নাগরিকদের বেশির ভাই মনে করছেন, নির্বাচনে আঙ্গেলা ম্যার্কেল জিতে আসবেন। ম্যার্কেলের জনপ্রিয়তার আরেকটি কারণ হচ্ছে তাঁর নেতৃত্বের ক্যারিশমা। তিনি নিজেকে জার্মানির গণ্ডি পেরিয়ে ইউরোপের প্রভাবশালী নেতায় পরিণত করেছেন। সেই হিসেবে তাঁর বিপরীতে সোশ্যাল ডেমোক্রেট পার্টির তেমন কোনো ক্যারিশমাটিক নেতার আগমন ঘটেনি যে ম্যার্কেলের ইমেজকে ম্লান করে সামনে এগিয়ে আসবে। অধিকাংশ জার্মানই মনে করেন ব্রেক্সিটের কারণে ব্রিটেন ইইউ থেকে বেরিয়ে গেলে জার্মানিই হবে ইইউয়ের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা। সত্যি কথা বলতে গেলে, ম্যার্কেলের চ্যালেঞ্জ করার মতো নেতা এই মুহূর্তে ইউরোপে কেউ নেই বলেই মনে করা হচ্ছে।
সাম্প্রতিক নির্বাচনী জরিপগুলোতেও এমন আভাসই মিলছে। ভালরেখটের ১৯ সেপ্টেম্বর পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, সিডিইউ-সিএসইউ জোটের প্রতি ৩৮ শতাংশ ভোটারের সমর্থন আছে। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মার্টিন শুলজের নেতৃত্বাধীন সোশ্যাল ডেমোক্রেট পার্টিকে (এসডিপি) ২৩ শতাংশ ভোটার সমর্থন করছেন। সমর্থন হ্রাস পেয়েছে তাঁর। চরম ডানপন্থী অভিবাসীবিরোধী পপুলিস্ট দল অলটারনেটিভ ফর ডয়েচল্যান্ডের (এএফডি) প্রতি ১০ শতাংশ ভোটারের সমর্থন আছে। ফ্রি ডেমোক্রেটিক পার্টি (এফডিপি) ও বাম দল ‘ডি লিঙ্ক’ও ১০ শতাংশ ভোটারের সমর্থন পাচ্ছে। জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ায় পরিবেশবাদী গ্রিন পার্টি পাচ্ছে ৬ শতাংশ ভোটারের সমর্থন।
ঠিক কী কী কারণে আঙ্গেলা ম্যার্কেল চতুর্থবারের মতো চ্যান্সেলর পদে ফিরে আসতে পারেন বা নির্বাচনের আগে তাঁর দলের সমর্থন বেড়ে গেল কেন? এখানে মনে রাখতে হবে ম্যার্কেলের কারণেই সিডিইউর প্রতি ভোটারদের সমর্থন বেড়েছে। দলের কারণে ম্যার্কেলের জনপ্রিয়তা বাড়েনি। সিরীয় উদ্বাস্তু থেকে অনেক বিষয়েই দলের অনেকের সঙ্গেই ম্যার্কেলের মত মেলেনি। যেমন সমকামী বিয়ের বৈধতা দানের বিষয়টি।
অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা হবে ম্যার্কেলের জয়ের অন্যতম কারণ। বিশেষ করে সদ্য অর্থনৈতিক মন্দার সময় ম্যার্কেল দক্ষতার সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক নীতি নিয়ন্ত্রণ করেছেন। মন্দার খুব একটা আঁচ জার্মানির অর্থনীতিতে পড়তে দেননি। একই সঙ্গে তিনি শক্ত হাতে ইউরোপের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন। সমালোচনার মুখেও তিনি গ্রিসের অর্থনৈতিক সংস্কারে ইইউর মাধ্যমে হস্তক্ষেপ করেছেন। ঋণসহায়তা দিয়েছেন। অবশ্য অনেকেই সমালোচনা করে বলে থাকেন, এই ঋণ প্রদান করে জার্মানি লাভবান হয়েছে। তবে সবকিছু মিলিয়ে তিনি ইউরোপের প্রভাবশালী নেতায় পরিণত হয়েছেন।
