ব্যক্তিগত অসুস্থতার কারণে এক মাসের ছুটিতে গেলেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। এ ব্যাপারে তিনি সোমবার রাষ্ট্রপতি বরাবর একটি আবেদন করেন। আবেদনে আজ (মঙ্গলবার) থেকেই ছুটিতে যাওয়ার ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন তিনি। এই ছুটির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তার অনুপস্থিতিতে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করবেন। সোমবার রাতে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে আইন মন্ত্রণালয়।
বিষয়টি নিশ্চিত করে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কর্মে প্রবীণ হওয়ায় রাষ্ট্রপতি তাকে (আবদুল ওয়াহহাব মিঞা) ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। আজ মঙ্গলবার থেকে তিনি দায়িত্ব পালন করবেন।
অধস্তন আদালতের বিচারকের চাকরি শৃঙ্খলাসংক্রান্ত বিধিমালা ও ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে টানাপোড়েনের মধ্যে এ ছুটির আবেদন করলেন প্রধান বিচারপতি।
এদিকে এক প্রশ্নের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম যুগান্তরকে বলেন, কোনো চাপে নয়, এটা প্রধান বিচারপতির ব্যক্তিগত ছুটি। এ ছুটির সঙ্গে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের কোনো সম্পর্ক নেই।
অন্যদিকে সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেছেন, অবকাশ শেষে আদালত খোলার দিনে প্রধান বিচারপতির ছুটিতে যাওয়ার ঘটনা সুপ্রিমকোর্টের ইতিহাসে নজিরবিহীন।
২৭ আগস্ট থেকে ২ অক্টোবর পর্যন্ত সুপ্রিমকোর্টের অবকাশকালীন ছুটি ছিল। আজ (মঙ্গলবার) থেকে নিয়মিত আদালত বসছে। এর মধ্যে প্রধান বিচারপতি ৮ সেপ্টেম্বর থেকে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিদেশ সফরে ছিলেন। এদিকে মঙ্গলবার সকালে বিচারপতিদের সঙ্গে আইনজীবীদের সৌজন্য সাক্ষাৎ অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের নেতারা। পরিষদের আহ্বায়ক ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন সোমবার বলেন, আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিদের সঙ্গে আইনজীবীদের সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য মঙ্গলবার ধার্য আছে। সৌজন্য সাক্ষাতে কোনো আইনজীবীর যাওয়া না যাওয়া তার একান্ত বিষয়। এ নিয়ে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের কোনো বিধিনিষেধ নেই।
উল্লেখ্য, ২৪ আগস্ট ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় বাতিল ও প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের দাবিতে প্রতিবাদ সমাবেশে প্রধান বিচারপতির সব অনুষ্ঠান বর্জনের ঘোষণা দেয় বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ।
উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নিতে সংবিধানে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় ১ আগস্ট প্রকাশ করেন সুপ্রিমকোর্ট। রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি দেশের রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি, সুশাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন। এর আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় ১০ আগস্টের সংবাদ সম্মেলনে আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, মামলার ফ্যাক্ট অব ইস্যুর সঙ্গে সম্পর্কিত নয় এমন অনেক অপ্রাসঙ্গিক কথা প্রধান বিচারপতি তার রায়ে বলেছেন। এছাড়া রায়ে জাতীয় সংসদ সম্পর্কে কটূক্তির পাশাপাশি পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা কোনো একক ব্যক্তির কারণে হয়নি- এমন বক্তব্যকে মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকে অস্বীকার করার চেষ্টা হিসেবে দেখছেন আওয়ামী লীগ নেতারা।
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার চাকরির আরও প্রায় চার মাস বাকি আছে। আগামী ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত রয়েছে তার চাকরির মেয়াদ। ২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পাওয়া বিচারপতি সিনহা এ বছর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় দেয়ার পর থেকে ক্ষমতাসীনদের সমালোচনার মুখে পড়েন। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে প্রধান বিচারপতির দেয়া রায়ের পর্যবেক্ষণ প্রত্যাহারের দাবিতে সুপ্রিমকোর্টসহ সারা দেশে সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করে। রায় নিয়ে আইনি পদক্ষেপ নেয়ার প্রস্তাব গৃহীত হয় জাতীয় সংসদে। ওই প্রস্তাব পাসের আগে সংসদে আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আদালত তার এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে সংসদে আনা সংবিধান সংশোধন বাতিলের এই রায় দিয়েছেন। ‘সংসদ ও গণতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করে’ এই রায় দেয়ার উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।
