত্তিতেই আসবে।
জাতিসংঘের এ অধিবেশনে ১৯৩টি দেশ অংশগ্রহণ করছে। সেখানে রোহিঙ্গা সংকটই হবে গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা।
এক প্রশ্নের উত্তরে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি বলেন, রোহিঙ্গাদের ত্রাণ সহায়তা কার্যক্রমে জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে সমন্বয় রয়েছে। আমরা সবাই সমন্বয়ের মাধ্যমে চমৎকার কাজ করছি। এ সমন্বয়ের জন্য আমরা সন্তোষ প্রকাশ করেছি। রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ সহায়তা নিয়ে জাতিসংঘের হেডকোয়ার্টার, ঢাকা অফিস কাজ করছে। গত বৃহস্পতিবার ইউএনএইচসিআর ও আইওএম কর্মকর্তাদের নিয়ে আমরা একটি বৈঠকও করেছি।
এদিকে মিয়ানমার বাংলাদেশের আকাশসীমা লংঘন করছে, এ বিষয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেকবার বলেছেন, মিয়ানমারের রাজনৈতিক নেতৃত্ব নতুন। গণতন্ত্রের যাত্রাও সেখানে নতুন। সেখানে অনেক বিষয় রয়েছে। সেখানে কে কোন উদ্দেশ্যে এটা করছে, এটা মাথায় নিয়েই আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আর ক‚টনৈতিক ভাষাও একটু আলাদা। ক‚টনৈতিকভাবে আমরা পুরো বিশ্বকেই আমাদের পাশে পেয়েছি। সেখানে আমরা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতেই পারি।
রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পদক্ষেপের বিষয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, গতকালই জাতিসংঘের মহাসচিব একটি বিবৃতি দিয়েছেন। তিনি এতে বলেছেন, জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দেয়া অং সান সুচির জন্য শেষ সুযোগ। সেখানে মহাসচিব রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বলেছেন, এখনই যদি এটাকে থামানো না হয়, তাহলে নাগালের বাইরে চলে যাবে। এর মধ্যে বার্তা রয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নও মিয়ানমারকে বার্তা দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের রেজুলেশন যদি আপনারা পড়ে থাকেন, তাহলে দেখবেন সেখানে কঠোরভাবে মিয়ানমারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। জাতিসংঘের অধিবেশনের মধ্য দিয়ে আরও সঠিক ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত আসবে। সেখানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যতদূর যেতে হয়, তারা নিশ্চয় যাবে।
আমাদের বেশ কয়েকটি বন্ধুরাষ্ট্র রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারকে সমর্থন করছে- এ বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, এ বিষয়ে আমি খুব বেশি চিন্তিত নই। কেননা অনেক রাষ্ট্রই মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সঙ্গে সমানভাবে সম্পর্ক রাখায় আগ্রহী। তারা উভয় দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব রেখে চলেছে, সামনের দিনেও চলবে। তবে সব রাষ্ট্রই এ ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছে।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে সরকারের পদক্ষেপের বিষয়ে বিএনপি যে সমালোচনা করছে, তার জবাবে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে মিয়ানমার থেকে গ্যাস উত্তোলন করেছিল। আর সেই গ্যাস বাংলাদেশে আনার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। তবে সেই গ্যাস এখন একটি ভারতীয় কোম্পানি মিয়ানমার থেকে উত্তোলন করে চীনে রফতানি করছে। মিয়ানমারের গ্যাস বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে ভারতে গেলে আমরা রাজনৈতিক টুলস হিসেবে এখন ব্যবহার করতে পারতাম। তবে এখন সেটা সম্ভব হচ্ছে না।
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে সরকারের কার্যক্রমের বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, জাতিসংঘে যেমন সমাধান খোঁজা হচ্ছে আবার দেশের অভ্যন্তরে মানবিক সাহায্যের বিষয়টিও দেখা হচ্ছে। একইসঙ্গে দেশের মধ্যেও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের এক জায়গায় রাখার চেষ্টা চলছে।
রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশ ক্ষতিপূরণ চাইবে কিনা, এমন প্রশ্নের উত্তরে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমরা আত্মমর্যাদাশীল জাতি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এগিয়ে না এলেও আমাদের এসব রোহিঙ্গাকে সহায়তা করা লাগত। তবে ১৬ কোটি মানুষের পাশাপাশি এই ৮ লাখ বা ১০ লাখ মানুষকেও সহায়তা করতে পারব বলেও প্রত্যাশা রয়েছে।
কমনওয়েলথ মহাসচিবের প্রশংসা :
বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়ায় বাংলাদেশের ভ‚য়সী প্রশংসা করেছেন কমনওয়েলথ মহাসচিব পেট্রিসিয়া স্কটল্যান্ড। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, এটা একটা বড় মানবিক সংকট। পালিয়ে আসাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। যাদের নিজেদের বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে আসা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না তাদের আশ্রয় দেয়ায় বাংলাদেশের প্রশংসা করি। এসব মানুষকে খাদ্য, আশ্রয় আর কাপড় দিয়ে বাংলাদেশ কমনওয়েলথের শুভ বৈশিষ্ট্যের কাজই করেছে।
সুইজারল্যান্ডের জরুরি সহায়তা :
ঢাকায় সুইজারল্যান্ড দূতাবাস রোববার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, সুইজারল্যান্ড রোহিঙ্গাদের জন্য ১০ কোটি ২০ লাখ টাকার সমপরিমাণ ১২ লাখ সুইস ফ্রাঙ্ক সহায়তা দেবে। বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের জীবন রক্ষা বিশেষ করে খাদ্য নিরাপত্তা, আশ্রয়, পানি ও পয়োনিষ্কাশনের কাজে এ অর্থ ব্যবহার করা হবে। সুইজারল্যান্ড এই মানবিক সংকট নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।