দেশজ অর্থনীতির ক্ষেত্রে ম্যার্কেলের সময় বেকারত্বের হার উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে এবং অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বেড়েছে। রপ্তানি আয় বেড়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের হিসেব অনুসারে বর্তমানে জার্মানিতে বেকারত্বের হার ৩.৯ শতাংশ। এখন গত ২০ বছরের তুলনায় বেকারত্বের হার সবচেয়ে কম। ২০০৫ সালে আঙ্গেলা ম্যার্কেল যখন চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব নেন, তখন জার্মানির বেকারত্বের হার ছিল সর্বোচ্চ ১১.২ শতাংশ। ম্যার্কেলের পূর্ববর্তী গেরহার্ড শ্রোয়েডারের সময় বেকারত্ব বৃদ্ধি পেয়েছিল। সামাজিক নিরাপত্তায় অনেক কাটছাঁট হয়েছিল। ম্যার্কেল ক্ষমতায় আসার পর এ বিষয়ে তেমন কোনো পরিবর্তন করেননি। বরং তিনি কিছু কিছু সংস্কার করেছেন, যেমন আয়কর পদ্ধতিতে কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে। স্বল্প আয়ের বড় পরিবারের আয়কর কমেছে। বেশি আয়ের ছোট পরিবারের আয়কর বেড়েছে। দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি স্থিতিশীল আছে। এ ছাড়া বড় করপোরেট হাউসগুলো ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটদের সমর্থন দিচ্ছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে দেখা যাচ্ছে।
ম্যার্কেল হচ্ছেন ব্রিটেনের মার্গারেট থ্যাচারের পর ইউরোপের সবচেয়ে সফল নারী রাজনৈতিক নেতৃত্ব। তবে পার্থক্য হচ্ছে, থ্যাচার যতটা লৌহমানবী হিসেবে ইতিহাসে পরিচিত, ম্যার্কেল তেমন কট্টরপন্থী নন। কট্টরপন্থী হিসেবে তাঁর দলের একটি পরিচিতি থাকলেও ম্যার্কেল বেশ উদারনৈতিক নেতা হিসেবেই পরিচিত। শুধু তা-ই নয়, ম্যার্কেল তাঁর দলকে কট্টরপন্থা থেকে অনেকটাই বের করে এনেছেন। এখন একটি কথা খুব বেশি করে জার্মানদের মধ্যে আলোচনা হয় যে এসডিপি, লিঙ্ক ও গ্রিন পার্টির কর্মসূচি বেশির ভাগই বাস্তবায়ন করছে সিডিইউ। এ কারণে তার দলের সমর্থনও বাড়ছে।
ধারণা করা হচ্ছে, জার্মানির ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো অভিবাসীরা অধিক হারে সিডিইউকে ভোট দেবে। ঐতিহ্যগতভাবেই অভিবাসীরা এসপিডি, লিঙ্ক (বাম) ও গ্রিন পার্টির সমর্থক ও ভোটার হিসেবে পরিচিত ছিল। ২০১৫ সালে ম্যার্কেলের ১০ লাখের বেশি সিরীয় উদ্বাস্তুকে গ্রহণ করেছেন। দলের সমালোচনা ও অবস্থানের বাইরে গিয়েই ম্যার্কেল অভিবাসী গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। ওই সময় এসপিডি ম্যার্কেলকে জোরালোভাবে সমর্থন দেন। এমনও বলা হতো, চ্যান্সেলর হিসেবে ম্যার্কেলকে টিকিয়েই রেখেছিল সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটরা অভিবাসন বিষয়ে কট্টর অবস্থানে ছিল। সেই তুলনায় এসপিডি ছিল অনেক বেশি উদার। মজার বিষয় হচ্ছে, ম্যার্কেল নেতৃত্বে আসার পর থেকে ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটরা তাঁদের অবস্থান বদলাতে শুরু করেন। এ সময়ে দলের ভেতরেও অনেক সংস্কার করেছেন ম্যার্কেল। দলের নীতিতে এমন সব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যেসব আগে এসপিডি, বাম ও গ্রিন পার্টির কর্মসূচি হিসেবে পরিচিত ছিল। যেমন বেশি করে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহার করা। নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টগুলো পর্যায়ক্রমে বন্ধ করে দেওয়া।
সার্বিক পরিস্থিতি, সাম্প্রতিক জরিপ আমলে নিলে বলা যায়, ম্যার্কেলের জোট সমাজের নিম্ন আয়ের ভোটারদের সমর্থন পাবে বেশি। নিঃসন্দেহে এটা সিডিইউর জন্য বিশাল অর্জন। কারণ, দীর্ঘ সময় ধরে সমাজের নিম্ন আয়ের নাগরিকেরা এসডিপি, লিঙ্ক ও গ্রিন পার্টিকেই সমর্থন করত বেশি।