রায় নিয়ে সমালোচনার মুখে বিচারপতি সিনহা আদালতে একটি মামলার শুনানিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে অযোগ্য ঘোষণা করে সে দেশের সুপ্রিমকোর্টের রায় উল্লেখ করেন। ওই রায় দেয়ার পরের পরিস্থিতির দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেছিলেন, বিচার বিভাগ যথেষ্ট ধৈর্য ধরেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করায় নতুন করে সমালোচনার প্রেক্ষাপটে পরে এক অনুষ্ঠানে বক্তব্যে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘মিসকোট’ করে প্রকাশিত বক্তব্যের কারণে তাকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়।
এর আগে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের ওই রায় ‘ভ্রমাত্মক’ বলে প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি ও বর্তমানে আইন কমিশনের সদস্য এবিএম খায়রুল হক।
এদিকে মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে বিচারকের নিয়োগ, নিয়ন্ত্রণ ও অপসারণসংক্রান্ত শৃঙ্খলা বিধিমালা না করায় গত এক বছর ধরে সুপ্রিমকোর্টের সঙ্গে আইন মন্ত্রণালয়ের টানাপোড়েন চলে আসছে। এ সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ নিয়ে সরকার বেশ কয়েক দফা সময় নিয়েছে। বিচার বিভাগের সঙ্গে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের দীর্ঘ টানাপোড়েনের পর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ওই বিধিমালার খসড়া সুপ্রিমকোর্টে জমা দিলেও প্রধান বিচারপতি ৩০ জুলাই তা গ্রহণ না করে কয়েকটি শব্দ ও বিধি নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ওই খসড়া গ্রহণ না করে প্রধান বিচারপতি মতপার্থক্য নিরসনে আইনমন্ত্রী, অ্যাটর্নি জেনারেল ও আইন মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞদের আলোচনায় ডাকলেও এখনও বসা হয়নি।
চাকরিবিধির ওই গেজেট প্রকাশের জন্য ৬ আগস্ট সরকারকে দুই সপ্তাহ সময় দিয়েছিল আপিল বিভাগ। কিন্তু অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ২০ আগস্ট আবারও সময়ের আবেদন করেন। পরে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ বিষয়টির ওপর পরবর্তী আদেশের জন্য আগামী ৮ অক্টোবর দিন ধার্য করেন।
ছুটিতে যাওয়া নজিরবিহীন -জয়নুল আবেদীন : সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেছেন, অবকাশ শেষে আদালত খোলার দিনে প্রধান বিচারপতির ছুটিতে যাওয়ার ঘটনা সুপ্রিমকোর্টের ইতিহাসে নজিরবিহীন। সোমবার বিকালে সুপ্রিমকোর্টে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে তিনি এ কথা বলেন।
পরে সমিতির নেতারা প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে দেখতে হেয়ার রোডে অবস্থিত তার বাসভবনে যান। কিন্তু অনুমতি না পাওয়ায় প্রধান বিচারপতির সঙ্গে তারা দেখা করতে পারেননি। এ প্রসঙ্গে সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন জানান, সোমবার সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী সমিতির নেতারা বিচারপতির সঙ্গে দেখা করতে তার বাস ভবনে যান। বাসভবনের সামনে যাওয়ার পর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা জানান, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে কথা বলে তারা বিষয়টি জানাবেন। কিছুক্ষণ পর তারা জানান, প্রধান বিচারপতি অসুস্থ। এ জন্য তিনি কারও সঙ্গে দেখা করতে পারছেন না। এরপর পুনরায় দেখা করার জন্য অনুমতি চাইলে প্রধান বিচারপতি জানিয়েছেন, তিনি দেখা করতে পারবেন না।
অ্যাভভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, প্রধান বিচারপতি এমন ছুটিতে গেছেন বাংলাদেশের ইতিহাসে নজির নেই। ষোড়শ সংশোধনীর রায় যদি না হতো তবে প্রধান বিচারপতির কোনো দুর্নীতির কথা আসত না, কোনো টাকার কথা আসত না। তাই বলতে হয় আমাদের দেশের বিচার ব্যবস্থায় কোনো রায়ে সরকার খুশি না হলে তাদের এভাবে অপবাদ দিয়ে হেনস্তা করা হবে। এটা খুবই দুঃখজনক। এ সময় সাধারণ সম্পাদক বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, মির্জা আল মাহমুদ ছাড়াও সমিতির অন্য নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
আজ আইনজীবী সমিতির বৈঠক : রাষ্ট্রপতির কাছে এক মাসের ছুটি চেয়ে প্রধান বিচারপতির করা আবেদনকে কেন্দ্র করে মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯টায় জরুরি সভা আহ্বান করেছে আইনজীবী সমিতি। সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
ভালো কোনো ইঙ্গিত বহন করছে না -খসরু : প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার এক মাসের ছুটি নেয়া ভালো কোনো ইঙ্গিত নয় বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, এটা ভালো কোনো ইঙ্গিত বহন করছে না। দেশে একটির পর একটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করার যে ধারাবাহিকতা তার সর্বশেষ নজির বিচার বিভাগ। এটি ধ্বংস হলে মানুষের শেষ আশ্রয়স্থলও আর থাকবে না। সাধারণ মানুষের যাওয়ার কোনো জায়গা থাকবে না।
সোমবার বিকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘বাংলাদেশ ও সংকট’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। বাংলাদেশ জাতীয় দলের ৪১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে এ সভার আয়োজন করা হয়।