সরকারের নানা উদ্যোগ ও ব্যবসায়ীদের প্রতিশ্রুতির পরও তেমন প্রভাব নেই চালের দামের ঊর্ধ্বগতিতে। আমদানি ও পাইকারি পর্যায়ে আগের তুলনায় চালের দাম কমলেও খুচরা বাজারে সর্বত্র যৌক্তিক হারে কমেনি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আমদানি পর্যায়ে কেজিপ্রতি মোটা ও মাঝারি মানের চালের দাম ৫-৭ টাকা কমলেও পাইকারি পর্যায়ে কমেছে মাত্র ৩-৪ টাকা। দাম কমার এ প্রবণতা খুচরা বাজারে আরও কম। এখানে দাম কমেছে মাত্র ২ টাকা। অপরদিকে মিলাররা মিল গেটে প্রতি কেজি সরু চালে ২ টাকা দাম কমালেও সেটা খুচরা পর্যায়ে এসে কমেছে মাত্র ১ টাকা। তবে সেটাও সর্বত্র নয়। ফলে ভোক্তা পর্যায়ে চালের দাম এখনও সহনীয় পর্যায়ে নামছে না।
অথচ চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে চালের আমদানি শুল্ক ২৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ করা হয়েছে। আর আমদানি করার ক্ষেত্রে তুলে দেয়া হয়েছে সীমারেখা। অর্থাৎ ব্যবসায়ীরা নিজেদের চাহিদা মোতাবেক যে কোনো পরিমাণ চাল আমদানি করতে পারবে।
এছাড়া প্লাস্টিকের বস্তায় চাল আমদানির সুযোগ, রেলে চাল পরিবহনের সুবিধা এবং অভিযানের নামে হয়রানি না করার সুবিধাও বাগিয়ে নেন ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি ১৯ সেপ্টেম্বর সরকারের কাছে দেয়া ব্যবসায়ীদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ২-৪ দিনের মধ্যে দাম কমার কথা। কিন্তু অদ্যাবধি খুচরা বাজারের সর্বত্র পড়েনি এর প্রভাব।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীতে বড় আকারের ২২টি কাঁচাবাজারে এর কমবেশি প্রভাব পড়লেও মহানগরীজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রায় অর্ধশত ছোট কাঁচাবাজারের অধিকাংশ স্থানে কমেনি দাম।
এর চেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, বিভিন্ন এলাকার পাড়া-মহল্লা বা গলির মোড়ের দোকানগুলোয় চালের দাম কমার প্রভাব একদমই নেই। যদিও মহানগরীতে বসবাসরত প্রায় দেড় কোটি জনগোষ্ঠী-ভোক্তার বেশিরভাগই বাজার করেন এলাকার দোকানগুলোয়। কিন্তু মহল্লার ভেতরে ছোট বাজার কিংবা অলি-গলির দোকানে সরকারি নজরদারি না থাকায় এসব খুচরা পর্যায়ের বিক্রেতারা এখনও আগের মতো বেশি দামে কেনার অজুহাত তুলছেন ক্রেতার কাছে। ফলে বাধ্য হয়েই ক্রেতারা বাড়তি দাম দিয়ে কিনছেন চাল।
বর্তমানে মিল গেটে সরু চালের দাম রাখা হচ্ছে মানভেদে প্রতি কেজি ৫৮-৬০ টাকা। পাইকারি পর্যায়ে এটি কেজিতে ৬০-৬২ টাকা। আর খুচরা বাজারে এ চালের দাম কেজিতে ৬৩-৬৫ টাকার মধ্যে এবং গলির মোড়ের বেশিরভাগ দোকানি কোনো সরু চাল ৬৫ টাকার নিচে বিক্রি করছেন না। অন্যদিকে আমদানি পর্যায়ে মোটা চাল কেজিতে ৪০-৪১ টাকা এবং মাঝারি মানের চাল ৪৪-৪৮ টাকা হলেও পাইকারি বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে মোটা ৪৭-৪৮ টাকা এবং মাঝারি ৫৪-৫৬ টাকা।
এ প্রসঙ্গে রাজধানীর পাইকারি আড়ত বাবুবাজার-বাদামতলীর চাল ব্যবসায়ী সমিতির যুগ্ম সাধারণ
সম্পাদক ও চাল আমদানিকারক মো. কাওসার আলম খান কাছে দাবি করেন, আমদানি পর্যায়, মিল গেট কিংবা পাইকারি পর্যায়ে দাম কমলেও তার প্রভাব খুচরা বাজারে সেভাবে পড়বে না। পড়ার সম্ভাবনাও নেই। কারণ বড় কয়েকটি ছাড়া রাজধানীর বেশিরভাগ কাঁচা বাজারগুলো হচ্ছে বিচ্ছিন্নভাবে গড়ে ওঠেছে। আর বাজারের চেয়ে অলিগলিতে দোকানের সংখ্যা আরও বেশি। কিন্তু মনিটরিং করার লোক নেই। ভোক্তারাও খুব একটা দরদাম করেন না। বিক্রেতা যে দাম চাচ্ছেন, সেই দামেই নিচ্ছেন ক্রেতারা। তাই দাম কমার সুফল কখনওই সঠিকভাবে ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছাবে না বলে মন্তব্য করেন এ চাল ব্যবসায়ী নেতা।