তবে নির্বাচনে ম্যার্কেলের জন্য নেতিবাচক হতে পারে অবসরের বয়সসীমা বাড়ানোর পদক্ষেপ। বর্তমানে অবসরের বয়সসীমা ৬৫। ম্যার্কেলের সরকার এটি বাড়িয়ে ৭০ বছর পর্যন্ত করতে চাচ্ছে। এতে করে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় কমানো সম্ভব হবে। তবে শিগগিরই অবসরে যাবেন, এমন ভোটাররা এ বিষয়টিকে ঠিক পছন্দ করছেন না। যদিও তরুণদের মধ্যে ম্যার্কেলের জনপ্রিয়তা ক্রমেই বাড়ছে।
জার্মানির নির্বাচনব্যবস্থা
পার্লামেন্ট নির্বাচনে একজন ভোটার দুটি ভোট প্রদান করেন। একটি পার্লামেন্ট পদপ্রার্থীকে, অন্যটি দলকে। সংসদে আসনসংখ্যা স্থির ও নির্ধারিত নয়। ২৯৯টি আসনে সরাসরি ভোট হয়। আর ২৯৯টি আসন প্রাপ্ত ভোটের হিসাবে বণ্টন করা করা হয়। বর্তমান সংসদে ৬৩০টি আসন আছে। এবার এর চেয়ে কমও হতে পারে। আবার বেশিও হতে পারে। নির্বাচন শেষে নতুন পার্লামেন্ট চ্যান্সেলর নির্বাচন করবে। ৫ শতাংশের বেশি ভোট না পেলে কোনো দল সংসদে আসন পায় না। তবে ওই দল থেকে জিতে আসা প্রার্থীকে অন্য দল নিয়ে নেয় বা তিনি স্বতন্ত্র হিসেবে সংসদে থাকতে পারেন। এসব কারণে বুন্ডেসটাগের আসনসংখ্যার পরিবর্তন হয়ে থাকে।
কেমন হতে পারে জার্মানির পরবর্তী পার্লামেন্ট
জরিপের মনোভাব যদি নির্বাচনে প্রতিফলিত হয়, তবে সিডিইউ-সিএসইউ জোটের সঙ্গে এফডিপির সরকার গঠনে ঐক্য হতে পারে। এতে যদি পর্যাপ্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়া যায়, তবে সে ক্ষেত্রে লিঙ্ক বা গ্রিন পার্টিকে সরকারে আমন্ত্রণ জানানো হতে পারে সিডিইউ-সিএসইউ জোটের পক্ষ থেকে। এতেও না হলে সিডিইউ ও এসডিপির গ্র্যান্ড কোয়ালিশন হতে পারে সরকার গঠনে। বর্তমানে এই গ্র্যান্ড কোয়ালিশন ক্ষমতায় আছে।
তবে এই নির্বাচনে যেই দলই সরকার গঠন করুক না কেন, সবচেয়ে আলোচ্য বিষয় হচ্ছে পপুলিস্ট দল এএফডির সমর্থন বৃদ্ধি। পাঁচ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে হয়তো বা এএফডি বুন্ডেসটাগে চলে আসতে পারে; যা জার্মানির অনেক নাগরিককেই ভাবিয়ে তুলেছে। মজার বিষয় হচ্ছে আমি নিজে ম্যার্কেল ও শুলজের যে কয়টি নির্বাচনী ভাষণ শুনেছি, তাঁরা দুজনই পরস্পরের দিকে অহেতুক কাদা ছোড়াছুড়ি না করে গঠনমূলক সমালোচনা করেছেন। তবে দুজনেরই একটি বক্তব্য মিল ছিল। বক্তব্যটি হচ্ছে, প্রিয় ভোটাররা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব আপনার। কিন্তু এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না যাতে করে নিও নাজি, বর্ণবাদী এএফডি পার্লামেন্টে আসন পেতে পারে।
জার্মানরা আদর করে ম্যার্কেলকে ‘মুটি’ বলে থাকেন। জার্মান ভাষায় ‘মুটি’ মানে মা। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, মেধা ও দক্ষতা দিয়ে ম্যার্কেল ‘মুটি’র মর্যাদা অর্জন করে নিয়েছেন। জার্মানির ‘মুটি’কে চতুর্থবারের মতো আবার চ্যান্সেলর হিসেবে দেখা গেলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। বরং সে ক্ষেত্রে জার্মান ‘মুটি’ নিজেকে ট্রাম্প, পুতিনের সমান্তরালে বিশ্বরাজনীতিতে নিয়ে যাবেন এবং ইউরোপের নেতৃত্ব দেবেন, তেমনটাই আশা করছে জার্মানরা।
ড. মারুফ মল্লিক: রিসার্চ ফেলো, সেন্টার ফর কনটেমপোরারি কনসার্নস, বার্লিন, জার্মানি