জানতে চাইলে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, চালের দাম নিয়ে যে সংকট চলছে সেটা সরকার ও ব্যবসায়ীদের দ্বৈত অবস্থানের কারণেই হচ্ছে। এ কারণে আমদানি পর্যায়ে দাম যে হারে কমেছে, সেই হারে খুচরা পর্যায়ে তার প্রভাব পড়ছে না। ফলে ভোক্তারাও বাজার বা দোকানে চাল কিনে কম দামের সুফল নিতে পারছেন না।
এখানে বড় ঘাটতি হচ্ছে সরকারের কঠোর মনিটরিং ব্যবস্থা না থাকা। তাই দাম একবার কমলে সেটা আর কমিয়ে আগের অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার মানসিকতা দেখান না ব্যবসায়ীরা। তিনি আরও বলেন, চাল একটি স্পর্শকাতর পণ্য। এর ওপর সরকারের অনেক ভালো-মন্দ নির্ভর করে। তাই সরকারের উচিত বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে বড় বাজারগুলোর পাশাপাশি ছোট ছোট বাজার এবং গলির মোড়ের দোকানগুলোও নজরদারিতে নিয়ে আসা।
নিয়মিত মনিটরিং জোরদারের মাধ্যমে সব দোকানে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকা ও দাম প্রদর্শন নিশ্চিত এবং ক্রয়-বিক্রয়ে ক্যাশ মেমো যাচাই-বাছাই করা। এক্ষেত্রে কেউ অতিরিক্ত মুনাফা করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া। এজন্য যদি সরকারকে অতিরিক্ত জনবল এবং বাজেটের প্রয়োজন হয় সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। জানা গেছে, দেশে এখন মোটা চালের সংকট। এ কারণে আমদানি করা চালের বেশিরভাগই হচ্ছে মোটা ও মাঝারি মানের। আন্তর্জাতিক বাজারে এখন এ চালের দাম কম। তাছাড়া বেসরকারিভাবে আমদানি চালের বেশিরভাগ আসছে ভারত থেকে।
আমদানিকারকদের এলসি মূল্য ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আমদানি পরিস্থিতি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ভারত থেকে আনা প্রতি কেজি চালের আমদানি মূল্য পড়ছে ৩৪ টাকা থেকে ৩৮ টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারে চালের মূল্যে স্থিতিশীলতা ফেরাতে হলে মিলার পর্যায়ে দাম ২ টাকা কমানো যথেষ্ট নয়। তারা মনে করছেন, চালের দাম মিল গেটে প্রতি কেজিতে আরও ৩ থেকে ৪ টাকা কমানো উচিত। তাহলে আমদানি করা চালের সঙ্গে বেসরকারি পর্যায়ে দেশে মজুদ করা চালের বাজার মূল্যে একটা সামঞ্জস্য তৈরি হবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাস্কিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কেএম লায়েক আলী বলেন, মিল গেটে চালের দাম এর চেয়ে বেশি কমানো সম্ভব নয়। তিনি বলেন, ধানের দাম বেশি হলে চালের দামও বেশি পড়বে। ধানের দাম যে হারে কমেছে, সেই অনুপাতে আমরা চালের দামও কমিয়েছি। লোকসান দিয়ে তো আর ব্যবসা করব না। ব্যবসায় এটা করার সুযোগও নেই। নওগাঁ জেলা ধান-চাল আড়তদার সমিতির সভাপতি নিরোধ চন্দ্র সাহা যুগান্তরকে বলেন, মিল গেটে কমেছে চালের দাম। ফলে সেটা খুচরা পর্যায়েও কমার কথা। এখন সেখানে যদি দাম কমার প্রভাব না থাকে এর দায় মিলারদের নয়। সেটা খুচরা বিক্রেতাদের অসৎ আচরণই বলব। এটা মনিটরিং করার দায়িত্ব সরকারের।যুগান্তর